অলোক আচার্য
Advertisement
অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়ে এখন প্রায় অর্ধেক সময় পেরিয়ে এসেছে। প্রতি বছরই এই যে বইমেলার আয়োজন হয় এবং ঘটা করে লেখক, প্রকাশকরা অপেক্ষা করে থাকেন দুটো বই বিক্রি হবে, জনপ্রিয় লেখকের দলে নাম লেখাবেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় বইমেলা ভাইরাল লেখকের দখলে, টিকটকারদের দখলে চলে গেছে। সুস্থ ধারার লেখকরা কোণঠাসা হয়ে মুখ লুকাচ্ছেন। ফেসবুকে লেখা টিকটকার লেখক-কবির বই দেদার বিক্রি হচ্ছে। এর মানে হলো আমাদের সংস্কৃতি বেহাত হয়ে গেছে। আমাদের সাহিত্য নষ্টদের দখলে চলে গেছে।
এমনিতেই বইমেলায় বইয়ের চেয়ে খাওয়ার জিনিস বিক্রি হয় বেশি। এখন আবার বইমেলা মানে অসংখ্য টিকটকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের লক্ষ্য পেজের ভিউ বাড়ানো। অসহায় লেখকেরা সেসব দেখেন আর মুখ লুকানোর জায়গা খোঁজেন। বছর বছর বইমেলার চিত্র দেখে বলে দিতে কষ্ট হয় না, আমাদের সাহিত্য হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সাহিত্যচর্চার গতি এখন নষ্টের দিকে। তবুও কেউ কেউ বছরব্যাপী লেখালেখি করেন। বছর শেষে একটা-দুটা বই প্রকাশ করেন। কিন্তু বিক্রি হয় খুব কম। প্রকাশকরাও হতাশ হন।
বছর বছর মেলায় যে মানহীন বই প্রকাশের হার বাড়ছে, সেটা সবারই জানা। তবুও কিন্তু মানহীন বই বিক্রি হচ্ছে। পাঠক কিনছেন, পড়ছেনও। এখন যেন বইমেলা একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। প্রতি বছর স্টল বাড়ছে। প্রকাশক বাড়ছে। বইয়ের পাহাড় আসছে। কত প্রকাশনীর কত রকম অফার চলছে। এভাবেও যদি বলি, মানহীন পাঠকের মানহীন বইয়ের মেলা সেটাও মনে হয় অত্যুক্তি হয় না। দেখতে দেখতে একটি মাস পেরিয়ে যায়। শেষ হয় অমর একুশে বইমেলা।
Advertisement
বইমেলার কারণেও ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি মানেই রাজধানীতে বইয়ের উৎসব। চারিদিকে নতুন বইয়ের গন্ধ ভাসে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে এটি আর এখন কেবল একটি মেলা নয়। অনেক বইপ্রেমী সারাবছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাস এবং বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন।
যতই দিন যাচ্ছে; ততই জমে উঠছে। বাঙালির প্রাণের বইমেলা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের মহা মিলনমেলায় রূপ নেয়। আত্মার সঙ্গে আত্মার যেমন সম্পর্ক; তেমনই বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক। সাহিত্য হলো দেশের মননশীলতার প্রাণ। আর সাহিত্যচর্চার এবং বিকাশের অন্যতম কেন্দ্র হলো বইমেলা। মননশীলতা শব্দটি যে মাত্রার ভার বহন করে, বইমেলায় সেই মাত্রার সাহিত্যচর্চা এখন আর হচ্ছে না। ফলে মননশীলতা অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও বইমেলা মানে লেখক ও পাঠকের মিলনমেলা।
আরও পড়ুন পাওয়া যাচ্ছে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘বিষণ্ন সন্ধ্যা কিংবা বিভ্রম’ বইমেলায় শফিক হাসানের ভ্রমণগ্রন্থ ‘দেখি বাংলার মুখ’বইপ্রেমীরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য। এর মানে বই কেনার জন্য কম বরং নতুন বই প্রকাশের জন্য। নতুন বই নতুন লেখক-কবির মিলনস্থল এ বইমেলা। পুরাতন পাঠকদের সাথে যোগ হয় নতুন প্রজন্মের বই পড়ুয়া পাঠকেরা। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এবারের বইমেলা আমাদের কি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে? একটু চোখ মেললেই দেখা যাবে, আমাদের বইমেলা বেহাত হয়ে গেছে। শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র বলে যে সুনাম ছিল; সেটি হারিয়ে যেতে বসেছে। যোগ্যদের হাত ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আমরা মোটামুটিভাবে হাত গুটিয়ে বসে আছি। দেখছি কতদূর যায়! অথবা আমাদের কিছুই করার নেই।
