বিনোদন

দেশে দেশে প্রথা ভাঙা নারী তারকারা

বিশ্বজুড়ে অনেক নারী তারকা আছেন, যারা নিজেদের অভিনয়, কাজ এবং ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে চিরাচরিত প্রথা ভেঙেছেন এবং সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। আজ নারী দিবসে সেইসব নারীদের কথা জানা যাক-

Advertisement

মেরিলিন মনরোমেরিলিন মনরো- একটি নাম, একটি প্রতীক, এক বিপ্লব। হলিউডের এই কিংবদন্তি শুধু রূপকথার গ্ল্যামার নয়, বরং নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের এক অদম্য উদাহরণ। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে, যখন নারীদের মূলত গৃহবন্দি ও পরনির্ভরশীল করে রাখার প্রচলন ছিল, তখন মেরিলিন নিজের শর্তে বাঁচার সাহস দেখিয়েছিলেন। সেসময় নারী তারকাদের মূলত ‘সাজানো পুতুল’ হিসেবে দেখা হতো- তারা ছিলেন সৌন্দর্যের প্রতীক, কিন্তু স্বাধীনচেতা নয়। মনরো এই ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি শুধু নিজের সৌন্দর্য নয়, বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। হলিউডে তাকে ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ (নির্বোধ সুন্দরী) হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মেরিলিন তার চারপাশের মানুষদের ভুল প্রমাণ করেন। তিনি ছিলেন বইপ্রেমী, রাজনীতি ও সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী এবং একজন স্বাধীনচেতা চিন্তাবিদ মানুষ।

অপেরা উইনফ্রেতিনি একজন নারী, যিনি দারিদ্র্য, বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়ে নিজের ভাগ্যকে বদলে দিয়েছেন। বলছি অপেরা উইনফ্রের কথা। শোবিজের ইতিহাসে তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি নিজের নামেই টক শো গড়ে তুলে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছেন। চারদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর নির্যাতন, নিচু জাত বিবেচ্য করে ভয়াবহ রকমের শোষণের সমাজের বিরুদ্ধে অপেরার এ টক শোটিকে বলা চলে কৃষ্ণাঙ্গ তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর মাথা তুলে দাঁড়ানোর ময়দানে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

সিল্ক স্মিতাবলা হয়ে থাকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্র সংস্থাগুলোতে পুরুষতন্ত্রের জাল বেশ ভালোভাবে বিস্তৃত। আর তার শিকার কেবল নায়িকারা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেই জালে কেউ ধরা পড়েন, কেউ ধরা দেন। কেউ কোনোটাই না করে হারিয়ে যান। আর এদের সবার চেয়ে আলাদা, নিজেই মায়াজাল হয়ে কোটি দর্শককে বশ করে শোবিজকে তছনছ করে দেওয়া এক নাম সিল্ক স্মিতা। আশির দশকে দক্ষিণী সিনেমার পর্দা কাঁপানো নায়িকা তিনি। সিল্কের প্রকৃত নাম বিজয়লক্ষ্মী ভাদলাপাতলা। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে রূপান্তরিত করেছিল সিল্ক স্মিতায়। সিল্ক যতক্ষণ পর্দায় থাকতেন ততক্ষণ নাকি দর্শক চোখের পাতা ফেলতে পারতেন না।

Advertisement

শর্মিলা ঠাকুর ষাট ও সত্তরের দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রে যখন নারীদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল, তখন শর্মিলা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই অচলায়তন ভেঙেছিলেন। অভিনয়ের মাধ্যমে যেমন নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও নিজের শর্তে চলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। হয়েছেন নারীদের এগিয়ে চলার প্রেরণা।

১৯৪৪ সালে এক জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া শর্মিলা ঠাকুর মাত্র ১৪ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন। এরপর তিনি বলিউডেও নিজের মেধার বিকাশ ঘটনা। সেই সময় বলিউডে অভিনেত্রীদের শুধু নায়িকা হিসেবে দেখা হতো যারা পর্দায় প্রেমে পড়বেন, গান গাইবেন এবং শেষে নায়কের সঙ্গে সুখী জীবন যাপন করবেন। শর্মিলা এই ধারণা বদলে দেন। তিনি এমন চরিত্র বেছে নেন, যেখানে নারী কেবল ভালোবাসার জন্য নয়, নিজের ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানের জন্যও লড়ে।

সুচিত্রা সেনসুচিত্রা সেন- বাংলা ও ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি নাম। সেইসঙ্গে তিনি আজও বাঙালি নারীর আত্মসম্মান, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বের প্রতীক। ষাট ও সত্তরের দশকে পুরুষতান্ত্রিক গল্পের গতানুগতিক চিন্তার বাইরে সুচিত্রা হাজির হন নারীর বিকাশ ও ব্যক্তিত্বের বার্তা নিয়ে।

১৯৩১ সালে এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সুচিত্রা সেন সিনেমার দুনিয়ায় প্রবেশ করেন ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে। ছবিটি মুক্তি পায়নি। তবে ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসেন।

Advertisement

ববিতাবাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান শক্তিশালী করতে যে কজন অভিনেত্রী অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে ববিতা অন্যতম। সাহসী চরিত্র বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে অভিনয়, এমনকি সিনেমায় শারীরিক ঘনিষ্ঠতার দৃশ্যে অভিনয়ের মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। যা তাকে নারীদের কাছে আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

ববিতার ক্যারিয়ারে অন্যতম একটি মাইলফলক কাজ রাজ্জাকের বিপরীতে ‘অনন্ত প্রেম’। বাংলা সিনেমায় শারীরিক ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য তখনও ছিল এক প্রকার ট্যাবু। কিন্তু ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে রাজ্জাকের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ঘনিষ্ঠ চুম্বনের দৃশ্যে অভিনয় করে ববিতা সেই ট্যাবু ভেঙে দেন। সেই সময়ে এই দৃশ্যে অংশ নিয়ে সাহসের যে পরিচয় ববিতা দিয়েছিলেন তা আজকের দিনে উপলব্ধি করা অসম্ভব। শোনা যায়, এ ছবির জন্য ববিতা ৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক তো নিয়েছিলেনই আরও অতিরিক্ত ২০ হাজার নিয়েছিলেন চুম্বন দৃশ্যের জন্য, যা সে সময় ছিল অকল্পনীয় সাহসিকতা।

রুনা লায়লাবাংলাদেশের সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী—রুনা লায়লা। তিনি এক বিপ্লবী নারী যিনি সংগীতের প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন পথ তৈরি করেছেন। যখন উপমহাদেশের সংগীত জগতে নারীরা বেশিরভাগ সময় কেবল শাস্ত্রীয় বা কোমল কণ্ঠের রোমান্টিক গানে সীমাবদ্ধ থাকতেন, তখন রুনা লায়লা তার শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, বহুমুখী প্রতিভা ও অনন্য স্টাইল দিয়ে সীমানা ভেঙে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

রুনা লায়লা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে সমান জনপ্রিয়। তিনি বাংলা, উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, ইংরেজি, ফারসি, আরবি, ফরাসি, স্প্যানিশ এবং ইতালিয়ানসহ ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন, যা তাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আন্তর্জাতিক কণ্ঠশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অনেক নারীকে দিয়েছে চারদেয়ালের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব জয় করার শক্তি।

পুরুষতান্ততিক সমাজে দাঁড়িয়ে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রুনা লায়লা। তার স্টাইল, স্টেজ পারফরম্যান্স, গান নির্বাচন—সবকিছুই ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

আরও পড়ুন:মনে হয়নি এলাকার কোনো বড়ভাই আমার দিকে তাকাবেন: ন্যান্সিনারী দিবস নিয়ে ‘প্রশ্ন’ শবনম ফারিয়ার

রোজিনাঢাকাই চলচ্চিত্রের ড্রিমগার্ল ও গালে তিলকখচিত টানা চোখের অধিকারী সোনালি যুগের চিত্রনায়িকা রোজিনা। গত শতাব্দীর আশি ও নব্বই দশকের সুপারহিট এই চিত্রনায়িকা তার অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন ‘জানোয়ার’ সিনেমায় একটা পাসিং শট দিয়ে। এরপর ছোট ছোট চরিত্রে কাজ করতে করতে তখন উঠতি নায়িকা হিসেবে স্বপ্ন দেখছেন বড় নায়িকা হওয়ার। ঠিক তখনই এলো বিজ্ঞাপনের প্রস্তাবটি। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। বাকিটা ইতিহাস। সত্তর দশকের রক্ষণশীল সমাজে জন্মনিরোধক পিল মায়াবড়ির বিজ্ঞাপনটি দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লো রোজিনার নাম। তবে আলোচনার চেয়ে বিতর্কই ছিল বেশি।

কারণ সেই সময় এসব জন্মনিরোধক বিষয়গুলো ছিল খুবই সেনসেটিভ আর লজ্জার ব্যাপার। রোজিনা অভিনীত মায়াবড়ির বিজ্ঞাপনটি যখন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে প্রচার হতো তখন অনেক বাড়িতে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হতো লজ্জায়, সংকোচে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙ্গে দেয়া এ বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক সমালোচনা পোহাতে হয়েছে রোজিনাকে। বাদ পড়েছেন অনেক সিনেমা থেকে। অনেক প্রযোজক, পরিচালক, নায়ক-নায়িকারাও তাকে এড়িয়ে চলেছেন৷ তবে অভিনয়কে ভালোবেসে বড় নায়িকা হওয়ার অধ্যাবসায় রাজবাড়ির মেয়ে রোজিনাকে এনে দিয়েছে সাফল্য। বলা চলে নায়িকা হিসেবে সাফল্যের আকাশ ছুঁয়েছেন তিনি৷ একাধিকবার পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। নিজে হয়েছেন প্রযোজক, পরিচালক। দায়িত্ব পালন করেছেন সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবেও৷

এলআইএ/এমএমএফ/জেআইএম