চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই ওষুধ, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, বিস্কুট, টেলিফোন, ইন্টারনেট, কোমলপানীয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ, সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। অপ্রত্যাশিতভাবে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে এসব পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে।
Advertisement
অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে দেশ চালানোর দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এভাবে ভ্যাট আরোপ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তার মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর কারণে দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ধনীদের ওপর বিশেষ প্রভাব পড়বে না। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর পদক্ষেপ বৈষম্যবিরোধী হয়নি।
বাংলা একাডেমি ও অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য এই অর্থনীতিবিদের অভিমত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশে বা চাপে যদি এই ভ্যাট বাড়ানো হয়, তাহলে এটা দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন অভিমত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।
Advertisement
আমরা দেখলাম ভ্যাট যেটা প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটা ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স। এটা জনগণের ওপর বেশি পড়বে। বড়লোকের ওপর পড়বে না বা বড়লোকদের ওপর বিশেষভাবে পড়বে না। সে জন্য ডাইরেক্ট ট্যাক্স না করে, এই যে ভ্যাটের মাধ্যমে টাকা ওঠানো হলো সেটা ঠিক হলো না। বৈষম্যবিরোধী হলো না।
বিভিন্ন পণ্য-সেবায় ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?আমি তিন রকম সমস্যা এখানে দেখি। প্রথম সমস্যা হচ্ছে যেহেতু এটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকার, সুতরাং এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়, যেটায় বৈষম্য বাড়বে। কিন্তু আমরা দেখলাম ভ্যাট যেটা প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটা ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স। এটা জনগণের ওপর বেশি পড়বে। বড়লোকের ওপর পড়বে না বা বড়লোকদের ওপর বিশেষভাবে পড়বে না। সে জন্য ডাইরেক্ট ট্যাক্স না করে, এই যে ভ্যাটের মাধ্যমে টাকা ওঠানো হলো সেটা ঠিক হলো না। বৈষম্যবিরোধী হলো না।
আরও পড়ুন
কর বৃদ্ধির পর কতটা বাড়বে এসি-ফ্রিজের দাম? সরকারি চাল-গমের মজুত বাড়াতে আমদানিতে জোর কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পারছে না সরকার কোন পণ্যগুলো মানুষকে বেশি ভোগাতে পারে?বিশেষ করে তিনটি পণ্য আছে, যে তিনটি পণ্য সাধারণ মানুষের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এলপিজি গ্যাস, ওষুধ ও মোবাইলে কথা বলা-ইন্টারনেট। এগুলোর ওপর যে পরিমাণ ট্যাক্স বসানো হয়েছে, তাতে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং এটা আমি সমর্থন করছি না, এটা প্রত্যাহার করা উচিত। অন্তত এই পণ্যগুলোর ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় বা নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র মানুষের ব্যবহার্য পণ্যের ওপর যত ভ্যাট আছে, সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।
Advertisement
এটা আইএমএফের নির্দেশে করা হচ্ছে কি না, এটা আমরা জানতে চাই। যদি আইএফএফের নির্দেশে করা হয় বা আইএমএফের চাপের কারণে এগুলো করতে সরকার বাধ্য হয়, তাহলে এটা আমাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সেটা মোকাবিলা করতে এই সরকার ব্যর্থ হয়েছে, এ কথাই আমি বলবো।
আইএমএফের চাপের কারণে এগুলো করতে সরকার বাধ্য হয়, তাহলে এটা আমাদের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সেটা মোকাবিলা করতে এই সরকার ব্যর্থ হয়েছে, এ কথাই আমি বলবো।
নিম্ন আয়ের মানুষের চাপ বাড়ার আরও কারণ আছে কি না?শোনা যাচ্ছে রেশন দেওয়ার যে দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল শ্রমিকদের বা নিম্নবিত্ত মানুষদের, সেটা আর এখন কার্যকর হচ্ছে না। উপরন্তু যে ক্যাশ মানি দরিদ্র মানুষকে আওয়ামী লীগ সরকার দেওয়ার জন্য কার্ড সিস্টেমে চালু করেছিল, সেটাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। দরিদ্র মানুষের কাছে বিক্রি করার জন্য ট্রাকের মধ্যে যে পণ্য রাখার কথা ছিল, সেগুলোও প্রত্যাহার করা হয়েছে। এগুলো সবই হলো মুক্তবাজারপন্থি দর্শনের কাছে নতি স্বীকার, সেটাও আমি সমর্থন করি না।
ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে যেসব পণ্যেপটেটো ফ্ল্যাকস, কর্ন, মেশিনে প্রস্তুত বিস্কুট, হাতে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট বা টমেটো কেচাপ বা সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প, তেঁতুলের পেস্ট, ট্রান্সফরমারের তেল, লুব্রিকেন্ট তেল, এলপি গ্যাস, আমদানি করা বাল্ক পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিআরটিএ থেকে নেওয়া লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো-সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন অ্যালয়, এইচআর কয়েল থেকে সিআর কয়েল, সিআর কয়েল থেকে জিপি শিট, জিআই তার, ৫ কেভিএ থেকে ২ হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, চশমার মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি ম্যাট্রেসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্যের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ, ইনভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়েল, সানগ্লাস, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিজস্ব ব্র্যান্ড-সম্বলিত তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতান– এসব পণ্য ও সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, বোর্ড সভায় জোগানকারী, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলা-বিষয়ক ক্লাব ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এমএএস/এএসএ/এমএস