তথ্যপ্রযুক্তি

বিশ্বব্যাংকের টাকায় ‘এজ প্রকল্প’ নিয়ে খামখেয়ালি

দেশের প্রযুক্তি সক্ষমতা অর্জন ও অর্থ সাশ্রয়ে বিশ্বব্যাংকের টাকায় হাতে নেওয়া ‘এজ প্রকল্প’ মুখ থুবড়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ‘এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই)’ নামের এ প্রকল্পের উদ্দেশ্যে ছিল ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তিতে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো।

Advertisement

কথা ছিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে কাজ করা, এক লাখ গ্র্যাজুয়েটের কর্মসংস্থান উপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া, সরকারি চাকরি প্রার্থীদের জন্য জাতীয় জব পোর্টাল করা, সরকারের ক্লাউড সেবা, ই-মেইল এবং ইউনিফাইড কমিউনিকেশন সেবা দেওয়া।

এছাড়া স্মার্ট লিডারশিপ একাডেমি করা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে কৌশলপত্র দেওয়া ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া, বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে ইকোনমিক হাব করা, সেন্টার ফর ফোরআইআর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রিসার্চ-ইনোভেশন সেন্টার করা।

অথচ প্রকল্প মেয়াদের বেশিরভাগ সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ১৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার বেশিরভাগই আবার দেশে-বিদেশের বিভিন্ন ইভেন্ট আর ট্রেনিং দিয়ে। প্রকল্পের মূল কম্পোনেন্ট প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সংশ্লিষ্ট কাজগুলোই আলোর মুখ দেখেনি এখনও।

Advertisement

প্রকল্পটি যে ঠিকঠাক বাস্তবায়নের দিকে এগোয়নি তার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন খোদ প্রকল্প পরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন। তার ভাষ্য-এটার অগ্রগতি খুব একটা বেশি হয়নি। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি তদারকি করতে গিয়ে অসন্তুষ্টি জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি প্রকল্পের কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে বলেছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদিকে এ প্রকল্পের বাজেটও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের আইডিএ-বিশ্বব্যাংক ও সরকারের অংশ মিলে বাজেট ছিল ২৯৫ মিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে এখন ১৭৫ মিলিয়ন ডলারই বিশ্বব্যাংক ফেরত নিয়েছে বা প্রকল্প হতে স্যারেন্ডার করা হয়েছে। ২০২২ সালে নেওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২৬ সাল পর্যন্ত।

প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এ প্রকল্পের বাজেট ছিল অনেক। এখন এখানে ১৭৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার স্যারেন্ডার করা হয়েছে। তাহলে টাকা যেহেতু নেই সব কাজ থাকবে না, কমে গেছে। বর্তমান সরকার এসে কিছু রিভিউ করেছে, কিছু কাটছাঁট হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা বাজেটে সাপোর্ট দেবেন। তাই এখান থেকে টাকা কেটে নিয়ে গেছে। এখন টোটাল বাজেট ১২০ মিলিয়ন ডলার মাত্র।

প্রকল্পে যা ছিল, করা হয়েছে যেটুকুসবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ট্রেনিং ও ইভেন্টের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমওইউ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ আইটি কানেক্ট পোর্টাল উদ্বোধন করা, গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্রের নকশা করা, বাংলাদেশ ও জাপান-বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বন্ধুত্ব উদযাপনসহ কিছু কর্মশালা ও সেমিনার করা হয়েছে।

Advertisement

যদিও ইউনিফাইড কমিউনিকেশন্স কম্পোনেন্ট ও ন্যাশনাল জব পোর্টালের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইউনিফাইড কমিউনিকেশন্স কম্পোনেন্টকে তারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখছেন তারা।

তাদের বক্তব্য, সরকারি জনগুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে অনেক গোপনীয় বিষয় আলাপ হয়। জুম বা গুগল মিট ব্যবহার করলে এসব তথ্য বিদেশের ক্লাউডে জমা হবে ও তথ্য পাচার হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। এসব কম্পোনেন্ট ইনস্টল করা থাকবে বিসিসির ক্লাউডে ও বাংলাদেশের মধ্যে যেখানে সব ডাটা এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

সরকারের সাইবার নিরাপত্তা ও ডাটা সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রায়ই প্রতিটা অ্যাপ ব্যবহারকারীর লোকেশন ডাটা সংগ্রহ করে। দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের লোকেশন বিদেশের ক্লাউডে থাকলে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।

সরকারের আশা, এ প্রকল্পের মাধ্যমে যদি সরকারের শতকরা ১০ ভাগ ফিজিক্যাল মিটিং কমানো যায় তাহলে এক বছরের মধ্যে এই প্রকল্পে সব খরচ উঠে আসবে। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান ডলার খরচ করে জুমের লাইসেন্স কেনে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আর জুমের লাইসেন্স কেনা লাগবে না। ফলে বিদেশি মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।

প্রকল্পের অগ্রগতি শুধুই পরামর্শক নিয়োগসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ন্যাশনাল জব পোর্টাল তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি যুগান্তকারী প্ল্যাটফর্ম হতে পারে, যা সরকারি চাকরির আবেদন প্রক্রিয়াকে সহজ, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসবে। এ উদ্যোগ চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করবে, যা জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। তবে এ দুই উদ্যোগও সেবার জন্য উন্মুক্ত করতে পারেনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, প্রকল্পের আওতায় ২৩০ জন সংসদ সদস্যকে ডিজিটাল লিডারশিপ ও সাইবার সিকিউরিটিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। খসড়া ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন ও আইসিটি নীতিমালা করে আইসিটি বিভাগে জমা দিয়েছেন তারা। তাছাড়া সরকারের ই-মেইল সেবা শক্তিশালী করা, প্ল্যাটফর্ম এজ-এ সার্ভিস সলিউশনসহ কয়েকটি দরপত্র সম্পন্ন করা, কিছু কাজ মাঝপর্যায়ে এসে ধীরগতি আর কিছু পরামর্শক নিয়োগই এ প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা।

অনিয়ম-দুর্নীতিতথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজতে গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এজ প্রকল্পে নেওয়া দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ইভেন্ট সংকুচিত করা, বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় কম্পোনেন্ট; যেমন- দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তি ল্যাব নির্মাণ, নানা নামে বিভিন্ন একাডেমির মতো বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশেষজ্ঞ, ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক ও সিইও টিআইএম নূরুল কবীর বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে চাকরির সংস্থান কম, বেকারত্বের সংখ্যা বেশি। নতুন প্রজন্ম যে আশার আলো জাগিয়েছে সেখানে একটি জব পোর্টাল করা হয়েছে বিদেশি সাহায্যে। সেটিও যদি অ্যাকটিভ করা যায় তাহলে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। এটি যেহেতু প্রস্তুত রয়েছে, তাহলে চালু করা হচ্ছে না কেন?

এএএইচ/এমআইএইচএস