বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের অভাব—এই তিনটি চ্যালেঞ্জ একসাথে মিলে স্ট্যাগফ্লেশনের পরিস্থিতি তৈরি করছে। অনেকে ভাবতে পারেন, এই সংকট কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। তবে ইতিহাস বলে, প্রতিটি সংকটই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। প্রয়োজন শুধু সঠিক পদক্ষেপ আরঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা।
Advertisement
বিশ্বের অনেক দেশ একসময় আমাদের মতোই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র তেল সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভয়াবহ স্ট্যাগফ্লেশনের শিকার হয়েছিল। কিন্তু তারা প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, এবং বিনিয়োগ নীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে উঠেছিল। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক বিধ্বস্ত অর্থনীতি থেকে উঠে এসে আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোও একসময় অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় ছিল। কিন্তু দৃঢ় সংকল্প, সঠিক নীতি আর জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারা আজ উন্নয়নের শিখরে পৌঁছেছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতি ১০.৮৯%। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য এবং জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। বেসরকারি বিনিয়োগ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগ যেখানে জিডিপির ২২.৫০% ছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে মাত্র ২৩.৫১% হয়েছে। কর্মসংস্থানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯.৮%, কিন্তু তা কমে ৭.৬৬% হয়েছে। এই পরিস্থিতিতেঅর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের চিরাচরিত চিন্তাধারা বদলাতে হবে। সংকটকে শুধু সমস্যা হিসেবে না দেখে, এটিকে নতুন সম্ভাবনার দিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে, প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগ বাড়াতে হবে, তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে হবে। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, ব্যক্তি পর্যায়েও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।
Advertisement
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে নিম্নলিখিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি:
১। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে সরাসরি উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। জ্বালানি তেলের দামের উপর ভর্তুকি দিয়ে সাধারণ মানুষের উপর থেকে বোঝা কমাতে হবে।
২। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি: বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কর ব্যবস্থাকে আরও সহজ ও যুক্তিসঙ্গত করতে হবে।
৩। প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি: রপ্তানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে হবে এবং ডিজিটাল শিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি, এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
Advertisement
৪। উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ সহায়তা দিতে হবে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, ঋণ এবং বাজার সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। মানব সম্পদ উন্নয়ন: দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের উপর জোর দিতে হবে।
৬। কৃষি খাতের উন্নয়ন: কৃষিকে আধুনিকীকরণ করতে হবে এবং কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে।
৭। সুশাসন ও দুর্নীতি দমন: সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দুর্নীতি দমন করতে হবে।
বর্তমানে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অনেকেই হতাশায় ভুগছেন, কিন্তু এই পরিস্থিতি আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়। আমাদের সংকট মোকাবিলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
এইচআর/এএসএম