জাতীয়

ধুলায় ধূসর ঢাকার জনজীবন

শীত এলেই রাজধানী ঢাকায় বেড়ে যায় ধুলার দাপট। এসময় যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, নির্মাণকাজ, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ে। কোনো কাজ বাস্তবায়নে মানা হয় না বিধিমালা। বৃষ্টিও কম হওয়ায় আবহাওয়া, মাটি থাকে শুষ্ক। এতে ধুলাদূষণে ধূসর হয়ে ওঠে জনজীবন।

Advertisement

এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বায়ুর মান সূচক বা একিউআই রিপোর্ট অনুযায়ী, গত নভেম্বর থেকে অধিকাংশ দিন ঢাকার বায়ু থাকছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ কিংবা বলা যায় ‘অস্বাস্থ্যকর’ ও ‘অতি অস্বাস্থ্যকর’।

বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন গবেষণা বলছে, রাজধানীতে ধুলাদূষণের অন্যতম উৎস অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সরকারি উন্নয়নকাজ ও ভবন নির্মাণ। শীত এলেই রাজউক, ওয়াসা, তিতাস গ্যাস ও সিটি করপোরেশন একসঙ্গে যার যার কাজ শুরু করে। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান। আবাসন খাতে কাজ চলে সারা বছর। তবে শীতে একটু বেশি থাকে। এ মৌসুমে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। সবমিলিয়ে ধূলায় আচ্ছাদিত থাকে রাজধানী ঢাকা।

সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির স্থান ও নির্মাণাধীন স্থাপনা ঘুরে দেখা যায়, অব্যবস্থাপনায় চলছে নির্মাণকাজ। বিভিন্ন জায়গায় চলছে অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রাখা। কোথাও দেখা যায়নি নির্মাণ বিধি মেনে ছাউনি দিতে কিংবা রাস্তা কাটাকাটি করতে। এসব জায়গা থেকে উড়ছে ধুলাবালি, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত ভোগাচ্ছে।

Advertisement

যা আছে বিধিমালায়

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ এ বলা আছে, নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামত কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কার্যাবলি, রাস্তা, ড্রেন, ভবন ও অন্য অবকাঠামো নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, মেরামত বা সংস্কারকাজ পরিচালনার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাইরের ধুলাবালি প্রবেশ। এছাড়া প্রতিনিয়ত বাইরের দূষিত বায়ু প্রবেশ। ঘরের জানালা বা অন্য ছিদ্র দিয়ে দূষিত বায়ু প্রবেশ করে এবং অভ্যন্তরীণ বায়ুকে প্রভাবিত করে। মানুষ দীর্ঘক্ষণ বাসায় থাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।- ড. সাখাওয়াত হোসেন

নির্মাণস্থলে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী স্থাপনসহ নির্মাণাধীন ভবন আচ্ছাদিত রাখা; সব ধরনের নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট, ইত্যাদি) আবৃত বা ঢেকে রাখা; নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, সিমেন্ট, ইট, ময়লা-আবর্জনা, ইত্যাদি) পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক, ভ্যান বা লরি আবৃত বা সম্পূর্ণরূপে ঢেকে পরিবহনের ব্যবস্থা করা; মাটি, বালি, সিমেন্ট, ইট, ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি পরিবহন ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ট্রাক, ভ্যান বা লরির চাকার কাদা-মাটি বা ময়লা-আবর্জনা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে রাস্তায় চলাচলের ব্যবস্থা করা; নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, সিমেন্ট, ইত্যাদি) রাস্তায়, ফুটপাতে বা যত্রতত্র ফেলে রাখা যাবে না এবং নির্মাণকাজে সৃষ্ট বর্জ্য খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ বা পোড়ানো যাবে না। নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ বা মেরামত স্থলের আশপাশে দিনে অন্তত দুবার পানি বা ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণকারী কেমিক্যাল ছিটানো।

বর্জ্য থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্জ্য বা তার কোনো অংশ যত্রতত্র খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ বা পোড়ানো যাবে না। রাস্তা, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে কোনো বর্জ্য খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ ও পোড়ানো যাবে না। নালা, নর্দমা বা ড্রেনের বর্জ্য উত্তোলন করে রাস্তার পাশে স্তূপ আকারে জমা করা যাবে না। গৃহস্থালি বর্জ্য কোনো অবস্থায় বাড়ির সামনে বা তার সামনের রাস্তার পাশে খোলা অবস্থায় সংরক্ষণ বা পোড়ানো যাবে না বলে নির্মাণ বিধিমালায় বলা রয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন

ধুলার নগরে বাড়ছে স্বাস্থ্যহানি বায়ু দূষণে রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমেছে সাড়ে ৭ বছর শীতের শুরুতেই ঢাকায় বেড়েছে বায়ুদূষণ, সমাধান কোন পথে?

রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট থেকে বাসাবো পর্যন্ত গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। এ সড়কটি ঘুরে দেখা যায় কোথাও নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে দেখা যায়নি। ইট, বালু, সিমেন্ট সুরকি আর মাটি থেকে প্রতিনিয়ত ধুলা ছড়াচ্ছে। এসব ধুলাবালিতে আশপাশের বাসিন্দারা বিরক্ত। এই সড়ক দিয়ে চলা গণপরিবহনের যাত্রীরাও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। পথচারীরা মাস্ক পরেও নিস্তার পাচ্ছেন না।

মালিবাগ বাজারের দোকানি গফুর হক জাগো নিউজকে বলেন, গত দেড় বছর ছিল এক্সপ্রেওয়ের কাজের কারণে ধুলাবালি। সেটি কিছুটা কমলেও এখন গ্যাসলাইনের কাজের কারণে এত ধুলাবালি বেড়েছে। এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করা কষ্টকর। মাস্ক পরলেও ধুলাবালি মুখে ঢুকছে। দোকানের জিনিসিপাতি প্রতি ঘণ্টায় মুছতে হয়।

নভেম্বর থেকে আমাদের এখানে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। বেশির ভাগ শিশু ও বৃদ্ধ তীব্র হাঁচি-কাশি নিয়ে আসে। শ্বাসকষ্ট, ইনহেলার নেয় নিয়মিত এমন অসংখ্য রোগীও আসে। এখন নিয়মিত ৪৫০ থেকে ৬০০ রোগী আউটডোরে আসে।- ডা. আয়েশা আক্তার

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসির প্ল্যানিং বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সত্যজিৎ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উন্নয়ন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এরপর উন্নয়ন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. আনিসুর রহমান ও উপ-মহাব্যবস্থাপকের (পাইপ লাইন নির্মাণ বিভাগ) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সাড়া দেননি। খুদেবার্তা পাঠালেও তারা সাড়া দেননি।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটি থেকে যে ধুলা তৈরি হয়, সেটা কেমিক্যাল পলিউশন, কার্বন ডাই অক্সাইড বা ব্ল্যাক কার্বনের চেয়ে কম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ ধরনের ধুলা নিশ্বাসের সঙ্গে নিলে বা ধুলার সঙ্গে যখন কেমিক্যাল যুক্ত হয়, তখন ওই ধুলা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। এছাড়া শীতকালে যখন কুয়াশা পড়ে, তখন এই কুয়াশার সঙ্গে কেমিক্যাল ও ধুলাবালি মিলে এক ধরনের কেমিক্যাল কম্পোজিশন তৈরি করে, যাকে স্মোক-(ধোঁয়া) বলা হয়। এই স্মোক তৈরি হলে তখন এটা গাঢ় কুয়াশার মতো দেখা যায়। কিন্তু এগুলো দেখতে কুয়াশার মতো মনে হলেও এটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

শুধু মালিবাগ নয়। রাজধানীর বসুন্ধরা, নদ্দা, নতুনবাজার, প্রগতি সরণি, মৌচাক সিদ্ধেশ্বরী রোড, যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও দেখা যায় একই চিত্র। সিদ্ধেশ্বরী রোডে কেটে রাখা রাস্তায় কংক্রিট, বালি ও মাটি রাস্তার ওপর পড়ে রয়েছে, যা বাতাসে ধুলা ছড়াচ্ছে। প্রগতি সরণিতে পাতালরেলের কাজ চলমান থাকায় ব্যাপক আকারে ছড়াচ্ছে ধুলাবালি। ইউটিলিটি লাইন অপসারণ করে নতুন করে বসানোর কাজ চললেও সেখানে যত্রতত্র জমে আছে মাটির স্তূপ।

রাজধানীর মৌচাক মোড়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙার কার্যক্রম। বুলডোজার ও কন্সট্রাকশন ক্রেন দিয়ে ইট, সিমেন্ট, সুরকি নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। ধুলাবালি উড়ে আশপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ফুটপাতের দোকানি ও পথচারীরা।

মৌচাক মোড়ের দোকানি হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে বলেন, গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই ভবন ভাঙার কাজ চলমান। ইটের গুঁড়া আর বালি বাতাসে উড়ছে। আমি জামা-কাপড় বিক্রি করি। প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। ধুলাবালি দোকানে ঢুকে যাচ্ছে।

৯ বছরে ঢাকার বাতাস সর্বোচ্চ দূষিত ছিল গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে

ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের বায়ুমান সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) জানিয়েছে, বিগত নয় বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস বায়ুদূষণের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান ছিল। একইভাবে সদ্য বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর মাস ছিল গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দূষিত মাস। এই মাসে ১১ দিনই বায়ু দুর্যোগপূর্ণ ছিল। বায়ুর মান খুব খারাপ হলে তাকে বলা হয় ‘দুর্যোগপূর্ণ’।

আরও পড়ুন

ধুলার দুর্ভোগে রাজধানীবাসী ৬০ শতাংশ বায়ু দূষণ রাতে, আবদুল্লাহপুর সবচেয়ে দূষিত এলাকা দূষণে বিষাক্ত বায়ু, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের বাতাসের মানসূচকের (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই) তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সাতদিন ঢাকার বায়ু ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। তিনদিন ছিল অস্বাস্থ্যকর।

আমাদের মধ্যে সমন্বয়টা জরুরি। আমাদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে কোনো প্রকল্প হলে রাস্তায় কাটাকাটি যেন একসঙ্গে হয়। শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেন্ডার করে আবার যেন ঢেকে রাখা হয়। রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। এগুলো যত দ্রুত মানা যাবে, ধুলা কমানো যাবে।-ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশিরুল হক ভুইয়া

যা বলছে ক্যাপসের গবেষণা

দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ ৩০ শতাংশ দায়ী। ঢাকার বায়ুদূষণে শিল্পায়নের প্রভাব ও আশপাশের ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণ স্থান হলো ধুলা দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার সময় বড় বড় মালবাহী গাড়িতে ছাউনি না থাকায়ও ধুলা ছড়াচ্ছে বলে গবেষণায় বলা আছে।

ক্যাপস জানায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। মানাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিআরটি, এমআরটি এবং অন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ঢাকা শহরের বায়ু দূষিত হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প যেভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ম মেনে নির্মাণকাজ করার কথা ছিল সেভাবে নির্মাণকাজ না করার কারণে বর্তমানে বায়ুদূষণ চরম আকারে বেড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্পের স্বার্থে মানুষ কিছুদিন না হয় কষ্ট করলো বা ত্যাগ স্বীকার করলো। কিন্তু বছরজুড়ে ঢাকার রাস্তাগুলো সমন্বয়হীনভাবে যত্রতত্র যখন তখন খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় এবং দীর্ঘসময় তা উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা খোঁড়া মাটি গাড়ির চাকার ঘষায় বাতাসে উড়ে বেড়ায় এবং বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী খোলা অবস্থায় পরিবহনও বায়ুদূষণ ঘটায়।

ধুলাদূষণের প্রভাব ঢাকার ঘরে ঘরে

ঢাকায় বাইরের বাতাসের চেয়েও বিপজ্জনক ঘরের ভেতরের বাতাস। ঘরের বাতাসে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি বলে গবেষণায় দেখা গেছে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত হোসেনের বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় ঘরের গড় দূষণ মাত্রা ছিল ৭৫ দশমিক ৬৯ মাইক্রোগ্রাম/মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা থেকে প্রায় পাঁচগুণ বেশি। কিছু ঘরের দূষণ মাত্রা ছিল ২০০ মাইক্রোগ্রাম/মিটারের বেশি, যা বাসিন্দাদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের অনেক শহরের তুলনায় ঢাকার ঘরের বায়ুমান অনেক বেশি উদ্বেগজনক।

দূষণের কারণ হিসেবে ড. সাখাওয়াত জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাইরের ধুলাবালি প্রবেশ। এছাড়া প্রতিনিয়ত বাইরের দূষিত বায়ুর প্রবেশ। ঘরের জানালা বা অন্য ছিদ্র দিয়ে দূষিত বায়ু প্রবেশ করে এবং অভ্যন্তরীণ বায়ুকে প্রভাবিত করে। মানুষ দীর্ঘক্ষণ বাসায় থাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’

ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান ধুলা। ধুলার উৎস স্থাপনা। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা যেখানেই আছে, সেখানে দূষণ হচ্ছে। কেউ নির্মাণ বিধি মানছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরকে এনফোর্সমেন্ট জোরদার জরতে হবে। ঠিকাদারকে নির্দেশিকা মানতে হবে।- সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন

বাড়ছে রোগ-বালাই

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি হলে বায়ু চলাচলের ফ্লো ঠিক থাকে না, তখন বাতাসে দূষিত পদার্থের ঘনত্ব বাড়ে। মানুষ যখন শ্বাসের মাধ্যমে দূষিত পদার্থ নিচ্ছে তখন তাদের ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর বায়ুর কারণে সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুস ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শীত মৌসুমে বায়ুদূষণ বেশি থাকায় হাসপাতালে বাড়ছে এসব রোগী।

২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নভেম্বর থেকে আমাদের এখানে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। বেশির ভাগ শিশু ও বৃদ্ধ তীব্র হাঁচি-কাশি নিয়ে আসে। শ্বাসকষ্ট, ইনহেলার নেয় নিয়মিত এমন অসংখ্য রোগীও আসে। এখন নিয়মিত ৪৫০ থেকে ৬০০ রোগী আউটডোরে আসে। অন্য সময় রোগীর সংখ্যা থাকে সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে ৩০০। গরমে আবার ডায়রিয়া রোগী বেড়ে যায়। সব বয়সী মানুষ রাস্তায় বের হলেই মাস্ক পরাটা খুবই জরুরি।’

নির্মাণকাজ বা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম যথাযথ না মানার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশিরুল হক ভুইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে সমন্বয়টা জরুরি। আমাদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে কোনো প্রকল্প হলে রাস্তায় কাটাকাটি যেন একসঙ্গে হয়। শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেন্ডার করে আবার যেন ঢেকে রাখা হয়। রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। এগুলো যত দ্রুত মানা যাবে, ধুলা কমানো যাবে। আমাদের পানি ছিটানো কার্যক্রম চলছে। এখন রাস্তার ডিভাইডারগুলো গাছে পরিপূর্ণ করার ইচ্ছা আছে।’

সমাধানে করণীয়

সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান ধুলা। ধুলার উৎস স্থাপনা। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা যেখানেই আছে, সেখানে দূষণ হচ্ছে। কেউ নির্মাণ বিধি মানছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরকে এনফোর্সমেন্ট জোরদার করতে হবে। ঠিকাদারকে নির্দেশিকা মানতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘নির্দেশনা অনুযায়ী স্থাপনার জায়গা ঢেকে রাখা, পানি দেওয়াসহ যেসব ক্রাইটেরিয়া আছে নির্মাণাধীন স্থানে গেলে দেখা যাবে কেউই এসব পালন করেন না। সরকার যেসব স্থাপনা করে এগুলো ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করায়। কিন্তু আমাদের মাথায় থাকে, এটা সরকারের কাজ এখানে বাধা দেওয়া যাবে না। পরিবেশ অধিদপ্তরকে এই মাইন্ডসেট থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করতে হবে। কোথাও দূষণবিরোধী অভিযানে গেলে পুলিশকে কল দেওয়া লাগে। টিম ম্যানেজ করা লাগে। এত কিছু ম্যানেজ করে দূষিত স্থানে গিয়ে দেখা যায়, আর দূষণকারীকে পাওয়া যায় না।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের ধারণক্ষমতা যতটুকু তার থেকে তিন-চারগুণ অবকাঠামো ও জনসংখ্যা ধারণ করে আছে। নির্মাণকাজের দূষণ অনেক বেশি। এ ধরনের শহরে বিশ্বের অনেক দেশ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। আমাদেরও উচিত ছিল এমন পদক্ষেপ নেওয়া। অথচ আমাদের আবাসন ব্যবসায়ীরা ইমারত বিধিমালা সংশোধন করে আরও উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করতে চান।’

বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ) তপন কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিএম ২.৫ খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আমরা শেষ সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করছি। প্রতিনিয়ত দূষণবিরোধী অভিযানে মোবাইল কোর্ট চলছে। পরিবেশ দূষণ মনিটরিং করার জন্য সাতটি কোর্ট নিয়োজিত। মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে জাতীয় বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আলোকে সার্বিকভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হবে।’

আরএএস/এএসএ/এমএস/এএসএম