মতামত

সরকার কি সত্যিই কৃষি, কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভাবছে?

বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতির চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ। বাজার থেকে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্য কিনতে যখন সাধারণ মানুষের হাসফাঁস অবস্থা, তখন চলতি অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে একটিই কথা, সংসার চালানোই যেখানে কঠিন, সেখানে বাড়তি ভ্যাট যেন তাদের কাছে ‘গলার কাঁটা।

Advertisement

গত ৯ জানুয়ারি নতুন নির্দেশনায় ভ্যাট বৃদ্ধির কাতারে মানুষের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে খাবারের উৎস রান্নাঘরও বাদ যায়নি। এলপি গ্যাস, ওষুধ, মিষ্টি, পোশাক, ফ্রুট ড্রিংকস, বিস্কুট, সস, কেচাপ, আচারসহ বিভিন্ন কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে নতুন ভ্যাট বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে। তবে আন্দোলনের মুখে সরকার কয়েকটি পণ্যে বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার করলেও যারা প্রতিবাদ করতে এনবিআরের সামনে দাঁড়াতে পারেননি, তাদের ক্ষেত্রে বর্ধিত ভ্যাট এখনো বলবৎ রয়েছে। কৃষি ও কৃষকের সাথে জড়িত কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে ভুক্তভোগী খাতের একটি।

অর্থ উপদেষ্টার দাবি, যেসব পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে জনজীবনে কষ্ট বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দেশের মানুষের সংস্কৃতি যদি দেখি, গ্রামের চায়ের দোকান থেকে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ সকালটা এক কাপ চা, একটি বিস্কুট কিংবা কেক খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এখন যদি বিস্কুট ও কেকের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয় তবে সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেই নিম্ন আয়ের মানুষটি। আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন, তার বায়না হলো জুস ও ড্রিংকস কিনে দেওয়া কিংবা তার টিফিনে এক প্যাকেট বিস্কুট তুলে দেওয়া। এখন বাবা-মাকে তার চাহিদা পূরণ করতে হলে তাকে বাড়তি টাকা পকেট থেকে ব্যয় করতে হবে।

খাদ্যপণ্য উৎপাদকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের উচ্চ সুদ হার, ঋণপত্রে জটিলতা, ডলার বাজারে অস্থিরতাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যখন তাদের কঠিন অবস্থা সামাল দিতে হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভ্যাট বৃদ্ধির উদ্যোগে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। স্টেকহোল্ডারদের সাথে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ভ্যাট বৃদ্ধির এমন ঘটনা তারা আগে কখনো দেখেননি।

Advertisement

তাদের দাবি, বিগত দিনে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বরং মুনাফায় ছাড় ও পণ্যের পরিমাণে কিছুটা কমিয়ে বাজারে পণ্য সরবরাহ করেছেন তারা। তারপরও ভোক্তার ওপর চাপ দেওয়া হয়নি। এখন ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া কোনো উপায় নেই। পণ্যের দাম বাড়ালে ৫ টাকার পণ্য ৭ টাকা, ১০ টাকার পণ্য ১৩ টাকা করতে হবে। কিন্তু দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবিক অর্থে ৫ টাকার পণ্য ৭ টাকা কার্যকর করা খুব দুষ্কর। এক্ষেত্রে ৫ টাকার একটি কেক, বিস্কুট পণ্য তালিকা থেকে তাদের বাদ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। একজন ভ্যানচালক কিংবা দিনমজুরের কাছে ৫ টাকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকারের এমন উদ্যোগের ফলে ৫ থেকে ১০ টাকার একটি পণ্য তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমে তুলে ধরে বলেছেন তারা সরকারকে ২৫ টাকার একটি জুসে ৮ টাকা ভ্যাট দিচ্ছে, যা ভোক্তার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। ভাবা যায়, স্বল্প আয়ের দেশে মাত্র ২৫ টাকার পণ্যে ৮ টাকা ভ্যাট-ট্যাক্সের খড়্গ সরকার আপনার-আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের উৎস এ দেশের কৃষি ও কৃষক। ভ্যাট বৃদ্ধির উদ্যোগের সময় সরকার কি তাদের কথা একবারও ভেবেছে? দেশে প্রক্রিয়াজাতের অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০ শতাংশ কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে দেশে এখন পর্যন্ত মোট কৃষির মাত্র ১ শতাংশের একটু বেশি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হচ্ছে। ভরা মৌসুমে আম ও টমেটো একসময় কৃষক বিক্রি করতে না পেরে জমিতেই নষ্ট হতো। কৃষকদের পণ্য বিক্রি করতে না পেরে সড়কে পণ্য ফেলে প্রতিবাদের চিত্র প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখা মিলতো। কিন্তু ৯০ পরবর্তী সময়ে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশের পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। খাদ্যপণ্যের কোম্পানিগুলো সারাবছর আচার, চাটনি, টমেটো সস, পেস্ট, কেচাপসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির জন্য ভরা মৌসুমে বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য ক্রয় করে সংরক্ষণ করেন। তাতে ভরা মৌসুমে পণ্য বিক্রি না করতে পারার দুঃখ তাদের শেষ হতে শুরু করেছে। কিন্তু সরকারের ভ্যাট বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে তাদের ওপর।

