জান্নাত শ্রাবণী
Advertisement
জীবনের ট্রেন যেন ছুটছে দমফাটা গতিতে। সামনে আছে বাজারের দাম, পেছনে মাসের শেষে ফাঁকা পকেট। চারপাশে চাহিদার মিছিল, আর মাঝে দাঁড়িয়ে আপনি। একজন মানুষ, যার স্বপ্ন আছে, দায়িত্ব আছে, কিন্তু বাজেট? সে তো প্রতিদিন এক নতুন পরীক্ষার নাম।
কিন্তু জীবন তো শুধু টাকায় চলে না, চলে বোঝাপড়া আর কৌশলে। তাই তো বলি চাহিদার চাপে নয়, বাঁচতে হবে বুদ্ধির ব্যবস্থায়। কখন কী কিনবো, কাকে কী দেবো, কোথায় কীভাবে খরচ করবো-এই ভাবনাগুলোই সব সময় আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। তাই বলে কঠিন এই সময়ে হাল ছেড়ে দেব তা তো হতে পারে না। বরং এটা সেই সময়, যখন ছোট ছোট সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে জীবনের বড় গল্প।
চলুন আমরা শুরু করি সেই গল্প যেখানে বেঁচে থাকার, সামলে চলার, আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের মতো করে জীবনকে ভালোবাসার কৌশল লুকিয়ে আছে।
Advertisement
যদি ভাবেন মাসের ৩০ দিনই শুধু খরচ আর হিসেব, তাহলে আপনি একা নন। দেশের হাজারো মানুষ এখন এমন এক বাস্তবতায় দিন কাটাচ্ছেন। যেখানে আয় বাড়ে না, অথচ ব্যয়ের খাতা যেন থামতেই চায় না। প্রতিদিনের বাজার, স্কুলের ফি, বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ-পানির বিল সবকিছুই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে বেশি চাপ দিতে পারে।
অথচ জীবন থেমে থাকে না। চলতে হয়, হাসতে হয়, পরিবার নিয়ে এগোতে হয়। তাই সময় এসেছে জীবনকে শুধুই ‘টানাটানি’ দিয়ে নয়, ‘পরিকল্পনার সাথী’ করে তোলার। আর সেই পথের আসল উপায় বুদ্ধির ব্যবস্থায় বাঁচা।
বর্তমান সময়টা সাধারণ মানুষের জন্য খুব একটা সহজ নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়া সব মিলিয়ে প্রতিটি পরিবারকে তাদের আয় অনুযায়ী ব্যয় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য এই মুহূর্তে ঘরের বাজেট ঠিক রাখা যেন একধরনের শিল্প। এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে একটু বুদ্ধি করে, পরিকল্পনার সঙ্গে এবং বাস্তবমুখী কিছু অভ্যাস গড়ে তুলে আমরা বাজারের এই চাপ সামাল দিতে পারি।
বাজেট ভয় নয়, ভরসার নামঅনেকেই মনে করেন বাজেটের মধ্যে চলা মানে কষ্টে থাকা বা সীমাবদ্ধতায় ঘেরা এক জীবন। কিন্তু বাজেট মানে শুধু খরচ কাটছাঁট নয়; এটা আসলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম ধাপ।
Advertisement
একটা সাদা কাগজ নিন, লিখে ফেলুন আপনার মাসিক আয় আর খরচের হিসাব। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝবেন, কোথায় টান মেরে সামলে নেওয়া যায়; কোথায় একটু সচেতন হলে পরবর্তী মাসটা ভালো কাটবে। শুরু করুন এই প্রশ্নগুলো দিয়ে-কী কী খরচ আমার মাসে বাধ্যতামূলক?কোথায় আমি অপ্রয়োজনীয় ভাবে ব্যয় করছি?কোন খরচগুলো কমানো সম্ভব বা কোনটা বাদ দেওয়া যায়?
আরও পড়ুন:দীর্ঘ কর্মঘণ্টা উৎপাদনশীলতা বাড়ায় নাকি ঝুঁকিতে ফেলে?ঈদ শেষ, এখন সস্তায় স্টাইলের সময় বাজেট প্ল্যানিং কেন জরুরিবর্তমানে প্রতি মাসেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। অথচ বেশিরভাগ চাকরিজীবী মানুষের বেতন একই রয়ে গেছে। অন্যদিকে সন্তানের স্কুল ফি, চিকিৎসা খরচ, ট্রান্সপোর্টসহ নানান খাতে খরচ বাড়ছে সমানতালে। ফলে অনেকেই ঋণের ফাঁদে পড়ছেন বা সঞ্চয় ভেঙে চলতে বাধ্য হচ্ছেন। ঠিক এই জায়গাতেই জরুরি হয়ে উঠছে সুপরিকল্পিত বাজেট মেইনটেইন করা।
বাজেট তৈরি ও অনুসরণের কৌশলমাসের শুরুতেই একটি বাজেট তালিকা তৈরি করুন। কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে নিন। খরচের মধ্যে ‘চাহিদা’ ও ‘চাওয়া’ এর পার্থক্য করুন। যেমন: ভাত-ডাল-তরকারি প্রয়োজনীয়; কিন্তু প্রতিমাসে নতুন জামাকাপড় কেনা নয়। খরচের হিসাব রাখুন প্রতিদিন। খাতায় লিখে, মোবাইল অ্যাপ (মানি লাভার, ওয়ালেট) কিংবা সিম্পল এক্সেল শিটে এই হিসাব রাখা যেতে পারে।
