শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর সমুদ্রবন্দরে দ্য পাইলট টাওয়ারে দাঁড়ালেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতার একটি স্পষ্ট চিত্র লক্ষ্য করা যায়। বন্দর কর্মকর্তাদের মতে, এর একদিকে রয়েছে ভারত ও চীনের যুদ্ধজাহাজ নোঙর করার জায়গা। অন্যদিকে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের আওতায় নির্মিত কনটেইনার টার্মিনাল। আর পাশেই ভারতীয় আদানি গ্রুপের নির্মাণাধীন আরেকটি টার্মিনাল, যা ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছিল।
Advertisement
এই প্রকল্পকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর কৌশল হিসেবে দেখা হয়েছিল। এগুলো ছাড়াও ভারত করোনাকালীন সহায়তা, চীনের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজের অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছিল।
আরও পড়ুন>>
‘পরিবর্তিত’ বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা কেন কলকাতার বাঙালিদের? এবার সীমান্ত সম্মেলনে ভারতের সঙ্গে কথার ‘টোনটা’ আলাদা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের ইজতেমা থেকে ফেরার পথে নিজ দেশে হেনস্তার শিকার ভারতীয় ছাত্রতবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কৌশল কতটা সফল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত দেড় বছরে বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় ভারতপন্থি সরকারগুলো ক্ষমতা হারিয়েছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে।
Advertisement
এছাড়া, আদানি গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রকল্পও নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতির অভিযোগে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির নাম আসা। যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গত ডিসেম্বরে আদানি গ্রুপ ঘোষণা দেয়, তারা কলম্বো বন্দরের প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ঋণ নেবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নেতারা ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কৌশল নিচ্ছেন। তবে ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতাও স্পষ্ট। ভারতের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। ২০১৪ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘প্রতিবেশী প্রথম ‘ নীতি গ্রহণ করলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশে ভারতের অবস্থান দুর্বল কেন?বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। পাকিস্তান বহু আগে চীনের ঘনিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার ভারতের মিত্র ছিল। ভারত তার ‘ক্রমবর্ধমান একনায়কতান্ত্রিক শাসন’কে উপেক্ষা করেছিল, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা আটকাতে লবিংও করেছিল। কিন্তু, ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে ভারতের কৌশল ব্যর্থ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতের প্রতি ক্ষোভ বেড়েছে।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে বিপুল আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, চীন এরই মধ্যে দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং আরও পাঁচ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আলোচনা চলছে। গত জানুয়ারিতে তার বেইজিং সফরে বেশ কিছু নতুন অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মোংলা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, যা আগে শেখ হাসিনার আমলে ভারত পেতে চেয়েছিল।
Advertisement
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সাধারণত যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার নীতি অনুসরণ করতো। মোদীর নেতৃত্বে ভারত অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেছে, যেমন শ্রীলঙ্কার ঋণ সংকটের সময় চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া। তবে, একই সঙ্গে শক্ত নীতিও অনুসরণ করেছে, যেমন- ২০১৫ সালে নেপালে অনানুষ্ঠানিক অবরোধ আরোপ করা।
তবে এখন এ কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট আনুরা কুমারা দিশানায়েকে প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে গেলেও তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছেন। গত জানুয়ারিতে তিনি চীনে গিয়ে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের তেল শোধনাগার প্রকল্পের জন্য চুক্তি করেছেন। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলিও চীনে গিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
আদানি গ্রুপের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাভারত চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আদানি গ্রুপের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি হয়, যা এখন নতুন সরকার পুনর্মূল্যায়ন করতে চাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় আদানি গ্রুপ বন্দর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প পেয়েছিল কোনো ধরনের উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই। সেটি এখন সমালোচনার মুখে। নেপালেও আদানি গ্রুপ একটি বিমানবন্দর নির্মাণ এবং আরও তিনটি পরিচালনার জন্য লবিং করছে।
ভারতের সামনে উপায় কী?বিশ্লেষকদের মতে, ভারতকে এখন নতুন কৌশল নিতে হবে। কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শিবশঙ্কর মেনন বলেন, বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা পুরোনো কৌশলেই আটকে আছি। তার মতে, ভারতকে পারস্পরিক লেনদেনের নীতির বদলে অর্থনৈতিক একীকরণে মনোযোগী হতে হবে।
আরেক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম শরণ মনে করেন, ভারতকে কূটনীতিক বাড়ানো এবং সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
যতদিন ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবে তা ঠিক করতে না পারছে, ততদিন প্রতিবেশীরা তাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনকেই বেছে নেবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/