ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন। রাজধানী ঢাকার জীবনযাত্রায় বিগত কয়েক বছরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বছরের শুরুতেই একগাদা খরচের চাপ আসে জগদ্দল পাথরের মতো। বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ বাড়েই। সঙ্গে যোগ হয় মূল্যস্ফীতি কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সংক্রান্ত কারণে অতিরিক্ত পণ্যমূল্য। নগরজীবনে টিকে থাকার লড়াই নিয়ে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপনের চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।
Advertisement
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকার। অথচ এই দুই খাতেই প্রতি বছর চলে যায় আয়ের বড় একটি অংশ। ভালো স্কুলে ভর্তি কিংবা বড় কোনো অসুখ হলে ঋণ করেই মেটাতে হয় ব্যয়। এতে বাড়তি চাপে পড়ছেন অভিভাবকরা। ব্যয় কমাতে আমিষ-প্রোটিনে কাটছাঁট করতেও বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
বাড়িভাড়ার পাশাপাশি বছরের শুরুতেই আর্থিক সংকট তৈরি হয় সন্তানের শিক্ষাব্যয় মেটাতে গিয়ে। কাঁচা সবজির দাম হাতের নাগালে থাকলেও চাল, ডালসহ অন্য নিত্যপণ্যে ঊর্ধ্বগতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কমছে ক্রয়ক্ষমতা। খরচ বাঁচাতে অন্য কিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি বাধ্য হচ্ছেন খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে। আমিষ-প্রোটিনে চলছে কাটছাঁট। এতে পরিবারের সদস্য আক্রান্ত হচ্ছে রোগ-অসুখে। শিক্ষাব্যয়, রোগ-অসুখের সঙ্গে খাবারের মেন্যু পরিবর্তনেও আসছে না স্বস্তি।
কথা হয় রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকার মুদি ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছেন। বোরহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। জাতি গঠনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা দরকার। উন্নত বিশ্বে পড়াশোনার খরচ একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ফ্রি বলে জানি। অথচ আমাদের দেশে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা বাবদ আয়ের সিংহভাগই চলে যায়। প্রতি বছরের শুরুতেই আমার ছেলে-মেয়েদের পেছনে জমানো সব অর্থ খরচের পাশাপাশি ঋণও করা লাগে। স্কুলের বেতন, কোচিং ফি, মূল্যায়ন পরীক্ষার ফি, নতুন স্কুল পোশাকসহ আরও কত কী! গ্রাম থেকে কিছু খরচ আনার পরও চলতে পারছি না, সঞ্চয় নেই। মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।’
Advertisement
একই সুরে কথা বলেন বাসাবো এলাকার বাসিন্দা হাসিব। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিনি। এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস তার। হাসিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা সময় মনে করতাম ঢাকায় টাকা ওড়ে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ভালো স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম। সন্তানদের মানুষ করবো, কিছু সঞ্চয় হবে। তবে সঞ্চয় তো দূরের কথা বাচ্চাকে একটি ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির পর মাসের আয়ের টাকা ১৫ তারিখের আগেই শেষ হয়ে যায়। জ্বর-সর্দিসহ এ ধরনের রোগ হলে ওষুধ কেনা হয় না। মনের জোর দিয়ে কাজ করি, কদিন কষ্ট পেলেও চলে যাচ্ছে।’
মুনতাহা তাবাসসুম-শরীফ দম্পতি দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন মগবাজারের মধুবাগ এলাকায়। শরীফের মাসিক আয় ৩৫ হাজার টাকা। ছেলে একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নার্সারিতে পড়ছে। মেয়ে পড়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে।
তাবাসসুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার ব্যয় প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা। বাচ্চারা এখন ছোট, প্রায়ই ঠান্ডাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। আমরাও চিকিৎসা নেই। সব মিলে মাসে আরও চার হাজার টাকা ব্যয় হয় স্বাস্থ্যের পেছনে। সব মিলে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের পেছনে ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। কোচিং ও প্রাইভেট দিলে খরচ আরও বাড়বে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যখাত অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে। কিন্তু কোনো জায়গায়ই এটা নেই। সরকার এদিকে যথাযথ মনোযোগ দেয় না, এতে শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে মানুষের ব্যয় বাড়ে। অবশ্যই আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলার কারণেই মানুষ বেশি অসুস্থ হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা।’
Advertisement
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ব্যয় কত?ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়ের ৭১ শতাংশ বহন করতে হয় পরিবারকে। সামাজিক সংগঠন এনজিও বা বেসরকারি স্কুলের ফি ও ব্যয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তিনগুণ। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় নয়গুণ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী। যেখানে মাধ্যমিকে ৯৪ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করে, আর ৬ শতাংশ পরিবার স্কুলের ফি মেটাতে ঋণ করে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবার ঋণ করে সন্তানদের বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়াশোনার খরচ মেটায়।
আরও পড়ুনশিক্ষায় খরচে ‘অনীহা’, স্বল্পোন্নত ৩৩ দেশেরও নিচে বাংলাদেশশিক্ষায় বাজেট/নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার শঙ্কাগবেষণা/প্রাথমিক-মাধ্যমিকে পারিবারিক শিক্ষাব্যয় বেড়েছেএডুকেশন ওয়াচ-২০২৩ এর একটি গবেষণা বলছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে শিক্ষার্থীপিছু পরিবারের শিক্ষাব্যয় আগের বছরের তুলনায় প্রাথমিকে ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ বেড়েছে। এই ব্যয়ের বড় কারণ কোচিং-প্রাইভেট ও নোট গাইড।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের শাখা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের সবশেষ প্রকাশনা বলছে, বাংলাদেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হয়। তালিকায় বাংলাদেশের ওপর আছে শুধু আফগানিস্তান। দেশটির নাগরিকদের নিজেদের বহন করতে হয় ৭৮ শতাংশ ব্যয়। খরচ ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের মানুষকে চিকিৎসার জন্য ৬২ শতাংশ ব্যয় বহন করতে হতো।
এসডিজি অ্যাকশন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের একটি সূত্র জানায়, দেশে ৪৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা খরচ মেটাতে কোনো না কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হন। দেশের জনগণ তাদের স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজেরাই সংস্থান করতে বাধ্য হন। দরিদ্র ২০ শতাংশ পরিবার মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি সুবিধার ২০ শতাংশও ভোগ করতে পারে না। দরিদ্র জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য সরকারের বরাদ্দও অপর্যাপ্ত।
শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উন্নত জাতি পেতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম শিক্ষা-স্বাস্থ্য। এই দুই খাত বেশি গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়বে। মেধাশূন্য হবে জাতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্যকে ফ্রি করে দিতে হবে, এটা করা গেলে আরও ভালো, যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা অপ্রতুল।’
খরচ বাঁচাতে পাতে কমছে সুষম খাবারমগবাজার গ্রিনওয়ে এলাকার মিতা রায় নামে এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সন্তান মানুষ করার আকাঙ্ক্ষায় নগরজীবন বেছে নেন মানুষ। কিন্তু এই নগরে এসে নিজ সন্তানদের প্রোটিন থেকে দূরে রাখতে বাধ্য হন অনেক বাবা-মা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। আমি বাসায় মুরগি-মাংস আনতে পারি না। বাচ্চাদেরও এটা সয়ে গেছে। তারা এক ডিম ভাগ করে খেয়েই খুশি। তবে সব কিছুর দাম কমানোর পাশাপাশি শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করা হলে আমরা যেমন বেঁচে যাই, দেশও সুস্থ জাতি উপহার পায়। তবে তা সম্ভব হবে কি না জানি না।’
মেসের খাবারের মেন্যুতেও কাটছাঁটমেসের খাবার মেন্যুতেও পরিবর্তন এসেছে। এক সময়ে নিয়মিত মুরগির মাংসের ব্যবস্থা থাকলেও এখন আমিষ-প্রোটিনযুক্ত খাবার তেমন নেই।
মেসে কী রাখা হয়, জানতে চাইলে ইয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মেসে সবাই ছাত্র। সবারই সকালে ক্লাস থাকে। তাই সকালে না খেয়ে দুই বেলা (দুপুর ও রাত) রান্না হয়। এখন শাক-সবজি অথবা আলুর ভর্তা থাকে। সঙ্গে পাতলা ডাল। ডিম হলেও এক ডিম ভেজে দুই ভাগ করা হয়। এখন নিয়মিত খাবার লাউ-মিষ্টিকুমড়া-জালিকুমড়া থাকে। শিক্ষার্থী হওয়ায় সবার এ খাবার মানিয়ে নিতে খুব বেশি কষ্ট হয় না।’
এসব নিয়ে কথা হয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এখন তারা খরচ বাঁচাতে খাবারের তালিকায় পরিবর্তন এনেছে। খাবারের পাঁচ মৌলিক উপাদানের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট হলো চাল, এর দামও এখন অনেক বেড়েছে। তাছাড়া মাংস ও স্নেহজাতীয় খাবারের দামও বাড়তি। ফলে অনিবার্যভাবে খাবারের মানে অবনমন ঘটেছে। একটা মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে প্রতিদিন যে পরিমাণ সুষম খাবার খেতে হয়, সেসব উপাদানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মানুষের স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। এতে তার শরীরে যে পরিমাণ প্রোটিনের দরকার সেটি তিনি নিতে পারছেন না।’
ডা. লেলিন বলেন, ‘এসব কারণে ব্যক্তির শরীরে পুষ্টিহীনতা দেখা দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পুষ্টিহীনতা দেখা দিলে তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। মানুষকে তখন নানান রোগ-বালাই আক্রমণ করে। মানুষের পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমে যায়। জাতীয় শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়, যা জাতীয় উৎপাদনে প্রভাব ফেলে এবং অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা ট্যাক্স দেই তার প্রতিদান পাওয়ার জন্য। হওয়া উচিত ৩০ শতাংশ পকেট থেকে ব্যয় করবে বাকি ৭০ শতাংশ সরকার দেবে বা অন্য কোনো ম্যাকানিজম থেকে আসবে। কিন্তু আমাদের উল্টো, এখানে পকেট থেকে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয়, সরকার দেয় ২৫ শতাংশ। তার মানে স্বাস্থ্যে বার্ডেনটা অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, ‘আবার শিক্ষায় আমাদের পকেট থেকেই যায় ৯০ শতাংশ, বাকি ১০ শতাংশ সরকার দেয়। এখানেও উল্টো হচ্ছে। আমরা ট্যাক্স দেই কিন্তু প্রতিদান পাই না। উন্নত বিশ্ব ট্যাক্স দিয়ে ট্যাক্সের প্রতিদান পায়। প্রতিদান না পেলে ট্যাক্স দেওয়ার আগ্রহ কমে। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। এটার সরাসরি প্রভাব পড়ে গরিব পরিবারের ওপর। এসব পরিবারকে হয় শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেক্রিফাইস করতে হয় নতুবা নিউট্রিশন।’
ইএআর/জেআইএম