৫ বছর আগেও বাণিজ্যিকভাবে ফুল বাগান ছিল না পাবনা জেলায়। এখন কয়েক হেক্টর জমিতে করা হয়েছে বাণিজ্যিক ফুল বাগান। সবজি ও অন্যান্য চাষে দফায় দফায় লোকসানে পড়েন। তবে গোলাপ বাগানে ব্যাপক সফলতা মিলেছে টেবুনিয়ার ভজেন্দ্রপুরের তিন ভাইয়ের। ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে এ মাসে ৫ লাখ টাকার গোলাপ বিক্রির আশা তাদের।
Advertisement
জানা যায়, তিন ভাই খন্দকার শরিফুল আলম রানা, খন্দকার আশরাফুল হক শাহিন ও জাফরুল্লাহ। ভজেন্দ্রপুরে তাদের এ পৈতৃক জমিতে ছিল বাঁশঝাড়। অন্য জমিতে সবজি ও বিভিন্ন চাষাবাদ হতো। কোনোভাবেই নিজেদের ভাগ্য বদল সম্ভব হচ্ছিল না। উল্টো দফায় দফায় সবজি চাষে লোকসান গুনতে হয়েছে। এ অবস্থায় বড় ভাই শরিফুল আলম রানা গোলাপ বাগান করার পরামর্শ দেন। তিনি ঢাকায় দীর্ঘদিন নার্সারির সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকায় বাঁশঝাড় তুলে দিয়ে দেড় বিঘা জমিতে গোলাপ বাগান করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ভারত এবং দেশের যশোর ও সাভারসহ কয়েকটি অঞ্চল থেকে ১০ হাজার চারা এনে রোপণ করা হয়।
শুরুতেই ভালো উৎপাদন ও দামের কারণে আগ্রহ বাড়ে তিন ভাইয়ের। প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় ব্যাপক লাভ ও সফলতায় বেড়েছে বাগানের পরিসর। দেড় বিঘা জমি থেকে ৪ বিঘার তিনটি বাগানে রূপ নেয়। শুরুতে নিজেরা পরিচর্যা করলেও এখন সারাবছর কমপক্ষে ৫ জন করে শ্রমিক কাজ করেন। বাগানে জুমুলিয়া, বিউটি, ভার্গো ও বমবমসহ ৭ প্রজাতির গোলাপ আছে। এসব ফুল লাল, শেড পিংক, অরেঞ্জ, হলুদ ও সাদা রঙের।
বাগান দেখভাল ও বিপণনের দায়িত্বে থাকা ইউনুফ জানান, সারাবছরই গোলাপের কম-বেশি চাহিদা থাকে। বছরের সাধারণ সময়ে প্রতি মাসে গড়ে দেড় থেকে ২ লাখ টাকার গোলাপ বিক্রি হয়। মাসে খরচ হয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। নভেম্বরের শেষদিক থেকে গোলাপের চাহিদা বাড়তে থাকে, দামও বাড়ে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গোলাপের চাহিদা ব্যাপক। ফেব্রুয়ারি মাসে অসম্ভব চাহিদা। এজন্য এ মাসকে সামনে রেখে বাগানকে অতিরিক্ত যত্ন ও পরিচর্যাও করতে হয়।
Advertisement
তিনি জানান, সপ্তাহজুড়ে ১০০ পিস গোলাপের দাম ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে আছে। সামনে ভালোবাসা দিবস। তাই দু’একদিনের মধ্যে এর দাম বেড়ে প্রতি ১০০ পিস গোলাপ সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকবে। এদিক থেকে এ মাসে ৪-৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন।
আরও পড়ুন লবণাক্ত জমিতে সবজি চাষে অর্থনৈতিক বিপ্লব পুঁইশাক চাষে সফল সুফিয়া, আগ্রহী অন্যরাওবাগানে কাজ করতে এসেছেন বাগান মালিক খন্দকার শরিফুল আলম রানার ছেলে সাকিব। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিতই বাবা-চাচাদের সঙ্গে গোলাপ বাগানের কাজে সহযোগিতা করেন। তিনি বলেন, ‘একদিন পর পর ফুল তোলা হয়। শীতকালে আড়াই থেকে ৪ হাজার পিস ফুল ওঠে। সবচেয়ে ঢাল সিজনেও ১২০০ থেকে ১৫০০ পিস ফুল ওঠে। ভালোবাসা দিবসসহ ফেব্রুয়ারি মাসে নানা দিবস থাকায় ফুলের চাহিদা বেড়েছে। বাগানে কাজের ব্যস্ততাও বেড়েছে।’
এ পর্যন্ত পোকামাকড় বা রোগবালাইয়ের আক্রমণ না হওয়ায় ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছেন বাগান মালিকরা। এতে আগ্রহ বাড়ায় সম্প্রসারণ ঘটছে বাগানের। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। বাগান যেন শ্রমজীবীদের জন্যও আশির্বাদ হয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে বাগান শ্রমিক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সবকিছুই এখন মেশিনের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এজন্য লেবারের দরকার কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে এসব বাগান হওয়ায় আমাদের কাজের সুযোগ বেড়েছে। মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। বাগানে একদিন পর পর গোলাপ কাটি, মাঝে মাঝে মাটি আলগা করা, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, সেচ দেওয়া ও কুড়ি কাটাসহ পরিচর্যামূলক সব কাজ করি।’
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, বছর পাঁচেক আগেও জেলায় তেমন বাণিজ্যিক ফুল বাগান ছিল না। গত কয়েক বছরে ফুল বাগান বেড়েছে। পাবনা সদর, সুজানগর, চাটমোহর ও আটঘরিয়াসহ কয়েকটি উপজেলায় গোলাপ বাগান বেশি হচ্ছে। তাদের সাফল্যে আগ্রহী হয়ে অন্য উপজেলায়ও বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে জেলায় ১২ হেক্টর জমিতে ফুল বাগান হয়েছে। এর মধ্যে ২ হেক্টরে গোলাপ বাগান আছে। সময়ের সঙ্গে পরিমাণও বাড়ছে।
Advertisement
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘কয়েকটি উপজেলায় প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক গোলাপ চাষ শুরু হয়েছে। তারা ভালো লাভবানও হচ্ছেন। প্রতি একর জমিতে প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভের মুখ দেখছেন। এ কারণে অনেকেই গোলাপ চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ একে দারুণ ইতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখছে। এ ক্ষেত্রে মাঠকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। তারা মাঠপর্যায়ে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। ভজেন্দ্রপুরের তিন ভাইয়ের মতো অন্যরাও গোলাপ চাষে ব্যাপক সফলতার মুখ দেখবেন।’
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসইউ/জিকেএস