ব্যবসায়ীদের দাবি, যদি ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে আমের জুস ও ড্রিংকস, আচার, চাটনি, টমেটো সস, পেস্ট, কেচাপসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায় তবে বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। তাতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল সংগ্রহ কমালে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন একজন আম, কলা কিংবা টমেটো চাষী।

Advertisement

সম্প্রতি নাটোর ও রাজশাহী জেলার টমেটো এবং আম চাষীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বর্ধিত ভ্যাট বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে বলে বেশ কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে। তাদের অভিযোগ, কৃষকদের কাছ থেকে টমেটো সংগ্রহ কমিয়েছেন উৎপাদনকারীরা। আগামীতে আম সংগ্রহ কমে যাবে বলেও কৃষকরা জানতে পেরেছেন। এতে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে সড়কে নেমেছেন। এরপরও কি অর্থ উপদেষ্টার কথা যুক্তিসংগত হবে যে ভ্যাট বৃদ্ধি জনজীবনে কষ্ট বাড়াবে না।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি বিভিন্ন পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে বিশাল ক্ষোভ ছিল। তাদের অভিযোগ, আগের সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে বিদেশে টাকা পাচার করেছে এবং দেশের অর্থনীতি ফাঁকা করেছে। তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখেনি। এতে দেশে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এ কারণে ছাত্র, শ্রমিক, জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে নেমেছে এবং আন্দোলন সফল করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তারা ভেবেছিল আগামী সরকার হয়তো তাদের পক্ষেই সব সিদ্ধান্ত নেবে এবং দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনবে। কিন্তু এ অন্তর্বর্তী সরকার সে পথে না হেঁটে বরং উল্টো পথে হাঁটলো। তাতেই জনতার পালস বুঝতে এ সরকার ব্যর্থ হচ্ছে কি না সেই আলোচনা এখন তুঙ্গে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করহার কম। কিন্তু কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে যাদের উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়, তাদের ভ্যাট হার আমাদের চেয়ে কম। খাদ্য সেক্টরে মালয়েশিয়ায় ভ্যাট হার শূন্য, থাইল্যান্ডে ৭, ভুটানে ৭ এবং ভিয়েতনামে ৮ শতাংশ। সেখানে আমরা ১৫ শতাংশ করেছি। অর্থাৎ তারা সবসময় ভোক্তা, কৃষক, নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রাধান্য দিয়েই করহার নির্ধারণ করেছে।

কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য দেশের শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি। পোশাকের পরই এ খাত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নামিদামি ব্র্যান্ডের বিক্রয় কেন্দ্রে ‘বাংলাদেশে তৈরি’ ট্যাগ লাগানো পোশাকের আধিক্য নতুন কিছু নয়। তবে সেখানে এখন বাংলাদেশের তৈরি খাদ্যপণ্যও শোভা পাচ্ছে।

এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের সুপারশপেও এখন ‘বাংলাদেশে তৈরি’ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ প্রচুর বেড়েছে। এসব বাজারে জুস, ড্রিংকস, বিস্কুট, সস, জেলিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বিশাল বাজার তৈরি হচ্ছে। করোনার পর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথমবার এই খাতের রপ্তানি এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের বছর সেটি বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। সেই ধারা মাঝে কিছুটা ছেদ পড়লেও এখন আবার তেজি ভাব ফিরে এসেছে। কিন্তু ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে স্থানীয়ভাবে যখন তাদের টিকে থাকতে সংগ্রাম করতে হবে তখন রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে তাদের চিন্তা করার খুব বেশি সুযোগ থাকবে না।

দেশের উন্নয়ন করতে হলে সরকারের আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দরকার সুন্দর করনীতি ও করজাল বৃদ্ধি করা। বর্তমানে দেশে ট্যাক্সের জন্য রেজিস্ট্রেশন আছে ১ কোটি ২০ লাখ লোকের। কিন্তু সরকার মাত্র ৪৪ লাখ লোকের কাছ থেকে রিটার্ন পাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় টিন আইডি আছে এমন বেশিরভাগ লোকই সরকার ঠিকমতো ট্যাক্স দিচ্ছে না।

এছাড়া দেশে অনেক ধনী মানুষ রয়েছেন যাদের কাছ থেকে সরকার আয় বাড়ানোর পথ তৈরি করতে পারে। কিংবা ট্যাক্স দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে এমন প্রচুর মানুষ কর নেটের বাইরে রয়েছে। কিন্তু সরকার দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা না করে সহজ পথ বেছে নিচ্ছে এবং ভ্যাটের বোঝা কৃষি, কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। সরকারের মনে হয় করনীতি নিয়ে প্রচুর কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সবসময় বিকল্প ভাবতে হবে। তবে কোনো ক্রমেই এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না যেখানে সরাসরি এদেশের কৃষি, কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষকে আঘাত করে এবং তাদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক