মো. ইরফানুল হক বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক (২০২২ ব্যাচ) পদে চাকরি পেয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এর আগে তিনি এক্সিম ব্যাংকের ট্রেইনি অফিসার ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন। তার ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প ও নতুনদের পরার্মশ নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই— মো. ইরফানুল হক: পারিবারিক সূত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও বাবার তৎকালীন চাকরির কারণে আমার জন্ম নোয়াখালীর মাইজদি উপজেলায়। জন্মের অল্পদিন পরেই বাবা নতুন চাকরির জন্য কক্সবাজার শহরে পাড়ি দেন। চতুথ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা কক্সবাজারেই। তারপর স্থায়ীভাবে পরিবারসহ চট্টগ্রাম শহরে চলে আসি। ২০১০ সালে নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য শাখায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে এসএসসি পাস করি। ২০১২ সালে সরকারি কমার্স কলেজ চট্টগ্রাম থেকে বাণিজ্য শাখায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে এইচএসসি পাস করি। এরপরই ২০১৩ সালে ভর্তি হই আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ব্যবসায় অনুষদ বিভাগে। ২০১৭ সালে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিষয়ে প্রথম শ্রেণি নিয়ে বিবিএ পাস করি। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদ বিভাগের ফিন্যান্স বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমবিএ শেষ করি।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?মো. ইরফানুল হক: ছোটবেলায় আমি কক্সবাজার শহরে বেড়ে উঠেছি। এখানে প্রায়ই বাবার ব্যবসায়িক কাজে ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাওয়া হতো। তখন থেকেই তাদের কাজের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ জন্মায়। সেই সময় থেকেই আমার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল একটি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবো। একদিন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবো। আমার নিজ উদ্দীপনা, বাবা-মায়ের উৎসাহ এবং পরামর্শ এ স্বপ্নকে দৃঢ় করে তোলে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?মো. ইরফানুল হক: অনার্সের শেষ সেমিস্টারে একটি ব্যাংকে শিক্ষানবিশ থাকাকালীন সিদ্ধান্ত নিই, সরকারি চাকরিই হবে আমার ভবিষ্যতের পেশা। তবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। কীভাবে প্রস্তুতি নেবো, কোথা থেকে শুরু করবো; এ সবকিছুই তখন অনেক কঠিন মনে হচ্ছিল। এমবিএ করার মধ্য দিয়েই প্রস্তুতি নিতে থাকি। কোভিডের লকডাউনে প্রস্তুতি শাণিত করার ভালো সুযোগ পাই। ঢাকায় পরিবারসহ বসবাসের সুবাদে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ও অংশগ্রহণ করতে পরিবারের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ছিল।
Advertisement
প্রথমে সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্যাটার্ন বুঝতে শুরু করি। কোন পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন আসে, তার জন্য বিগত বছরের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করেছিলাম। প্রতিদিন সকালে সেদিনের একটি রুটিন তৈরি করতাম; যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় পড়তাম। প্রস্তুতির সময় সঠিক বই ও অনলাইন রিসোর্স খুঁজে বের করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। স্ট্যান্ডার্ড বই নির্বাচন, রিসেন্ট জেনারেল নলেজ এবং পত্রিকার সম্পাদকীয়, অর্থনীতি, বাণিজ্য অংশ পড়তে শুরু করি। সেই সঙ্গে অনলাইনে ভিডিও লেকচার এবং অন্যান্য কন্টেন্ট থেকে প্রস্তুতি নিতাম।
প্রতিদিন সকালে ও রাতে ঘুমানোর আগে গণিত চর্চা করতাম। দুপুরে পত্রিকা, সাধারণ জ্ঞান ও সাম্প্রতিক বিষয়গুলো পড়তাম। সন্ধ্যায় ইংরেজি গ্রামার এবং বাংলা ব্যাকরণ ও সাহিত্য চর্চা করতাম। সরকারি চাকরির পরীক্ষা মূলত তিন ধাপে হয়: প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক। প্রতিটি ধাপের জন্য আলাদা পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রিলিমিনারির জন্য গতিশীলতা এবং লিখিত পরীক্ষার জন্য গভীর জ্ঞান অপরিহার্য। আমি সময় ধরে প্রায় প্রতিদিন মক টেস্ট দিয়ে দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করতাম। শুধু কঠোর পরিশ্রম নয় বরং স্মার্ট স্টাডি করার দিকে মনোযোগ দিয়েছি। প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে সফলতার দেখা পেয়েছি।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি পাওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল?মো. ইরফানুল হক: যে মুহূর্তে খবর পেলাম; এটি একটা অবিশ্বাস্য মুহূর্ত! আমার হৃদয় আনন্দে নেচে উঠছিল। মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছিল, ‘অবশেষে, আমি পেরেছি।’ পরিবারের কাছে সুখবরটা শেয়ার করার সময় গলার শব্দে যেন উচ্ছ্বাস ঝরছিল। সেই মুহূর্তটা সত্যিই অমূল্য ছিল। এতদিনের রাতজাগা পরিশ্রম, স্টাডি প্ল্যান, ব্যর্থতার পর উঠে দাঁড়ানো—সবকিছু যেন সার্থক হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের অংশ হওয়া আমার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন গণিত ও ইংরেজির ওপর জোর দিয়েছি: আসাদ মাহমুদ শুভ বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেতে যা করবেনজাগো নিউজ: আড়াল থেকে সব সময় কারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?মো. ইরফানুল হক: সব সময়ই আমার মা-বাবা সহযোগিতা করেছেন। সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। নিজের ওপর বিশ্বাস কখনো কম হলেও মা-বাবা আমার ওপর বিশ্বাস করা ছাড়েননি। বন্ধুরা বিশেষ করে লুতফর কবির হৃদয় আমাকে সব সময় সহায়তা ও সাহস দিয়েছেন চলার পথে। মহান আল্লাহ্ তাআলা, আমার পরিবার এবং স্বজনদের কাছে সর্বদাই কৃতজ্ঞ থাকবো।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি পেতে নতুনরা কিভাবে প্রস্তুতি নেবেন?মো. ইরফানুল হক: প্রিপারেশনের পথটা আসলে সবার জন্য এক হয় না। একেক জনের পড়ার ধরন ও পরিধি একেক রকম হয়। বাংলা বিষয়ের জন্য ব্যাকরণ ও সাহিত্য দুটি অংশই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণের জন্য বাংলা ব্যাকরণ (নবম-দশম শ্রেণি), বাংলা সাহিত্যের ওপর বাজারের প্রচলিত যে কোনো বই এবং ফ্যাকাল্টি বেজড প্রশ্নব্যাংক থেকে অনুশীলন করুন।
ইংরেজি গ্রামারের জন্য ‘CLIFF’S TOEFL’ বইটি ভালোভাবে পড়া উচিত। এ বইয়ের গ্রামার অংশ এবং এক্সারসাইজ ও মিনিটেস্ট সম্পন্ন করতে হবে। ভোকাব্যুলারি অংশের জন্য বাজারে প্রচলিত মানসম্মত যে কোনো একটি বই সম্পূর্ণ শেষ করলে Synonyms, Antonyms, One word substitution, Analogy, Phrase & idioms, Correction ও Analogy এর ওপর ভালো প্রস্তুতি নেওয়া যায়। পাশাপাশি Barrons High Frequency Words-গুলো পড়বেন। বিশেষ করে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পূর্বে।
গণিত বিষয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিয়মিত অনুশীলন। বাজার হতে মানসম্মত যে কোনো একটি চাকরির পরীক্ষার গণিত বই এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে যত সম্ভব প্র্যাকটিস করবেন। বিশেষ করে GMATClub, Examveda, Brainly, Sawaal ওয়েবসাইটগুলো থেকে। ইউটিউব থেকেও গণিতের অনেক কৌশল চর্চা করতে পারেন।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ের ওপর বাজারে অনেক বইয়ের প্রচলন আছে। যে কোনো একটি বই নিয়ে চ্যাপ্টার ভিত্তিক প্রস্তুতি নিতে পারেন। সাধারণ জ্ঞান বিষয়ে ভিত্তি শক্ত করতে বাজারে প্রচলিত যে কোনো প্রকাশিত বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির বই অনুসরণ করতে পারেন। যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার সময় আগ্রহের সাথে এর পটভূমি ও ইতিহাস নিয়ে পড়বেন। পত্রিকা পড়ার অভ্যাস এখানে আপনার সহায়ক। কারণ পত্রিকা পড়লে সমসাময়িক সব বিষয়ে জ্ঞান রাখা যায়। লিখিত পরীক্ষার জন্য পত্রিকা থেকে প্রতিদিন এক প্যারা করে বাংলা থেকে ইংরেজি ও ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করুন। ফোকাস রাইটিংয়ের জন্য পত্রিকা পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বিজনেস, ইকোনমি, সম্পাদকীয়, মতামত সেকশনগুলো পড়বেন বিশেষ করে। পত্রিকার লেখার ধরন ও স্টাইল বোঝার চেষ্টা করবেন।
এ ছাড়া সাথে বাজারের প্রচলিত নামি যে কোনো বই নিয়েও চর্চা করতে পারেন। নিয়মিত লেখার অভ্যাস রাখতে হবে। Argumentive ধাচের লেখার জন্য আইইএলটিএসের Writing Task-2 এর ওপর একটি বই অথবা অনলাইনে প্রচলিত ওয়েবসাইটগুলো থেকে কিছু নমুনা দেখতে পারেন। এতে আপনার এ ধরনের লেখায় সমস্যা থাকবে না। ব্যাংক ও সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতা বর্তমানে অত্যন্ত তীব্র। এ পথে চলাকালীন অনেক সময় হতাশার সম্মুখীন হয়েছি। তবে আত্মবিশ্বাস হারাইনি কখনো। পড়ার মাঝে একঘেয়েমি ও ক্লান্তি এলে বিরতি নিয়ে নিজের শখের কাজ-কর্মে সময় দিন ও মনোবল দৃঢ় করুন।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মো. ইরফানুল হক: একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে চাই। যাতে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ পাই। পাশাপাশি আরও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছে আছে। এ ছাড়া আমার পরিবার, স্ত্রী পূর্ণী ও সদ্য জন্মানো মেয়ে ইরহার সাথে সময় উপভোগ করতে চাই।
এসইউ/জিকেএস