ওসমান ইবনে আফফান (রা.) আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন প্রিয় ও প্রসিদ্ধ সাহাবি। তিনি ‘আস-সাবিকুনাল আওয়ালুন’ বা ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ পুরুষ। আবু বকর (রা.) জায়েদ (রা.) ও আলীর (রা.) পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
Advertisement
নবিজির (সা.) দুই মেয়েকে বিয়ে করার কারণে তাকে ‘যুননুরাইন’ বা দুই নুরের অধিকারী বলা হতো। তিনি নবিজির (সা.) মেয়ে রুকাইয়া (রা.) ও তার মৃত্যুর পর উম্মে কুলসুমকে (রা.) বিয়ে করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ বা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবির অন্যতম।
ওসমান (রা.) ইসলামের তৃতীয় খলিফা। ওমর (রা.) শহীদ হওয়ার পর তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নবিজির (সা.) ওফাতের পর নবিজির (সা.) নেতৃস্থানীয় সাহাবিরা সর্বসম্মতিক্রমে আবু বকরকে (রা.) খলিফা বা মুসলমানের নেতা নির্বাচিত করেছিলেন। দুই বছর খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আবু বকর (রা.) যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন, তখন তিনি ওমরকে (রা.) পরবর্তী খলিফা নির্ধারণ করেছিলেন। এরপর দশ বছর ওমর (রা.) খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ওমর (রা.) যখন আততায়ীর খঞ্জরের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়, তখন তিনি সরাসরি কাউকে খেলাফতের দায়িত্ব না দিয়ে আল্লাহর রাসুলের (সা.) ঘনিষ্ঠ ছয়জন সাহাবিকে নিয়ে একটি শুরা পরিষদ গঠন করে তাদেরকে খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দেন। এই ছয়জন সাহাবি হলেন, ওসমান ইবনে আফফান, আলী ইবনে আবু তালিব, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, তালহা ইবন ওবায়দুল্লাহ এবং জুবাইর ইবনে আওয়াম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। এ ছাড়া ওমর (রা.) নিজের ছেলে আবদুল্লাহকেও (রা.) শুধু পরামর্শ দেওয়ার জন্য তাদের আলোচনায় উপস্থিত থাকতে বলেন।
Advertisement
ওমরের (রা.) ওফাতের পর ছয়জন সাহাবি আলোচনায় বসেন। শুরুতেই সা’দ (রা.) তার ভোট আবদুর রহমান ইবন আওফকে দিয়ে দেন। জুবায়ের (রা.) তার ভোট দিয়ে দেন আলীকে (রা.) এবং তালহা (রা.) তার ভোট দিয়ে দেন ওসমানকে (রা.)। তখন আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) আলী ও ওসমানকে (রা.) বলেন, আপনাদের মধ্যে কেউ যদি এই দায়িত্বের প্রার্থিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে সম্মত হন, তাহলে আমি অপরজনকে মনোনীত করব।
এই প্রস্তাবে তারা উভয়েই চুপ থাকেন। অর্থাৎ দুজনই খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বলেন, আমি আমার নিজের প্রার্থিরা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি এবং আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব যেন আপনাদের দুজনের মধ্যে যিনি এই দায়িত্ব পালনের বেশি উপযুক্ত, তাকেই মনোনীত করতে পারি। তারা উভয়েই এ ব্যাপারে সম্মতি দেন।
এরপর আবদুর রহমান (রা.) প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে তাদের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন। তিনি শর্ত রাখেন যে, যে-ই খলিফা হোন না কেন, তিনি যেন কোরআন-সুন্নাহ ও পূর্ববর্তী দুই খলিফা আবু বকর ও ওমরের (রা.) আদর্শ অনুসরণ করেন, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন, আর অন্যজন যেন তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। উভয়েই এই শর্তে সম্মতি দেন।
এরপর আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মুসলমানদের মতামত গ্রহণ করেন। তিন দিন ও তিন রাত ধরে গোপনে-প্রকাশ্যে, এককভাবে-দলগতভাবে মুসলমানদের বিভিন্ন অংশের অভিমত গ্রহণ করার পর তিনি লক্ষ্য করেন, অধিকাংশ মানুষ ওসমানকেই (রা.) এই দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন।
Advertisement
ওমরের (রা.) ওফাতের তিন দিন পর চতুর্থ দিন সকালে আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.) আলী (রা.) ও ওসমানকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে মসজিদে নববিতে যান এবং গুরুত্বপূর্ণ সাহাবায়ে কেরামসহ সর্বস্তরের মানুষকে মসজিদে উপস্থিত হওয়ার জন্য ডাকা হয়।
সবাই মসজিদে সমবেত হলে আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.) মিম্বরে ওঠেন এবং দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি নীচু স্বরে দীর্ঘ কোনো দোয়া পাঠ করেছিলেন যা কেউ শুনতে পায়নি। তারপর তিনি বলেন, হে মুসলমানগণ! আমি প্রকাশ্যে ও গোপনে আপনাদের সবার মতামত গ্রহণ করেছি। আমি কাউকেই দেখিনি, যিনি এই দুই ব্যক্তির বাইরে অন্য কাউকে উপযুক্ত মনে করেছেন—অর্থাৎ আলী ও ওসমান (রা.)। হে আলী! আপনি এগিয়ে আসুন!
আলী (রা.) সামনে এগিয়ে এলে তিনি তার হাত ধরেন এবং বলেন, আপনি কি কোরআন, রাসুলুল্লাহর (সা.) সুন্নাহ ও আবু বকর-ওমরের পথ অনুসরণ করে খেলাফতের দায়িত্ব পালনে রাজি?
হযরত আলী (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
আবদুর রহমান (রা.) তার হাত ছেড়ে দেন এবং ওসমানকে (রা.) ডেকে বলেন, আপনি কি কোরআন, রাসুলুল্লাহর (সা.) সুন্নাহ এবং আবু বকর-ওমরের পথ অনুসরণ করে খেলাফতের দায়িত্ব পালনে রাজি আছেন?
ওসমান (রা.) বলেন, আল্লাহর নামে, হ্যাঁ।
তখন আবদুর রহমান (রা.) তার হাত ধরে তুলে মসজিদের ছাদের দিকে তাকিয়ে তিনবার বলেন, হে আল্লাহ! আপনি শুনুন ও সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি শুনুন ও সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি শুনুন ও সাক্ষী থাকুন, আমি এই দায়িত্ব ওসমানের কাঁধে তুলে দিলাম!
এরপর সবাই ব্যাপক উৎসাহের সাথে ওসমানের (রা.) হাতে বাইআত (আনুগত্যের অঙ্গীকার) করতে এগিয়ে আসে।
এভাবে ওমরের নির্বাচিত শূরা সদস্যদের আলোচনা, অভিমত ও সর্বস্তরের মুসলমানদের ব্যাপক সমর্থনের ভিত্তিতে ওসমান (রা.) খলিফা নির্বাচিত হন।
সূত্র: আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া
ওএফএফ/জেআইএম