বাজার করার স্মার্ট উপায়একটি সাপ্তাহিক বা মাসিক বাজার তালিকা তৈরি করুন। আগে থেকে পরিকল্পনা করুন যেন বাজারে গেলে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এড়ানো যায়। সিজনাল পণ্য কিনুন (যেমন- গ্রীষ্মে আম/কাঁঠাল বা শীতকালে শাকসবজি) যা তুলনামূলক সস্তা হয়। সুপারশপের চেয়ে লোকাল বাজারে অনেক সময় কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। তবে সুপারশপে দেওয়া বিভিন্ন ছাড় বা অফারগুলো খেয়াল রাখা উচিত। এছাড়া আশপাশের বিভিন্ন হকার মার্কেট বা স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল থেকে অল্প দামে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস সংগ্রহ করা সম্ভব।
ঘরের ভেতরে ছোট ছোট সেভিংসদিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করুন, অপ্রয়োজনীয় লাইট ফ্যান বন্ধ রাখুন। গরমের দিনে এসির পরিবর্তে ইনভার্টার ফ্যান বা ন্যাচারাল ভেন্টিলেশন ব্যবহার করুন। রান্নার সময় কভার ব্যবহার করলে গ্যাসের সাশ্রয় হয়। পানি ব্যবহারেও সচেতন হোন। লিকেজ মেরামত রাখুন নিয়মিত।
রান্নায় স্মার্টনেসসাপ্তাহিক মেনু প্ল্যান করুন। এতে একসঙ্গে বাজার ও রান্নার সুবিধা হয়। একবারে রান্না করে সংরক্ষণ করলে সময় ও গ্যাস উভয়ই বাঁচে। বাইরের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। এতে শুধু খরচ নয়, স্বাস্থ্যও বাঁচবে।
জীবনযাত্রায় সরলতা আনুনঅপ্রয়োজনীয় সাবস্ক্রিপশন বা বিল বাতিল করুন (যেমন: OTT প্ল্যাটফর্ম)। ট্রেন্ডের পেছনে না ছুটে প্রয়োজনের ভিত্তিতে কেনাকাটা করুন। লোন নেওয়ার আগে ১০ বার ভাবুন; না হয় পরে সেটা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
অল্পতে স্মার্ট থাকাআজকাল অফার, সেল, ডিল এসব আমাদের বাজারে সর্বত্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব দেখেই অনেক মানুষ বাজে শপিংয়ে চলে যায়। এসব লোভ সামলিয়ে একদিকে যেমন বাজেট রক্ষা করতে হবে, অন্যদিকে নিজেকে স্মার্টও রাখতে হবে। সেল, ডিসকাউন্ট, কোড ব্যবহার করুন; তবে প্রয়োজনের বাইরে কিছু কেনার জন্য তাড়া করবেন না। স্মার্ট এবং টাইমলেস ফ্যাশনে বিনিয়োগ করুন, যা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যাবে।
অনলাইন সেল ও অফার বুদ্ধিমত্তায় ব্যবহারবর্তমানে দারাজ, পিকাবো, অথবা, প্রিয়শপ এবং বিভিন্ন ফেসবুক পেইজে স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল চালাচ্ছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিতে পারেন। অনলাইনে শপিংয়ের সময় কুপন কোড, ক্যাশব্যাক অফার, ফ্রি ডেলিভারি ব্যবহার করুন। কিন্তু সেল মানেই যে কিনতে হবে এমন নয়। যাচাই করে নিন আসলেই প্রয়োজন আছে কিনা।
পারিবারিক বাজেট প্ল্যানিংআপনার পরিবারের সদস্যরা কীভাবে খরচ করছে সেটা সম্পর্কে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সবারই জানা উচিত কত টাকা সেভ করা দরকার। পরিবারে সব সদস্যের সঙ্গে আর্থিক পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করুন, এতে সবাই সচেতন থাকবে এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ছোট সঞ্চয়, বড় নিশ্চয়তাপ্রতিমাসে অন্তত ৫-১০% সঞ্চয়ের চেষ্টা করুন। মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিপিএসের মাধ্যমে অটোমেটিক সেভিংস করুন। সোনা নয়, ইলেকট্রনিক বা ফাইন্যান্সিয়াল সেভিংসে বিশ্বাস রাখুন।
মানসিক চাপ কমাতে ছোট ছোট সুখঅর্থনৈতিক চাপ সবার উপরই আছে, কিন্তু জীবনের আনন্দ শুধু টাকায় পাওয়া যায় না। ছোট ছোট মুহূর্তে সুখ খুঁজুন যেমন: হালকা পিকনিক, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, কিংবা প্রিয় বইটি পড়া। সস্তা কিন্তু মজার ডিনার কিংবা সিনেমা দেখতে যাওয়া এগুলো আপনাকে মানসিক শান্তি এনে দেবে।
সব সময় আমাদের সবার মনে রাখা উচিত যে, অর্থনৈতিক টানাপোড়ন নতুন কিছু নয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জের মধ্যেও একটু কৌশলী হলে, নিজের ও পরিবারের জন্য শান্তির একটি পথ তৈরি করা যায়। অল্প আয় দিয়েও ভালভাবে জীবন চালানো সম্ভব; শুধু দরকার সচেতনতা, পরিকল্পনা ও স্মার্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা। বাজেট মানে বঞ্চনা নয় বরং তা স্থিতিশীল জীবনের সেতুবন্ধন। এখনই সময়, বাজেটকে গুরুত্ব দিয়ে সুস্থ জীবনযাত্রার পথে হাঁটার।
জেএস/জেআইএম