সাহিত্য

শামীম রেজা: বহুমাত্রিক শিল্পজন

এমরান কবির

Advertisement

কবি শামীম রেজাকে নিয়ে লিখতে গেলে দ্বিধায় পড়তে হতে হয় তার পরিচয় নিয়ে। কী হিসেবে সম্বোধন করা হবে তাকে। কবি? লেখক? নাট্যকার? কথাসাহিত্যিক? প্রাবন্ধিক? সাংবাদিক? সংগঠক? সাহিত্য সম্পাদক? অধ্যাপক? প্রতিষ্ঠাতা? (বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম (এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র) তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা)। শিল্প-অভিভাবক?

এতসব দ্বিধার মধ্যে যেসব পরিচয়সূচক শব্দ বা শব্দবন্ধ উপস্থাপিত হচ্ছে—এককভাবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তার রয়েছে স্বতন্ত্র ছাপ ও স্মারক। তাই সীমিত শব্দের মাঝে একজন শামীম রেজাকে তুলে ধরা অসম্ভব। এসবের বাইরে মানুষ হিসেবে তিনি যে উচ্চতার—ব্যক্তিত্বে, পরোপকারে, সৌহার্দে, সাহসিকতায়—তার কোনো তুল্য মূল্য নেই।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’য় তিনি যে নদীময় আত্মিক আলেখ্য রচনা করেছেন তা তুলনাহীন। তিনি এই কাব্যে দেখিয়েছেন আমাদের যাপিত জগতের ভেতরে নির্মিত অন্য এক অনুভূতিময় আত্মিক জগতের রূপ। এই জগৎ দিবালোকের মতো স্পষ্ট নয় কিংবা অন্ধকারের মতো দুর্ভেদ্যও। আধো আলো আধো আঁধারি। যেন দিনরাত্রির সংযোগস্থলে সংঘটিত কোনো এক লৌকিক-অলৌকিক সত্তা। ওই সত্তা কিন্তু মস্তিষ্ক উদ্ভূত নয়। আমাদের বৈশ্বিক মিথ, লোকজীবন আর এগুলোর রসায়নে সংশ্লেষিত অন্য রকম এক প্রাগৈতিহাসিকতা।

Advertisement

‘নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে’ কাব্যেও তিনি প্রকৃতিলগ্ন। পাথরচিত্রে নদীকথায় যেখানে নদী ও নদীসংলগ্নতার আলেখ্যের ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করিয়েছেন আমাদের বাংলায়—নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়েতে তিনি আরও গভীরতরভাবে হয়ে উঠেছেন কালসচেতন। পরিচর্যাহীন সময়ে জীবন থেকে যখন সকল অর্থ উধাও হয়ে যায়; তখনই তো কবি সে-অর্থ উদ্ধারে তৎপর হয়ে ওঠেন, ইঙ্গিত দেন তার শিল্পে। নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়েতে সে-ইঙ্গিত আমরা পাই। কবিতায় অনেক ‘ছিল’—এর সন্ধান পাওয়া যায়। বুঝে নিতে হয় এই ‘ছিল’র মাঝেই সুপ্ত ইঙ্গিত—এখন নেই। কী নেই? নদী নেই, পাখি নেই, রোদ নেই, বৃক্ষ নেই। এগুলো না থাকলে কী হয়? এগুলো না থাকলে বাংলা থাকে না। বাংলা না থাকলে কী হয়? বাংলা না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব থাকে না। অস্তিত্ব না থাকলে কী হয়? জীবনের অর্থও থাকে না। কবি শামীম রেজা সেই জীবনের অর্থের স্বারস্বত তাৎপর্য তুলে আনেন।

‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যে তিনি কবি হিসেবে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান। প্রচল ভাষা বা প্রমিত ভাষা এড়িয়ে এমন এক ভাষায় তিনি এই কাব্য লেখেন, যা এযাবৎকালের বিনির্মিত সকল নিজস্ব-কাব্যভাষা থেকে আলাদা। এ তো গেল কাঠামোর কথা। এর অন্তরে তিনি প্রবাহিত করে দেন এই অঞ্চলের হাজার বছরের প্রবাহমান চিত্র। এই চিত্র বহুরৈখিক, বহুবর্ণিল। বহু কৌনিক অবস্থান থেকে কবির ফেলা শৈল্পিক আলো বহুবিকিরণে উজ্জ্বল। দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকারে ভরা। এর ভেতরে যে চিত্র ও চিত্ররূপতা তা এ অঞ্চলের দীর্ঘ ইতিহাস যাত্রা, এর বিবর্তন, এর শোষণ, এর নিপীড়নসহ ইত্যকার প্রকৃতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিবৃত্ত। গভীর পরিব্রাজক ছাড়া এই ইতিহাস কবিতায় আনা যায় না। এক কথায় এই কাব্য এই অঞ্চলের এক ল্যান্ডস্কেপ।

‘ব্রহ্মাণ্ডের ইশকুল’ মহাকাব্যপ্রতীম দীর্ঘ কবিতা। সাম্প্রতিক কবিতার ইতিহাসে যা উজ্জ্বল সংযোজন। দীর্ঘ কবিতা লেখার জন্য যে দম লাগে, ধারাবাহিকতা লাগে, পরম্পরা লাগে এবং শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে হয়—ব্রহ্মাণ্ডের ইশকুলে এইসব উপাদান নিপুণভাবে প্রথিত। এর আলেখ্যের ভেতরে পুরাণের নান্দনিক ব্যবহার ও উপস্থিতি কাব্যটিকে বিশেষভাবে শক্তিশালী করেছে। নব্বইয়ের কবিতার যে ধারা তার সাথে এই কাব্যপ্রয়াস সম্পূর্ণ বেমানান। শামীম রেজা সেই বেমানান কাব্যপ্রয়াসকেই বেছে নিয়েছেন। এই বেমানান বিষয়টি তার স্বাতন্ত্রের পরিচায়ক।

‘হৃদয়লিপি’ চতুর্দশপদী কবিতা। পঞ্চাশটি কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে তিনি যে মর্ম প্রচার করেছেন তা আমাদের বহিরাঙ্গিক আচার ও প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে স্থাপিত হৃদয়িকতার কথা বলে। তিনি বলতে চেয়েছেন হৃদয়ধর্মে প্রণয়ই শেষ্ঠ। হৃদয়ে যদি প্রেম থাকে তাহলে সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ সেখানে গৌণ। তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতার বাহিরে গিয়ে মানব-মানবীর সম্পর্ককে হৃদয়ের আলোকে মেপেছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন• বিষাদের ছায়া: শফিক রিয়ানের জীবন-দর্শনউদার আকাশ: সত্যনিষ্ঠতায় তুলনাহীননিহিলিজম: সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়

‘ঋতুসংহারে জীবনানন্দ’ তার গল্পগ্রন্থ। গল্পের ভেতরে আমরা গভীরতরভাবে যে বহুরৈখিক বিস্তারের কথা বলি, শক্তিশালী গদ্যের কথা বলি, চরিত্রের মনোবিশ্বের গভীরে গিয়ে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের কথা বলি, সমাজের সংকটের কথা বলি, সংকটের গভীরে কারণ অনুসন্ধানের কথা বলি, কিংবা শৈল্পিক দ্বিধার কথা বলি, বাস্তবতার ভেতরে নিহিত বাস্তবতার জাদুর কথা বলি, কাহিনির আড়ালের কাহিনির কথা বলি—ঋতুসংহারে জীবনানন্দ গল্পগ্রন্থের প্রতি পরতে পরতে এইসব উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের একটি গল্প ‘জীবনানন্দ ও মায়াকোভস্কি জোসনা দেখতে চেয়েছিলেন’ পাঠককে গভীরতর ঘোর ও আকর্ষণের ভেতরে নিয়ে যায়। যেন জীবনানন্দ, জোসনা ও মায়াকোভস্কির সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্ট অদ্ভুত এক জগৎ। এই জগতে আছেন স্বয়ং জীবনানন্দ। রয়েছে জোসনার রহস্যময় আবহ। রয়েছেন মায়াকোভস্কির জটিল জীবন যাত্রার সাথে জড়িয়ে পড়া কতিপয় একবিংশের তরুণ। গল্পলেখার এই ধরন সত্যিই বিস্ময়কর।

‘সময় ও সময়ান্তরের চিত্রকল্প’ শামীম রেজার প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও কবি শামীম রেজা স্বকীয়তার পরিচয় দেন। বিষয়ে, প্রকরণে ও উপস্থাপনে। শুধু তাই নয় তিনি স্পষ্টবাদী, সাহসী, অকুতোভয়। শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে আমরা কেন ইউরোপমুখী তা বিশ্লেষণ করেন তিনি নির্মোহ হয়ে, কঠোরতার সাথে। বলতে ভয় করেন না বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার কথাও। একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘যে পন্ডিত যতটি বিষয়ে দক্ষ, যাঁর গ্রন্থসংখ্যা যত বেশি তিনিই হতেন মহাচার্য, আচার্য। এখন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখতে পাই এর উলটো চিত্রটি, যে যত বেশি রাজনৈতিক, তিনিই ক্ষমতাবান শিক্ষক, তিনিই আচার্য ইত্যাদি। প্রবন্ধেও তিনি দেশজ সত্তার সন্ধান করেছেন।’

‘করোটির কথকতা’ শামীম রেজার একমাত্র নাটক। এখানেও তিনি স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়েছেন। পাহাড়ি জনপদের বিরুদ্ধে বাঙালি সেনার নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড এই নাটকের মূল উপজীব্য। নাটকে তিনি কাব্যিক সত্তার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চস্থ এই নাটক দেখে অনেক নাট্য-বিদগ্ধজন ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু তিনি নাটকচর্চায় রত থাকেননি। নাট্যকর্মীদের এটি নিয়ে এখনো আক্ষেপ করতে দেখা যায়।

‘ভারতবর্ষ’ শামীম রেজার উপন্যাস। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কোনো প্রতিবাদের শাস্তি হিসেবে কয়েকজন তরুণকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালানো হয়। সেই বন্দিদের ঘিরে একজন কথক বলতে থাকেন। উপন্যাসের শুরু হয় এভাবে কথকের বয়ানের মাধ্যমে। এরপর কথকের পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন কথকের সূত্র ধরে ধরে এগিয়ে যায় উপন্যাস। বিশাল প্রেক্ষাপটের এই উপন্যাস মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। বহু ঘটনা, বহু ডালপালা, বহু বিস্তার এই উপন্যাসে।

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ‘ধানসিঁড়ি’। দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের সাহিত্যপাতা সুবর্ণরেখা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি তার স্বাতন্ত্রের পরিচয় দেন। এরপর দৈনিক কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতা শিলালিপি সম্পাদনা করেন। একটি দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পাদনার ক্ষেত্রে কী ধরনের ও কত ধরনের সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেওয়া যেতে পারে তা সুবর্ণরেখা এবং শিলালিপি সম্পাদনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন কবি শামীম রেজা।

একাডেমিক ক্ষেত্রেও তিনি ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নিম্নবর্গের মানুষ: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার কবিতা-তুলনামূলক আলোচনা’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি অর্জন করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগ’। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র।

এসবের বাইরে একজন শামীম রেজা তরুণ কবিদের আশ্রয়। বিপদের সহযাত্রী। সংকটে বন্ধু। আমরা যারা তার অনুজ; তারা সৌভাগ্যবান যে আমরা একজন শামীম রেজাকে পেয়েছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা কেউ শামীম রেজা হতে পারিনি। আজ শামীম রেজার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে প্রণতি জানাই।

লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/এমএস