মতামত

ঢাকা পুরো বাংলাদেশ নয়

সিনেমার নামটি মনে নেই; তবে গানটির প্রথম কলি আবছা মনে আছে – ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’ । সিনেমাটির কোনো এক দৃশ্যে দেখা যায় নায়ক-নায়িকা ঢাকায় এসে আনন্দে উদ্বেলিত, সাততলার ওপরে ঘর বানাবেন, রেশমি চুরি কিনবেন ইত্যাদি ইত্যাদি নেচেগেয়ে তোলপাড়। ঠিক তাই । এক সময় ঢাকায়, গানের কলিতে যদি বলি, ‘আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল আজ আশা নেই ভালোবাসা নেই...।’ তখনকার ঢাকা অনেকটাই ছিল ফাঁকা ; নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন তার শৈশবে ঢাকা দেখেছিলেন অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং ছোট জায়গা, যেখানে জীবন ছিল মধুর এবং ধীর। শ্রুতি আছে যে, সম্ভবত ১৯৯৯ সালে সেই সেন বলেছিলেন তিনি কাউকে ঢাকা শহরে এমনকি ফিটফাট গুলশান কিংবা বারিধারায়ও থাকতে সুপারিশ করবেন না ।

Advertisement

তিনি প্রকৃত কথাটা বলেছিলেন কি না নিশ্চিত নই; তবে বলে থাকলে কারণটি সহজেই অনুমেয়- বায়ুদূষণে বাংলাদেশের ঢাকা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। যেখানে সিসার স্তর সুপারিশ করা স্তরের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি; নর্দমায় পূর্ণ নালা, পথিক পথ হারিয়েছে হোন্ডার দাপটে, যেন মরেও শান্তি নেই এখানে।

তারপরও ‘আশায় আশায় তবু এই আমি থাকি, যদি আসে কোনো দিন সেই সুখ পাখি’ – বলে ছুটছে মানুষ ঢাকায় বাস করতে যদি না নাগরিক সুবিধা পৌঁছে গ্রামে। আর তার জন্য চাই পরিকল্পিত নগর বিস্তৃতি ও উন্নয়ন। যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি, তত দ্রুতই মঙ্গল।

অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, অর্থাৎ স্বাধীনতার শুভলগ্নে, ঢাকা ছিল গাছগাছালিতে ঢাকা মোটামুটি মধ্যম সাইজের ছিমছাম একটা শহর। কার্জন হল সংলগ্ন দোয়েল চত্বর থেকে তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর হয়ে মহাখালী পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছের পল্লবিত শাখার ছায়া পথিকের প্রশান্তি এনে দিত। অন্য জায়গায় এর ব্যতিক্রম ছিল না। খাল ছিল বেশ কটা, সহনীয় মাত্রায় নালা-নর্দমা , বুড়িগঙ্গায় পরিষ্কার পানিপ্রবাহ। তখনকার ১৬ লাখ মানুষের এই শহরটিতে রিকশা ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক কম, তবে সাইকেল নেহাত কম নয়। বাস বলতে ‘মুড়ির টিন ‘, ঘোড়ার গাড়ির শব্দ নবাবী আমলের নিদর্শন; অক্সিজেনের প্রবাহ অবারিত। তাছাড়া, আফসান চৌধুরীর বর্ণনায়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র মাত্র পাঁচ টাকায় দিনাতিপাত করতে পারতো। এক টাকার বাস টিকিটে প্রায় সব জায়গায় যাওয়া-আসা, এক প্যাকেট স্টার সিগারেট দেড় টাকা, এক প্যাকেট বিরিয়ানি এক টাকা , এক কাপ চা পঞ্চাশ পয়সা। বাকি টাকায় বাসায় ফেরা এবং এর মধ্যে রাজনীতি ও স্বপ্ন দিয়ে উদরপূর্তি’ (আফসান চৌধুরী , সত্তরের ঢাকা)।

Advertisement

দুই.গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশে যেমন অভাবনীয় পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা যায়, তেমনি পরিবর্তন এসেছে এর রাজধানী ঢাকার বেলায়ও। বাংলাদেশের রাজধানী এখন পৃথিবীর দ্রুততম গড়ে ওঠা মেগা সিটি– জনসংখ্যা আড়াই কোটি ছুঁইছুঁই, প্রতি বছর বাড়ছে প্রায় চার শতাংশ হারে, এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস করে! গাছ কেটে, নালা, নদী খাল দখলে নিয়ে প্রবৃদ্ধির প্রমত্ত জোয়ারে গা ভাসায় ঢাকা শহর । রুডইয়ার্ড কিপলিং কলকাতা শহরকে ‘ভয়ংকর রাত্রির শহর’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন । বর্তমান ঢাকা শহরকে কীভাবে দেখতেন তা অজানা হলেও অকল্পনীয় নয়।

