দেশজুড়ে

যুদ্ধে গিয়ে শ্যালক নিহত, দেশে ফিরতে ভগ্নিপতির আকুতি

‘আমাকে যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকে আমাকেও যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি যুদ্ধ জানি না। কবীরতো যুদ্ধে মারা গেছে, আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারবো কি না জানি না। তোমরা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। না হলে আমি মরেই যাবো।’

Advertisement

চারদিন আগে স্ত্রীর কাছে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো জানান রহমত আলী। এরপর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না পরিবার। দালালের মাধ্যমে একসঙ্গে রাশিয়ায় গিয়ে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন রহমতের শ্যালক হুমায়ুন কবির। এখন তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবারের সবাই।

বিভিন্ন কারখানা ও ক্যান্টনমেন্টে মালি বা বাবুর্চির কাজ দেওয়ার কথা বলে তরুণদের রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাচ্ছে ঢাকা ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লি. নামে একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান। সেখানে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে।

সংসারে সচ্ছলতা আর সন্তানদের ভবিষ্যতের আশায় রাশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামের হুমায়ুন কবির ও তার ভগ্নিপতি রহমত আলী। কিন্তু সেখানে চাকরির নামে তাদের পাঠানো হয় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন হুমায়ুন কবির। এখন দেশে ফিরতে চান তার ভগ্নিপতি রহমত আলী।

Advertisement

শনিবার সকালে সিংড়া উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে জেলার আদর্শ গ্রাম হিসেবে পরিচিত হুলহুলিয়া গ্রামের কবির হুমায়ুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া। ছাপড়া ঘরের বারান্দায় বসে আছেন মা, মেয়ে ও পুত্রবধূ। তাদের কোলে ৩ বছরের সন্তান নাদিয়া আফরিন ও এক বছর তিন মাস মাস বয়সে সন্তান ওয়াজিয়া প্রীতি। পুরো বাড়িতে দারিদ্র্যের ছাপ। একটি টিনের ছাপড়া ঘর ও একটি ইট দিয়ে প্লাস্টারবিহীন ঘর। এরমধ্যে তাদের পাঁচ জনের বসবাস।

একমাত্র ছেলের মৃত্যু আর জামাইকে ফিরে পেতে অসহায় কারিমুন বেগমের চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘ছেলেকেতো হারিয়েছি, জামাইকেও জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে। মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ পাঁচ জনের সংসার কী করে চলবে ভেবে পাচ্ছি না। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। বুক ফেটে কান্না এলেও তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা কর করছি।’

তিনি বলেন, ‘যারা প্রতারণা করে আমার ছেলে এবং জামাইকে বিদেশে পাঠালো, ছেলেটা মারা গেলো, আমি তাদের বিচার চাই। সরকারের কাছে দাবি জানাই, সন্তানের মরদেহ এবং আমার জামাইকে যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।’

Advertisement

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী তারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমারতো সব শেষ, আমি শেষবারের মতো তার মুখ দেখতে পারবো কি না জানি না। এক বছর তিন মাস বয়সী মেয়ে অজিয়া প্রীতিসহ পাঁচ সদস্যের দিন কাটবে কীভাবে জানি না। আপনাদের কাছে আমার দাবি, আমি যেন স্বামীর মরদেহ চোখে দেখতে পাই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের জমি-জমা বলতে তো আর কিছু নেই, আমরা চলবো কী করে, কী খাবো? আমার সন্তান কীভাবে বাঁচবে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার দু’চোখে কেবলই অন্ধকার। আপনাদের কাছে আমার দাবি আমরা যেন দালালের বিচার পাই এবং আমার মতো আর কোনো মেয়েকে স্বামীহারা অথবা আর কোনো শিশুকে যেন বাবাহারা হতে না হয়।’

যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো রহমত আলীন স্ত্রী যমুনা খাতুন তার তিন বছরের মেয়ে নাদিয়া আফরিনকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, চারদিন ধরে তার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই। আমার মেয়েটা তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কান্নাকাটি করে। কিন্তু কী করে ওকে বলবো তার বাবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না। আমার একটাই দাবি, দালালরা প্রতারণা করে আমার স্বামী ও ভাইয়ের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে বিদেশ পাঠানোর নাম করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে। তাদের যেন বিচার করা হয়।’

যমুনা খাতুন বলেন, ভাই ও আমার স্বামী ভাগ্য ফেরানোর জন্য পৈতৃক ৫ বিঘা সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ১৮ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন দালালের হাতে। তারা সৌদি আরবে এক মাস রেখে রাশিয়ায় বিক্রি করে দেয়। সেখানে তাদেরকে দিয়ে জোর করে যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়াসহ আমার ভাইকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। চার দিন আগে ফোনে কাঁদতে কাঁদতে স্বামী বলেন, ‘আমাকে ১৫ দিনের যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল থেকে আমাকেও যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি যুদ্ধ জানি না। কবীরতো যুদ্ধে মারা গেছে, আমি বেঁচে ফিরে আসতে পারবো কি না জানি না। তোমরা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। না হলে আমি মরেই যাবো।’

যমুনার ভগ্নিপতি দুলাল তালুকদার বলেন, হুলহুলিয়া গ্রামের সাইপ্রাসে চাকরি করা সাখাওয়াত হোসেন ওরফে জয়ন তাদেরকে সাইপ্রাসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আড়াই লাখ টাকা নেন। পরে তিনি তাদেরকে সাইপ্রাসে নিতে না পারায় ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লি. এর পরিচালক নারায়ণগঞ্জের হাসান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি মাসে আড়াই লাখ টাকা বেতনের চাকরির কথা বলে দুজনের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণা করে রাশিয়ার কাছে বিক্রি করে দেন।

দুলাল তালুকদার বলেন, তাদেরকে এক মাসের ভিসায় সৌদি আরবে নেওয়ার পর রাশিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর যুদ্ধে তার শ্যালক কবীর নিহত হন। রহমত আলী ফোন করে চারদিন আগে জানান, তাকেও যুদ্ধে পাঠানো হবে। মাত্র ১৫ দিনের ট্রেনিং দিয়ে তার হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধে পাঠালে তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। তাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আকুতি জানান তিনি।

তিনি বলেন, এরপর রহমতের ছেলে দুর্জয়কে ঢাকায় ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লি. এর অফিসে পাঠিয়েছিলাম। প্রথম দিন কথা হয় তখন তারা রহমত আলীকে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন। এরপর থেকে তাদের অফিসে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। দালাল হাসান আলী আমাদের আশ্বাস দিলেও এখন আর ঠিকমতো ফোন ধরে না। আমরা কী করবো বুঝতে পারছি না। আমি সরকারের কাছে বিচার চাই।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল হক মন্ডল বলেন, আমাদের গ্রামের দুটি ছেলে বিদেশে গিয়ে একজন মারা গেছে। এটি খুবই দুঃখজনক। যে দালাল চক্র এই অন্যায় কাজটি করেছে তাদের বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করেছি। প্রশাসন ন্যায়বিচার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। আমরা আশা করি এ ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লি. এর পরিচালক আবুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন বলেন, তিনি কোনো লিখিত আবেদন পাননি। আবেদন পেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

রেজাউল করিম রেজা/এফএ/জিকেএস