সাহিত্য

বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটারের জনক ড. মুকিদ চৌধুরী

বাংলা ভাষায় অভিনীত থিয়েটারকেই মূলত ‘বাংলা থিয়েটার’ বলা হয়। এই বাংলা থিয়েটার প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ শাসনের সময় বাংলা থিয়েটারের উৎপত্তি হয়েছে। যদিও ১৯ শতকের প্রথমদিকে ব্যক্তিগত বিনোদন হিসেবে এটি শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রাক্কালে, বাংলা থিয়েটারগুলো ব্রিটিশ রাজের অপছন্দের বিষয়গুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি আন্দোলন থিয়েটারকে সামাজিক সচেতনতার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এভাবেই বাংলা থিয়েটার প্রসারিত হতে থাকে।

Advertisement

বাংলা থিয়েটারের একটি শাখা হচ্ছে ‘মুভমেন্ট থিয়েটার’। এই মুভমেন্ট থিয়েটারে গান থাকবে, নাচ থাকবে। প্রত্যেক অভিনেতা অনবরত পারফর্ম করতে হবে। তা যত বড় নাটকই হোক। এখানে অভিনেতার লিঙ্গ বিভাজন নেই। অভিনেতা একবার নারী হবেন তো পরের বার পুরুষরূপে মঞ্চে আসবেন। বলা যায়, গৌতম হালদারের মেঘনাদবধ কাব্যের উপস্থাপনাই হলো মুভমেন্ট থিয়েটারের উদাহরণ। তিনি একাই নাচছেন, গাইছেন, নানা চরিত্রে অভিনয় করছেন। এ থিয়েটার যে কোনো ভাষাভাষী মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যায়। কোনো অনুবাদের প্রয়োজন নেই। দর্শক যা দেখবেন, তা থেকেই বুঝে নেবেন এর কাহিনি কিংবা বক্তব্য। কোনো একটি প্রযোজনা থেকে একজন ইংরেজের মনে হবে রোমিও জুলিয়েট আবার বাঙালির কাছে মনে হবে ইউসুফ জোলেখা কিংবা শিরি ফরহাদ।

স্বাধীন বাংলাদেশে এই মুভমেন্ট থিয়েটার আবিষ্কার করেছেন ড. মুকিদ চৌধুরী। তিনি বাঙালি মুভমেন্ট থিয়েটার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, গবেষক, সম্পাদক ও লেখক। দেশে এবং বিদেশে মুভমেন্ট থিয়েটার নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। বিশেষভাবে নাচের ওপর ব্যাপক কাজ করেছেন। তার প্রযোজিত অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলাদেশ ও লন্ডনের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। তার জনপ্রিয় নাটকগুলো হলো—‘অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি’, ‘একটি আষাঢ়ে স্বপ্ন’, ‘কত রঙ’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘জলের ভেতর জলের বিসর্জন’, ‘বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ’ ইত্যাদি। তিনি অনেকগুলো নৃত্যনাট্য নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘সাগরিকা’, ‘তাসের দেশ’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’ এবং ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। তিনি হবিগঞ্জের দেউন্দি চা-বাগানে প্রতীক থিয়েটার এবং শায়েস্তাগঞ্জ থিয়েটারের সঙ্গে তিনটি মুভমেন্ট থিয়েটার প্রযোজনা করেছেন। তার মুভমেন্ট থিয়েটার প্রযোজনার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি চা বাগানে ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট প্রথম নাট্যমঞ্চ তৈরি হয়। একই সঙ্গে আয়োজন করা হয় বাঙালি মুভমেন্ট থিয়েটার উৎসব।

মুকিদ চৌধুরী ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে নাট্যচর্চা শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে শায়েস্তাগঞ্জে গড়ে তোলেন তার নাট্যসংগঠন ‘মুভমেন্ট থিয়েটার’। দেশের মঞ্চ ছাড়াও তার রচিত ‘ঋতু’ (১৯৯৮) ও ‘মৌসুমী’(১৯৯৭) এডিনবরা আর্ট ফেস্টিভ্যালে মঞ্চস্থ হয়। লন্ডনে এ সিজন অব বাংলা ড্রামা উৎসবে ‘কত রঙ’ (২০১১), ‘একটি আষাঢ়ে স্বপ্ন’ (২০১২), ‘অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি’ (২০১৩) ও ‘জলের ভেতর জলের বিসর্জন’ (২০১৫) মঞ্চায়ন হয়। এ ছাড়া লন্ডনের বিভিন্ন উৎসবে তার পরিবেশিত নাটক ‘বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ’ (১৯৯৮), ‘তালতরঙ্গ’(১৯৯৯), ‘শ্যামা’ (১৯৯১), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৯১), ‘সাগরিকা’ (১৯৯৫) প্রভৃতি মঞ্চস্থ হয়। বাংলাদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘চম্পাবতী’ (২০১৭), ‘কর্ণপুরাণ’ (২০১৭), ‘রাজাবলি’ (২০১৭) প্রভৃতি মঞ্চনাটক।

Advertisement

২০১৮ সালে ভারতের হাওড়ার বালিতে ৪ দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. মুকিদ চৌধুরীর রচনায় ৪টি নাটক মঞ্চস্থ হয়। তার রচনায় এ উৎসবে বাংলাদেশ থেকে দুটি, যুক্তরাজ্য ও ভারতের দুটি নাট্যদল পরিবেশন করে তার নাটকগুলো। চিন্ময় দেবনাথের নির্দেশনায় ময়মনসিংহের নাট্যদল নাট্যকথকের প্রযোজনায় ‘কত রঙ’ ও ফখরুল হামিদের নির্দেশনায় শায়েস্তাগঞ্জের নাট্যদল দেশ নাট্যগোষ্ঠীর ‘অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি’, শফিকুল ইসলাম রুবেলের নির্দেশনায় যুক্তরাজ্যের নাট্যদল ওয়েভস এমসির প্রযোজনায় ‘জলের ভেতর জলের বিসর্জন’ ও মৃন্ময় রায় চৌধুরীর নির্দেশনায় ভারতের অংকুর নাট্যসংস্থার প্রযোজনায় ‘বন্ধ্যা’ শিরোনামের নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়।

আরও পড়ুন

সাহিত্যশিল্পীরা সার্থক শিল্পমানে, শিল্পসংখ্যায় নয় উদার আকাশ: সত্যনিষ্ঠতায় তুলনাহীন

নাট্যোৎসবে নাট্যভাস্কর মুকিদ চৌধুরীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে নাট্যকার লিটন আব্বাস বলেছিলেন, ‘ড. মুকিদ চৌধুরীর কৌশল হচ্ছে ‘মুভমেন্ট থিয়েটার’র মাধ্যমে নাটককে তৃণমূল পর্যায়ে খুব সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া ও হৃদয় হরণ করা। এখানেই নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরীর নাটকের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।’ অপরদিকে মৃন্ময় রায় চৌধুরী বলেন, ‘এই উৎসবের গুরুত্ব এজন্যই বেশি অনুভূত হচ্ছে যে, বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ প্রসারিত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত এর উন্নতি সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বছর আমরা বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটারের জনক ড. মুকিদ চৌধুরীকে ‘নাট্যগুরু’ উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর প্রতি আমাদের ঋণ কিছুটা হলেও লাঘব করার চেষ্টা করেছি, এই আমাদের ধারণা।’

২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ নাট্যমঞ্চে দেউন্দি চা-বাগানের প্রতীক থিয়েটারের পরিবেশনায় ‘দ্য টেম্পেস্ট’ অনুসৃত নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরী রচিত ও নির্দেশিত ‘অচীন দ্বীপের উপাখ্যান’ নাটকটি ‘বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটার’ শিল্পশৈলীর আওতায় মঞ্চস্থ হয়। নাটকের জন্য চা-বাগানের সংগীত রচনা করেন ডা. সুনীল বিশ্বাস। ‘অচিন দ্বীপের উপাখ্যান’ নাটকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখানো হয়, একই ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় ভিন্ন-ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, জাতিগত মানদণ্ড ও মূল্যবোধ অনুসারে। এর মাধ্যমে দেখানো হয়, নাটকই গণমানুষের মুক্তির হাতিয়ার। তাই দরিদ্র চা-জনগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতিতে একদিন বাঙালির সামনে দাপটের সঙ্গে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবে, সেটাই ছিল এ নাটকের প্রত্যাশা।

Advertisement

মঞ্চনাটক ছাড়াও বাংলা নাট্যোপন্যাসে ড. মুকিদ চৌধুরীর স্বতন্ত্রচিহ্নিত। তার বিভিন্ন সময়ে লেখা নানা স্বাদের ও ভিন্ন মাত্রার পাঁচটি নাট্যোপন্যাসের সংকলন—অপূর্ণতার পরিপূর্ণতা: নারীমুক্তি কাহিনী-অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি; হৃদয়বিয়োগ কাহিনী-গালিব কিংবা আসাদ; একজন বীরাঙ্গনার গৌরবগাথা-তারকাঁটার ভাঁজে; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অলিখিত চিত্রাঙ্গদা-অর্জুনের প্রণয়াধ্যায়-একটি আষাঢ়ে স্বপ্ন; ইতিহাস আশ্রিত-অচিন দ্বীপের উপাখ্যান। অপূর্ণতার পরিপূর্ণতায় অন্য-এক ড. মুকিদ চৌধুরীকে সচেতনভাবেই আবিষ্কার করা যায়, তিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে নিয়েছেন নিজেকে। এসব থেকে মঞ্চস্থও হয়েছে কিছু কিছু। ২০১৮ সালে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি’। হবিগঞ্জের দেশ নাট্যগোষ্ঠী এটি মঞ্চে আনে।

মঞ্চনাটকের পাশাপাশি নাট্যোপন্যাস এবং নাট্যকবিতা রচনায় মেধা ও মননের পরিচয় দিয়েছেন মুকিদ চৌধুরী। তার ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ’ প্রধানত একটি যুদ্ধবিরোধী নাট্যকবিতা। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের বিভীষিকার এক নিপুণ চিত্রাঙ্কণ, যা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে তোলে এবং যুদ্ধ পরিহার করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তীব্র ভাবনার সৃষ্টি করে। হাজার বছরের বাঙালির স্বাধীনতা রক্ষার একটি কাহিনিই হচ্ছে ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ’ নাট্যকবিতাটি। গাঙ্গেনগরীর এক যুদ্ধে, বিজয়গর্বী আর্যসেনারা পরাজিত বাঙালি গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দকে বন্দি ক্রীতদাসী করে আর্যাবর্তে নিয়ে যেতে চায়। এই নাট্যকবিতায় হাজার বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও উপলব্ধি করা যায়, বাঙালির এক অতীত দুর্ভাগ্যের ইতিহাস, যুদ্ধকালের কিছু অভিজ্ঞতা, হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, উৎপীড়ন এবং বঙ্গদেশের নারীবৃন্দের অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার ভয়াবহ কাহিনি। তদুপরি, যে কোনো যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার ফলে নাগরিক জীবনে যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, বিশেষ করে নারী জাতির ওপর, সেই উপলব্ধিতে নাট্যকবিতাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু তা-ই নয়, তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে মুকিদ চৌধুরীর ছয়টি বই। এর মধ্যে আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে ‘জার্মানি: অতীত ও বর্তমান’ এবং আদিত্য প্রকাশ থেকে ‘জার্মান সাহিত্য: প্রারম্ভ থেকে অধুনা’, ‘যোদ্ধা’, ‘অনাহূত অতিথি’, ‘ত্রয়ী’ ও ‘মগ্নপাঠ: সুরা বাকারাহ’। ‘জার্মানি: অতীত ও বর্তমান’ বইয়ে বিশদভাবে জার্মানির সুদীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, কূটনীতি, আর্থসামাজিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে। ‘জার্মান সাহিত্য: প্রারম্ভ থেকে অধুনা’ বইটি জার্মান সৃজনশীল চিন্তাধারার এক পরিপূর্ণ ইতিহাস। ‘যোদ্ধা’ বইয়ে উঠে এসেছে ময়নামতির (ত্রিপুরা) সুপ্রতীক মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের পাপাচার ও তার পরিণামের এক মর্মবিদারী বিষয়। কবিতাসম্ভার ‘অনাহূত অতিথি’ মূলত মা-মাটি-মানুষের এক অশ্রুসিক্ত লবণাক্ত ছবি। তিনটি নাটক নিয়ে প্রকাশিত বই ‘ত্রয়ী’। নাটক তিনটি হলো- ‘যোদ্ধা’, ‘কলকাতায় মির্জা গালিব’ ও ‘আটই ফাল্গুন’। ‘মগ্নপাঠ: সুরা বাকারাহ’য় ইসলামিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। নাট্যচর্চা এবং সাহিত্যচর্চায় সমানতালে এগিয়ে চলেছেন গুণী এই নাট্যব্যক্তিত্ব।

ইতিহাসের প্রতিও তার বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তিনি লিখেছেন- ‘নেপোলিয়ন বোনাপার্ট’, ‘ইংল্যান্ড: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, ‘ফরাসি বিপ্লব’, ‘রাজা গৌর গোবিন্দ’, ‘ডাকাতিয়া নদীর ইতিকথা’ প্রভৃতি। সবমিলিয়ে তার চল্লিশটির মতো বই প্রকাশিত হয়েছে। নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরী সত্যিকার অর্থেই সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ মূল্যায়নের দাবি রাখেন। তার রচনাসম্ভার পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। তাকে জানার আগ্রহ তৈরি হোক। আমি তার নাটক ও সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।

এসইউ/এমএস