স্বাস্থ্য

কেউ ফেরেন হাসিমুখে, কেউ কাঁদতে কাঁদতে

‘সরকারি হাসপাতাল মানেই রোগীর চাপ। জরুরি বিভাগ থেকে বহির্বিভাগ সর্বত্র মানুষের হাহাকার। সহজে টিকিট নেওয়া, ভর্তি, চিকিৎসা কোনোটাই সম্ভব নয়। এত কিছু জেনেও নিরুপায় হয়েই আমরা আসি সরকারি হাসপাতালে। কেউ বেসরকারি চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে না পারার কারণে, আবার কারও চিকিৎসা বেসরকারিতে অপ্রতুল হওয়াই মোটাদাগে এর কারণ। নিরুপায় এসব রোগীর অসহায়ত্বে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফরাও সুযোগ নেন। করেন যাচ্ছেতাই ব্যবহার।’

Advertisement

এই কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে আসা আবিদ আলী (৬০)। এই সিনিয়র সিটিজেন নিজেই স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার এসেছেন রাজধানীর এই হাসপাতালটিতে, সঙ্গে এনেছেন মেয়েজামাই। সকালে এসে টিকিট কেটে ১১৫ নম্বর সিরিয়ালে গেছেন। দীর্ঘ সিরিয়াল পার হয়ে যখন ঢুকতে যাবেন, বাধ সাধলেন হাসপাতালের স্টাফ। একজন যেতে পারবেন বলে ঢুকতে দেওয়া হলো শুধু মেয়েজামাইকে। মুরুব্বি অনুনয় বিনয় করে বললেন, সমস্যাটা আমি খুলে বলতে পারবো, আমাকে যেতে দিন, প্লিজ। কিন্তু স্টাফ ধমক দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলেন।

পুরো ঘটনা অবলোকন করে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদক কথা বলেন ভারাক্রান্ত মুরুব্বির সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একটা তরুণ ছেলে, তার আচরণটা হয়েছে? আমি তো তার বাবার বয়সী।

কথার মধ্যেই মেয়েজামাইকেও বের করে দিলেন চিকিৎসক। সমস্যা কী জানতে চাইলে বলেন, তারা রোগী ছাড়া রিপোর্ট দেখেন না।

Advertisement

আবিদ আলী বলেন, ‘আমি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভান্নারা গ্রাম থেকে এসেছি। অন্তত রিপোর্ট দেখে তো একটা পরামর্শ দেবে। ভর্তি লাগলে আমি নিয়ে আসবো। না হয়, চিকিৎসা দেবে’

তিনি বলেন, তিনদিন আগে আমার স্ত্রী দেলোয়ারা স্ট্রোক করেছে। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে টেস্ট করিয়ে আনলাম, তারা বললো, রোগী স্ট্রোক করছে। ঢাকার নিউরো সায়েন্সে নিয়ে যান। স্ট্রোকের রোগী নিয়ে আসা তো কষ্ট। আমি চাইছিলাম, রিপোর্ট দেখিয়ে ভর্তি দিলে শনিবার নিয়ে আসতাম। বা চিকিৎসা দিলে সেটা করাতাম। কিন্তু এখন তো হলো না। শনিবার রোগী নিয়েই আসতে হবে।

ট্রলিতে রোগী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জান্নাত নামের এক তরুণী। সমস্যা জানতে চাইলে বলেন, ভোলার চরফ্যাশনের দক্ষিণে নামারচর থেকে বাবা নাজিম আলীকে (৬২) নিয়ে আসছি। স্ট্রোক করেছেন তিনদিন আগে নিজ বাড়িতে। চরফ্যাশনের চিকিৎসক দেখানোর পর ঢাকা আসতে বলেছেন। এই হাসপাতালে আনলাম, তারাও রাখে না। বলছে বাসায় নিয়ে যেতে, সিট খালি নেই। ঢাকায় তো আমাদের বাসা নেই। গতকাল রওয়ানা দিয়ে এই রোগী নিয়ে সারারাত লঞ্চে কেটেছে। ভোরে হাসপাতালে আসছি।

সারাদিন ঘুরে ডাক্তার দেখাতে পারলেও ভর্তি না হতে পারা বা প্রত্যাশিত চিকিৎসা না পাওয়ার আক্ষেপ তার।

Advertisement

কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার নীলগঞ্জের পাস্তা থেকে ফাতেমা এসেছেন তারা মেয়ে হাফসাকে (৭) নিয়ে। তিনি বলেন, জ্বর নিয়ে কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি ৬ অক্টোবর। জ্বর ভালো হওয়ার পর ৮ তারিখে পেটে ব্যথা হয়েছে। একটা ইনজেকশন দিয়েছে। এরপর থেকে স্বাভাবিক মেয়ে আমার অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। অবশ হয়ে গেছে পুরো শরীর। জ্ঞানও ছিল না। ৯ অক্টোবর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করে। সেখানে এক মাস ১০ দিন চিকিৎসা নিয়ে বুক থেকে মাথা পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়েছে। চোখ খুলে কথা বলছে। কিন্তু নিচের অংশ অবশ। তারা নিউরো সায়েন্সে রেফার করেছে। ডিসেম্বর থেকে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখনো উন্নতি নেই।

চিকিৎসা নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকলেও বাচ্চা মেয়েটির সঠিক চিকিৎসার আকুতি মা ফাতেমার।

পাশেই ট্রলিতে পড়ে আছেন মাসুদ হাওলাদার (৬০) নামের এক রোগী। মাদারীপুরের কালকিনি থেকে এসেছেন তিনি। স্বজনরা জানান, অফিস থেকে ফেরার পথে পড়ে গেছে, হুঁশ নেই। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে ভোর ৫টায়। সারাদিন তিন-চারজন মিলে দৌড়ে দুপুর ১টায় তারা সিট পেয়েছেন।

দিনভর এই চিত্রই দেখা যায় রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে। রোগীর প্রত্যাশা ও ডাক্তারদের সীমাবদ্ধতা, এসব মিলেই আগায় গল্প। কেউ ফেরে হাসিমুখে, কেউ কাঁদতে কাঁদতে। ক্রেডিটের পাশাপাশি সব দায় মেনেও নেন চিকিৎসকরা।

হাসপাতালটির আবাসিক সার্জন ডা. হাসান মেহবুব জাগো নিউজকে বলেন, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সব বিভাগ মিলে প্রতিদিন প্রায় ২০০০ থেকে ২৫০০ জন রোগী সেবা নেওয়ার জন্য আসে। তন্মধ্যে ভর্তিযোগ্য রোগীর সংখ্যা আনুমানিক ২৫০ থেকে ৩০০ জন। সিট খালি থাকা সাপেক্ষে ভর্তি হয় আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ জন। ঋতুভেদে এ সংখ্যার আবার তারতম্য হয়, যেমন গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে রোগীর সংখ্যা একটু কমে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোক ভর্তি হতে না পারলে তো অসন্তুষ্ট হবেই।

তিনি বলেন, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী, যাদের এই হাসপাতালে আসার দরকার নেই, কোমর ব্যথা, মাথা নিয়েও তারা চলে আসে। এটা টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতাল। সবচেয়ে কঠিন ও সূক্ষ্ম চিকিৎসা হবে। যারা আসে, তারা আস্থার কারণেই আসে। কিন্তু রোগীরা বাড়ির পাশের হাসপাতালে আস্থা পায় না। পেলে আসতে হতো না।

এসইউজে/এএমএ/জেআইএম