চেক জালিয়াতি মামলায় সেতাউর রহমান নামের এক যুবককে এক বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন রাজশাহীর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজের প্রথম আদালত। তবে সাজাপ্রাপ্ত ওই আসামির পরিবর্তে ভাড়ায় জেল খাটছেন মিঠন (২৮) নামের আরেক যুবক। মাসে চার হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাদকাসক্ত দিনমজুর ওই যুবককে আদালতে হাজিরের ব্যবস্থা করেন মূল আসামি। এরপর আড়াই মাস ধরে কারাগারেই রয়েছেন মিঠন।
Advertisement
সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুগ্ম দায়রা জজ আদালত-২-এ অন্য আরেকটি মামলায় তাকে হাজির করলে প্রকাশ্যে আসে পুরো ঘটনা।
ভাড়ায় জেল খাটা মো. মিঠন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে। মূল আসামি সেতাউর রহমান (৩৯) একই উপজেলার বিশ্বনাথপুর এলাকার সেরাজুল ইসলামের ছেলে। মেসার্স চাঁদ ব্রেড অ্যান্ড বেকারি নামের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
মিঠনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানের জন্য পথ চেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মা আখতারি বেগম ও বাবা রেজাউল করিম।
Advertisement
আক্তারি বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলে ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছে। এমনটায় আগে জানতাম। পরে জানতে পারছি মাসে মাত্র চার হাজার পাওয়ার জন্য সেতাউর মেম্বারের হয়ে বদলি জেল খাটছে। এটি অন্যায়ের মধ্যেই পড়ে। আমি অপেক্ষায় আছি কখন আমার ছেলে বাসায় ফিরবে। কখন আমার ছেলেকে দেখতে পাবো।’
স্থানীয় বাসিন্দা হাকিম আলী বলেন, ‘আমরা সবাই জানতাম ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছে মিঠুন। গতকাল থেকে জানতে পেরেছি সেতাউর নামের সাবেক এক মেম্বারের হয়ে সে জেল খাটছে। এটি খুবই দুঃখজনক।’
মামলার বাদী আইনজীবী আবদুল মালেক বলেন, ‘আমি সেতাউর রহমানের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার টাকার একটি চেক জালিয়াতি মামলা করি। ওই মামলায় এক বছরের সাজা ও চেকে বর্ণিত টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত। কিন্তু অর্ধেক টাকা জমা দিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন সেতাউর। তাতে হাইকোর্ট তার সাজা কমিয়ে ১৫ দিন করেন এবং তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধের সময় দেন। বাকি টাকা তিনি আমাকে চলতি মাসেই পরিশোধ করেছেন। তাই আমি আদালতে পিটিশন দিয়েছি।’
কিন্তু সম্প্রতি আদালতে আসামিকে হাজির করলে দেখা যায়, সেতাউর রহমানের বদলে মিঠন নামের একজনকে হাজির করা হয়েছে। আদালতের কাছে পুরো ঘটনা স্বীকার করেন মিঠন। অন্যদিকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেতাউর।
Advertisement
এদিকে রাজশাহী আদালতে সেতাউর রহমানের বিরুদ্ধে আরেকটি চেক জালিয়াতির মামলা করেন সাজেদুর রহমান নামের একজন। তিনি বলেন, ‘৭০ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির ওই মামলায় সেতাউর রহমানকে এক বছরের সাজা দেন আদালত। কিন্তু গত বছরের ২৭ অক্টোবর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ না করে মিঠন নামের একজনকে হাজির করেন। পরে জানা যায়, সেতাউরের বদলে সাজা খাটছেন মিঠন।’
এ বিষয়ে আদালতে বিস্তারিত তুলে ধরেন মো. মিঠন। তিনি আদালতকে জানান, তিনি নেশগ্রস্ত ছিলেন। সাবেক মেম্বার সেতাউরের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘তুই কিছুদিন জেলে থেকে আয়’। একথা বলে তিনি রাজশাহীতে নিয়ে গিয়ে শেষবারের মতো নেশা করিয়ে বলেন, ‘তুই শুধু আমার নাম ও আমার বাবার নাম বলবি। তুই জেলে কিছুদিন থাকলে ভালো হয়ে যাবি। আর খুব তাড়াতাড়ি তোকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে একটি রিকশা কিনে দেবো। তোর ও তোর পরিবারের খরচ আমি চালাবো’।
মিঠন আরও বলেন, দুই মাস ২৫ দিন ধরে জেলে আছি। আমার পিসিতে মাত্র ছয় হাজার টাকা দিয়েছে। সেতাউর কিছুদিন আগে আমাকে দেখতে গেলে তাকে বলি, আমাকে জেল থেকে ছাড়াচ্ছ না কেন? তখন সে বলে, তুই এখন এসব বললে সারাজীবন জেলে থাকবি আর আমার কিছুই হবে না।
নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে ভুক্তভোগী মিঠন বলেন, এখন সব জানাজানি হয়ে গেছে। আমি ভুল করেছি।
কথা হয় মিঠনের স্ত্রী আশা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী মাদকাসক্ত। তাকে ভুল বুঝিয়ে অর্থের লোভ দেখিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি জেল থেকে বের করে আনার কথা বললেও এখনো আমার স্বামী জেলে। তিন সন্তান নিয়ে আমি খুব কষ্টে আছি। এই কয়েক মাসে সেতাউর আমাকে মাত্র চার হাজার টাকা দিয়েছে। অথচ আমার স্বামী বলেছিল প্রতিমাসেই চার হাজার টাকা দেবে।’
বিষয়টি স্বীকার করে সাজাপ্রাপ্ত মূল আসামি সেতাউর রহমান বলেন, মিঠনকে দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল আসামি সেতাউর রহমানের নামে মাদকসহ আরও অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন মেহেদী বলেন, ‘একজন আসামির সাজা আরেকজন অর্থের বিনিময়ে ভোগ করছে। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এখানে সবাইকে সতর্ক হওয়া উচিত। দুজনকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
সোহান মাহমুদ/এসআর/এএসএম