এখানেও গিলে ফেলেছে অপসংস্কৃতির চর্চা। এখানেও গ্রাস করেছে রাহুর কালো ছায়া। যেসব লেখক সারাবছর দেশের উল্লেখযোগ্য পত্রপত্রিকার সাহিত্যপাতায় লেখেন এবং পাঠ করেন; সেসব লেখক-কবির কতজনের বই পাঠকরা লাইন ধরে কিনেছেন, বিষয়টি একটু খোঁজ নিলেই সব বোঝা যাবে? বেশিরভাগের বই বিক্রির অবস্থা আশানুরূপ নয়। তা স্বীকার করি আর না করি! প্রকাশকের মুখ দেখলেই বোঝা যায়। কেউ কেউ নিজ দায়িত্ব নিয়েই কিছু বই বিক্রি করে দিচ্ছেন! এখানেও লেখক বেচারা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। তিনি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে নিজেই কিনে নিচ্ছেন। তারপর সেসব নানা অজুহাতে বিলি করছেন বিনা মূল্যে।
Advertisement
বই প্রকাশ একটি লস প্রজেক্ট! কারণ প্রকাশক তো আর সব লোকসান দেবেন না। দৈনিক পত্রপত্রিকায়ও আসছে, এবার মূলধারার চেয়ে মূলধারার বাইরের লেখকের বইয়ের চাহিদাই বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটা নিয়ে ট্রল হচ্ছে। এটা কার দোষ? আদতে কারো না। আবার সবারই। সংস্কৃতির প্রায় সবগুলো ক্ষেত্র নষ্ট করে বইমেলা যে এর বাইরে থাকবে, সেই আশা করছি। দুরাশা ছাড়া কিছুই না। একটার সাথে আরেকটা রিলেটেড। একটা নষ্ট হলে অন্যটাও নষ্ট হবে। সেটাই হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম যেখানে টিকটক ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না, পড়া বলতে চ্যাট বোঝায়; সেখানে বইয়ের পাতায় ধরে রাখার চেষ্টা করা বোকামি। যারা নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করছেন, লিখছেন বিভিন্ন সাহিত্যপাতায় বা লিটল ম্যাগে; সেগুলোই মূলধারা। বিপরীতে যারা সোশাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়েই কাজ সারছেন বা কবিতা লিখছেন বা অন্যকিছু; সেসব মূলধারার বাইরে। তবে সেখানেও কিন্তু পাঠক আছেন। তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এভাবে চলতে থাকলে সাহিত্যও তার জায়গা থেকে সরে যাবে। মুখ থুবড়ে পরবে। দেশে পাঠকের সংখ্যা কমছে। বইমেলায় ক্রেতা থাকেন হাতেগোনা। দর্শকই বেশি। ফলে বইমেলা যদি ভাইরালদের দখলে চলে যায়, তাহলে লেখালেখির বারোটা বাজবে। অলরেডি বেজে গেছে। সে বিষয়ে অনেকেই একমত হবেন। কেউ কেউ পরের বার বইমেলার আগে ভাইরাল লেখক কিভাবে হওয়া যায়, সে নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় ব্যস্ত! সেটা না করেই বা কী হবে? যারা মৌসুমি প্রকাশক নন, তারা এসব উঠতি সম্ভাবনাময় লেখকের বই প্রকাশ করেন। দিন শেষে যদি তাদের বই বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তুলতে না পারেন, তাহলে বই প্রকাশ করবেন কেন? এটা তো তাদের রোজগারের বিষয়।
ভাইরাল লেখক, ভাইরাল প্রকাশক এবং মেলা! এসব না হলে আজকাল বই চলে না! সোজা বাংলায় বললে, পাঠক খায় না! পাঠককে বই পড়ানো না, খাওয়াতে হয় আজকাল! গত কয়েক বছরে এমন কোনো লেখক পাঠকমহলে সাড়া ফেলতে পারেননি, যার বইয়ের টানে পাঠক ছুটে আসেন। যার বইয়ের খোঁজ সারাবছর নেন পাঠকেরা। অনেক লেখক-কবি প্রতি বছর বই বের করেন। তারা কোনো পাঠকশ্রেণি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ। নিজের বই নিজেকে বহু কষ্টে বিক্রি করতে হচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকজন পাঠক টানতে পারছেন। তাই সাহিত্যের মান রক্ষা করাটা জরুরি। সময় থাকতে সাবধান হোন। না হলে এর পচন থেকে বাঁচা মুশকিল।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএসএম