আমরা এখন যেটাকে মব বা মবোক্রেসি বলছি, সেটা নতুন কিছু নয়। শুধু যে মানুষের উপরেই এই অত্যাচার চলে, তাও নয়। পশুপাখি, গাছপালা, পাহাড়, মাটি, নদী কেউই মানুষের এই নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায় না। বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তা প্রকট আকার ধারণ করে। কোন কারণ ছাড়াই বা খুব তুচ্ছ কারণে মানুষ যেমন মানুষকে খুন করে, পিটিয়ে মেরে ফেলে, দেহ থেকে মাথা কেটে আলাদা করে বা পুড়িয়ে মারে, ঠিক তেমনি অকারণেই নৃশংস আচরণ করে পশুপাখির প্রতিও।
Advertisement
পশুপাখির মুখে কোনো কথা নেই, ওদের সাথে মানুষের কোন স্বার্থগত দ্বন্দ্ব নেই, ওরা মানুষের তেমন কোনো ক্ষতিও করে না। তাও আমরা যখন-তখন ওদের মেরে ফেলি, নির্মম আচরণ করি, বন্দী করে রাখি, ফেলে দেই, আহত করি, পুড়িয়ে মারি, এমনকি গণপিটুনিও দেই। ওদের প্রতি এই নিপীড়ন করে মানুষকে শাস্তি পেতে হয় না বলে, মানুষ দিনে দিনে আরো মারমুখী হয়ে উঠেছে। এখন একজন মানুষ অন্য আরেকজনকে খুব সহজেই হত্যা করতে পারে। এরকম একটা মানসিকতা থেকেই এই মবোক্রেসির সৃষ্টি। আর আইনের শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তা বাড়ছে।
যেমন দু’বছর আগে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে লোকালয়ে ছোটাছুটির সময় গ্রামবাসীর নজরে পড়ে একটি নীলগাই। এরপর গ্রামবাসী তাকে ধাওয়া দিতে শুরু করে। বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীটি একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পা ছোড়াছুড়ি করে। প্রায় ১০ জন গ্রামবাসী সেটিকে চেপে ধরে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করে। গ্রামবাসীকে এই পৈশাচিক কাজটা কেন করতে হলো? কেন একটি নিরীহ প্রাণিকে জবাই করতে হলো?
শুধু কি তাই? বন্যপ্রাণির টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত দেশের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় পশুপাখিদের অমানবিকভাবে হ্যান্ডেল করা হয়, কষ্টকর পরিবেশে রাখা হয়। এর আগে জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রাণিদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লিখেছি। তাদের প্রতি মানুষের নির্লজ্জ আচরণের কথা উঠে এসেছে রিপোর্টে। কিছু মানুষ গর্ভবতী বানরের প্রতি এতোটাই নোংরা আচরণ করেছে যে ওরা খাঁচার এক কোণায় গিয়ে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
Advertisement
এই যে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মরার চর্চা, কুকুর– বিড়ালের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়ার প্রবণতা, ধারালো কিছু দিয়ে কোপ দেয়া, হাত-পা ভেঙে দেয়া বা খাবারে বিষ দিয়ে প্রাণি হত্যা সবই এক খাপে সাজানো। কাজেই ভুলে গেলে চলবে না যে প্রাণি হত্যাকারী মানুষের হাত থেকে আপনি-আমি কেউই নিরাপদ নই।
দিনাজপুরে স্বপ্নপুরী পার্কের অবৈধ চিড়িয়াখানা থেকে দুই দফায় ১২২ বন্যপ্রাণি উদ্ধার করেছেন বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিট ও সামাজিক বন বিভাগ। জব্দ করা প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে হুলক গিবন, এশিয়াটিক বিয়ার, ক্যাপড ল্যাঙ্গুর, গ্রেটার হর্নবিল, লজ্জাবতী বানর, ভোঁদড়, বেশ কিছু সাপ ও কচ্ছপ। পার্কে তাদের এতোটাই অনাদরে রাখা হয়েছিল যে, এদের মধ্যে কিছু প্রাণি শারীরিকভাবে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে যে কতটা আরামে প্রাণিদের রাখা হয়েছিল। যত্ন ছাড়া শুধু ব্যবসা করা হয়েছে এদের প্রদর্শন করে।
কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে আসছে অসংখ্য মৃত কচ্ছপ। মৃত কচ্ছপগুলো জলপাই রঙের বা অলিভ রিডলি প্রজাতির বলে গবেষকেরা জানিয়েছেন। প্রজনন মৌসুমে কেন এভাবে কচ্ছপ মারা যাচ্ছে বা মৃত কচ্ছপ ভেসে আসছে? এর জন্য দায়ী কারা? দায়ী এই আমরাই মানে মানুষ। পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী গণমাধ্যমকে বলেছেন, “প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কচ্ছপকে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে।”
প্রজনন মৌসুমে কচ্ছপের মৃত্যু বাড়ছে, যা চিন্তিত করে তুলেছে গবেষকদের। তাঁরা বলছেন, এভাবে কচ্ছপের মৃত্যু তাদের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় মা কচ্ছপ উপকূলে ডিম দিতে আসে। তখন অনেক কচ্ছপ জেলেদের জালে আটকে, সমুদ্রে চলাচলকারী বড় নৌযানের ধাক্কায় মারা যায়। ডলফিনের মতো বন্ধু প্রাণিও আমাদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা। বিভিন্ন কারণে এরা মরে গিয়ে ভেসে আসছে তীরে। নানা কারণে তাদের ডিম দেওয়ার স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেমন সাগরপাড়ে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত বাড়িঘর-হোটেল, সৈকতে বেড়েছে আলোর পরিমাণ। এছাড়া সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা, সৈকতে পুঁতে রাখা মাছ ধরার অবৈধ কারেন্ট জাল ইত্যাদি কারণে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গভীর সাগরে ট্রলিং জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ।
Advertisement
কচ্ছপ সৈকতে এসে ডিম পাড়তে পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিমগুলো খেয়ে ফেলছে কুকুর। ডিম পাড়তে উঠলেই মা কচ্ছপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সংঘবদ্ধ কুকুর। ক্রমাগত কচ্ছপের ডিম দেওয়ার স্থান কমছে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেওয়ার স্থানটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি, তা না হলে কচ্ছপ রক্ষা করা যাবে না। সমুদ্রপাড়ে ডিম দিতে এসে আবার গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা এই অসহায় প্রাণীদের বেঁচে থাকার ও নিরাপদে ডিম পাড়ার অধিকার সংরক্ষণ করতে পারছি না। কারণ আমরা এদের বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকার করি না।
মানুষ জীবনভর কত কিছু খায়, কিন্তু এরপরেও লোভ যায় না। শুনেছি খুলনা, সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় এখনো বিয়েতে হরিণের মাংস খাওয়ানো হয়। বরের বাড়ির পক্ষ থেকে এই স্পেশাল দাবি জানানো হয়। পরিযায়ী পাখিগুলো যখন প্রচণ্ড ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেশে আসে। আর আমরা তাদের হত্যা করি শুধু পাখির মাংস খাওয়ার জন্য। ছোট ছোট সুন্দর রঙের পাখিগুলোকে দেখেই মানুষের ইচ্ছা জাগে এদের খেয়ে ফেলতে। এই মানুষদের মতো কেউ যে শিশু হত্যা বা ধর্ষণ করছে না, তা কে বলতে পারে?
পাখির মাংস বিক্রি করার দায়ে সিলেটের জৈন্তাপুরে হরিপুরে রেস্তোরাঁকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি আরও কয়েকটি রেস্তোরাঁয় রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা অবস্থায় ১৫০টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মাংস জব্দ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণি আইন ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর এইসব এলাকার কয়েকটি রেস্তোরাঁয় দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির পাখির মাংস বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় শিকারি চক্রের কাছ থেকে ওই পাখিগুলো গোপনে কেনেন হোটেল মালিকরা। অল্প খরচে অধিক লাভ করার লোভে শিকারিরা বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি।
সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরে বিষটোপে হত্যা করা অসংখ্য পাখি পাওয়া গেছে। কিছু পাখি নদীর পানিতেও ভেসে গেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা ইগল, ভুবন চিল, তিলিহাঁস ও পিয়ং হাঁসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মোট ৪১টি পরিযায়ী পাখি উদ্ধার করেছেন। তারা একটি চরেই ৪১টি মৃত পাখি পড়ে থাকতে দেখেন। এত পাখি মরে পড়ে আছে দেখে তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন।
হোটেল-রেস্টুরেন্টের “পাখি খেকো’ ক্রেতারা কি জানেন বিষক্রিয়ায় মৃত এই পাখিগুলোই তারা আয়েশ করে খাচ্ছেন? পাখি শিকারি লিটন স্বীকার করেছে যে তারা রাতে পদ্মার চরে বিষটোপ দেয়। এই বিষটোপ খেয়ে পাখি মারা যায়। সকালে মৃত পাখি উদ্ধার করে, চরেই মৃত পাখির গলা কাটা হয়। পরে এই মৃত পাখি নগরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করা হয়। কেউ যাতে সন্দেহ না করেন, সে জন্য লিটন কারেন্ট জাল নিয়ে মাছ ধরার নাম করে নদীতে নামতো কিন্তু তার আসল কাজ ছিল বিষটোপে পাখি হত্যা করা। প্রতিবছর শীত মৌসুমে রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি আসে।
মানুষ এ পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্মম প্রাণি। বাংলাদেশে যেহেতু বন্যপ্রাণি প্রটেকশন আইন খুব একটা কার্যকর নয়, তাই অবাধে এই হত্যা চলতে থাকে। শুধু যে খাওয়ার জন্যই এদেশে মানুষ পশুপাখি মারেন, তা নয়। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, আনন্দ বা মজা করার জন্যও এই কাজ করেন। কয়েক বছর আগে রাজবাড়ীতে একটি ঘোড়ার চার পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মূলত শত্রুতা ছিল ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে, কিন্তু মরতে হলো ঘোড়াটিকে।
কিছুদিন আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটিতে বিষ দিয়ে রাস্তার কুকুর-বিড়াল হত্যা করা হয়। এই প্রাণিগুলো মানুষের দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচে। খাবার পেলে খায়, নয়তো অনাহারেই কাটে দিন। এরা কি কখনো কোনো মানুষের কাছ থেকে খাবার কেড়ে খেয়েছে? হয়তো না, এ সংক্রান্ত কোনো খবর চোখে পড়েনি। অথচ একদিন আপনি বা আপনার আমার মতো কেউ খাবার নিয়ে নিয়ে তাদের ডাকলেন। প্রাণিগুলো বিশ্বাস করে এগিয়ে এলো, আর সেই খাবারই তাদের জীবনের শেষ খাবার হলো। কারণ সেই খাবারে মেশানো ছিল বিষ। আর সেটা খেয়ে কুকুর ও বিড়ালগুলো যন্ত্রণায় ছোটাছুটি করার পর রক্তবমি করে মারা গেল। এ ঘটনা ঘটেছিল ২২ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার জাপান গার্ডেন সিটিতে।
যারা এই অমানবিক কাজটি করেছেন এবং যে কারণে করেছেন, তারা আসলে খুনি। প্রয়োজনে মানুষকে বিষ খাইয়ে মারতেও তারা একবারও ভাববে না। গণপিটুনিতে অংশ নিয়ে মানুষ খুন করতেও এদের হাত কাঁপবে না। যে শিশুরা দেখলো তাদের অভিভাবক নির্বিচারে কুকুর-বিড়াল হত্যা করতে পারে, তারা কী শিখবে এই অভিভাবকদের কাছ থেকে? ওরা দেখলো প্রাণীগুলো সবার সামনে কাঁতরাতে কাঁতরাতে মারা গেল। কিন্তু কোন অভিযোগ জানাতে পারলো না কারো বিরুদ্ধে। কারণ ওরা ভাষাহীন।
এক প্রতিবেদনে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানিয়েছিল যে আমেরিকায় অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারের প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুরতার ইতিহাস আছে। ১৯৯৭ সালে ‘নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও ম্যাসাচুসেটস সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেলস’ বিখ্যাত এক গবেষণা করেছিল। সেখানে তারা দেখিয়েছে যে প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ যারা করে, অন্য মানুষকে ক্ষতি করার আশঙ্কা তাদের পাঁচ গুণ বেশি। আমেরিকায় প্রায়ই স্কুলে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে মানুষ মারার ঘটনা ঘটে। এ রকম গুলি চালানো মানুষদের নিয়ে ২০১৩ সালে গবেষণাটি হয়েছিল। সেখানে পাওয়া গেল যে স্কুলে এ রকম গুলি চালানো ঘাতকদের ৪৩ শতাংশ কুকুর-বিড়ালকে মারধর করত। (প্রথম আলো)
এই যে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মরার চর্চা, কুকুর– বিড়ালের গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়ার প্রবণতা, ধারালো কিছু দিয়ে কোপ দেয়া, হাত-পা ভেঙে দেয়া বা খাবারে বিষ দিয়ে প্রাণি হত্যা সবই এক খাপে সাজানো। কাজেই ভুলে গেলে চলবে না যে প্রাণি হত্যাকারী মানুষের হাত থেকে আপনি-আমি কেউই নিরাপদ নই।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/এএসএম