কথায় বলে, ‘মুখে মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ – বোটম আপ প্ল্যানিং মুখে মুখে কিন্তু তলে তলে টপডাউন পদ্ধতিতে প্রশাসন চলে আসছে অনাদিকাল থেকে। যেমনি অল রোডস লিড টু রোম , বাংলাদেশে ঠিক তেমনি অল রোডস লিড টু ঢাকা। বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাইকেল লিপটনের ভাষায় একে বলে ‘আরবান বায়াস ডেভেলপমেন্ট’। প্রতিদিন নাকি ২০০০ মানুষ ঢাকায় ঢুকে সুখের সন্ধানে। কুড়িল বস্তির এক নারীর কথায় , ‘ঢাকা ভালো লাগে না তবে স্বপ্ন আছে গ্রামে গিয়া এক খণ্ড জমি কিনবাম।’ ঢাকা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহরগুলোর একটি, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় । বিশ্বব্যাংক বলছে, মেগাসিটিগুলোর মধ্যে দেড় কোটি মানুষ সমেত ঢাকার বিশেষত্ব হচ্ছে দ্রুততম বর্ধনশীল– ১৯৯০ এবং ২০০৫ সালের মধ্যে শহরের আকৃতি দ্বিগুণ ৬ থেকে ১২ মিলিয়ন; ২০২৫ সালের মধ্যে দুই কোটিরও বেশি মানুষ নিয়ে ঢাকা মেক্সিকো, বেইজিং কিংবা সাংহাইয়ের চেয়ে বড় হবে। সবই সুখবর যেন ওই গানটির কথার মতো, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে, আরে লাল লাল নীল নীল বাতি দেইখ্যা নয়ন জুরাইছে …।’

তিন.তবে এখন ওই গান কেউ গায় বলে মনে হয় না। ‘ওভার ক্রাউডেড’ ঢাকার বেলায়, সব ভালো ভালো নয় । এখনকার ঢাকা শুধু জনবহুল নয়, ব্যয়বহুলও বটে। বাংলাদেশে মোট নগরবাসীর এক-তৃতীয়াংশের বসত ঢাকায়, অন্যান্য বড় শহর মিলিয়ে চার ভাগের ভাগিদার। গত ১০-১২ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। ঢাকা অতিরিক্তভাবে বেড়ে ওঠার কারণে বাংলাদেশ জিডিপির এক-দশমাংশ হারাচ্ছে বলে গবেষকদের ধারণা। এক হিসাবে, ঢাকায় সম্পদ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অতি মাত্রায় কেন্দ্রীকরণের কারণে ২০১৭ সালে মাথাপিছু আয় ও জিডিপি সম্ভাব্যতার চেয়ে ১১ শতাংশ কম হয়েছিল। মূলত একই কারণে ২০১৯ সালে জিডিপি ৩৫ বিলিয়ন ডলার কম হয়। আর ঢাকার আকৃতি সবচেয়ে অনুকূল অবস্থা অতিক্রান্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ হারাচ্ছে তার জিডিপির ৬-১০ শতাংশ । ঢাকার এই ‘অতিবৃদ্ধি’ সার্বিক নগর দারিদ্র্য হ্রাসের হার তাৎপর্যপূর্ণভাবে শ্লথ করেছে যেখানে গ্রামীণ দারিদ্র্য কমেছে সন্তোষজনক হারে। ট্রাফিকজটের কারণে জিডিপির প্রায় তিন শতাংশ হারিয়ে যায়। পরিবেশজনিত কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি ধরলে ব্যয় আরও বিশাল এবং তা ঢাকার অতি জনাকীর্ণতার কারণে।

চার.অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুঞ্জীভুবনের পেছনে প্রায়শ কাজ করে দক্ষ বাজার শক্তি, রিটারনস টু স্কেল, এগলোমারেসন অর্থনীতি, স্থানীয়করণ এবং নগরায়ণ– সব মিলে সৃষ্টি করে নগর-কেন্দ্র এবং শহর। নিঃসন্দেহে এসব উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও সীমার বাইরে অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণেরর কুফল যে আছে তা দিবালোকের মতোই সত্য ঘটনা। তত্ত্ব বলে, শহরের একটা চূড়ান্ত আকৃতি থাকে তারপর, ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির মতো, উৎপাদন মাত্রার অর্থনৈতিক অসুবিধা এবং নেতিবাচক বহিস্থ প্রভাবে খরচ বাড়ে– যেমন গাদাগাদি অবস্থা এবং দূষণের খরচ। ফলে স্কেল ও এগলোমারেসনের সুবিধা টপকে অসুবিধা জায়গা দখল করে। সম্ভবত এ কারণেই শহরগুলো সীমাহীনভাবে বাড়তে পারে না। তা ছাড়া, প্রাইমেটের (সবচেয়ে বড় শহর ) অতি বৃদ্ধি অন্য শহরের বৃদ্ধির ভিত্তি দুর্বল করতে পারে। অতিমাত্রায় শহর বিস্তৃতির ব্যাখ্যা সবার জানা– বাজারের ব্যর্থতার সুযোগে ভারী বিনিয়োগ, স্থির খরচ ও এক্সটারনেলেটিজ, নেটওয়ার্ক প্রভাব এবং গুণার মিরডেলের বৃত্তাকারে ক্রম বর্ধমান সংগঠন ( Circular cumulative causation) ইত্যাদি ইকনমিজ অফ স্কেল পাইয়ে দিতে অবদান রাখে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি প্রাইমেট শহর /অঞ্চল পছন্দ করে- ‘ঈশ্বর বাস করেন ওই ভদ্র পল্লিতে ‘ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় )। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে যা সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা নাও হতে পারে এবং সে জন্যই সংশোধনক্ষম ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

Advertisement

ইকোনমিক জিওগ্রাফি বিষয়ক দুটো প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয় – এক. দরিদ্র জেলাগুলোতে দারিদ্র্যের প্রকোপ অপেক্ষাকৃত বেশি; দুই. প্রবৃদ্ধির জন্য টেকসই শহর উন্নয়ন জরুরি বিশেষত এর গুণগত মান। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশের চিন্তা হওয়া উচিত মানসম্মত নগর শুধুই নগর নয়। যেন বলতে না হয়, ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, লহ এই নগর। যেমন, উড়োজাহাজে বসে রাতের বেলায় জানালায় উঁকি মেরে দেখি বাংলাদেশ অন্ধকারে ডুবে আছে, হ্যারিকেনের মতো মিট মিট আলোতে কিছু শহর আর একমাত্র ঢাকা শহরের যত কাছাকাছি ততই আলোর হাতছানি।

ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড বা অন্য কোথাও দেশের ভেতর প্লেন ঢুকলে আলোর ঝলকানি বিস্তৃত শহর থেকে শহরে। ঢাকা শহর ১৬ কোটি মানুষের দেশে সবচেয়ে বড় শহর; মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ( প্রায় এক তৃতীয়াংশ ) ধারণ করে। এই দেশে ১০ লাখের ওপর মানুষ নিয়ে আছে মাত্র চারটা শহর অথচ এমন শহর ভিয়েতনামে ৭, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪, ভারতে ৫৪, চিনে ১০২ এমনকি পাকিস্তানে ১৪টি। বুঝতে বাকি থাকে না যে বাংলাদেশে নগর বলতে একমাত্র ঢাকা-ই। এই দেশে ১০ লাখের ওপর মানুষ নিয়ে আছে মাত্র চারটা শহর অথচ এমন শহর ভিয়েতনামে ৭, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪, ভারতে ৫৪, চিনে ১০২ এমনকি পাকিস্তানে ১৪টি ।

পাঁচ .তা মোটেও ঠিক নয়, বলছেন গবেষকরা। দেশের অন্য শহর ও অঞ্চল উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া বিশেষত চিটাগাং বাণিজ্যিক শহরকে প্রাধান্য দেওয়া; গণসেবা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নীত করা, শহর-সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা, শহরের কৃতিত্ব পরিমাপ, তথ্য ও গবেষণা বৃদ্ধিকল্পে আরও বিনিয়োগ ইত্যাদি শুধু সময়ের দাবি ।

বাংলাদেশের ৩৪০টা শহর ও পৌরসভার পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা ঢাকায় থেকে ৩৫টি উন্নয়ন সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না, আজও নেই। এসব সরকারি দফতর ঢাকায় ভিড় না বাড়িয়ে বিকেন্দ্রীকরণের ছাতায় ঢাকার বাইরে অন্য শহরে স্থানান্তর করা উচিত।

মোটকথা, ঢাকা সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না । মুখ দেখে শরীর চেনা যায় না বহু পূর্বে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; পল সেমুয়েলসন তাঁর ‘ইকোনমিক্স’ বইয়ের সূচনায় ফ্যালাসি অফ কম্পোজিশনের উদাহরণ টানতে গিয়ে প্রায় একই কথা বলেছেন– শরীরের একটা অংশ পুরো অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

তারপরও ‘আশায় আশায় তবু এই আমি থাকি, যদি আসে কোনো দিন সেই সুখ পাখি’ – বলে ছুটছে মানুষ ঢাকায় বাস করতে যদি না নাগরিক সুবিধা পৌঁছে গ্রামে। আর তার জন্য চাই পরিকল্পিত নগর বিস্তৃতি ও উন্নয়ন। যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি, তত দ্রুতই মঙ্গল।

ঢাকা শহর আইসা আমার আক্কেল হইয়াছে... গানটা কেমন লাগে?

লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কলাম লেখক।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস