সাহিত্য

মানিক পালের দুটি কবিতা

কোন মুখে দাঁড়াবো

Advertisement

একুশ এলে এখন আর প্রভাত ফেরিতে যাই না।কেন যাবো,কোন মুখে দাঁড়াবো গিয়ে শহীদ মিনারে?কারণ আমি তো খালি পায়ে হাঁটতে পারি না,দামি জুতো ছাড়া এক কদম চলতে পারি না এখন!

আমি যে ভুলে গেছি আমার বর্ণমালার বর্ণ-পরিচয়!

আমার সন্তানেরা পরীক্ষার খাতায়সবচেয়ে কম নাম্বার পায় বাংলায়,কারণ ওরা বাংলায় কাঁচা!

Advertisement

আমার সন্তান ভিন্ন ভাষার গান গেয়ে-গেয়েআজ নামিদামি শিল্পী,আমার সেই পুরোনো হারমোনিয়ামটায় ঘুণ ধরেছে;কারণ এখন হারমোনিয়ামটা কাজে লাগে না!আমি এখন আর ওটা হাতে নিই না।ওটার সুর-ধ্বনি এখন বড্ড বেমানান,আমার ছেলে-মেয়েরা এখন পিয়ানো, গিটার বাজিয়ে গান করে!

আমার দাদুর হাতের একতারাটা ধুলোয় গড়াগড়ি খায়,চিলেকোঠার অকেজো জিনিসপত্রের ভিড়ে! আমার বাবার বাজানো বাঁশিটা পড়ে আছে অনাদরে!

আমার মা, আমার শিক্ষিতা স্ত্রীর সাথে কথায় পেরেওঠেন না,কারণ আমার জন্মদাত্রী মা ইংরেজি জানেন না,আমার পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না বলে মাকে দিয়ে এলাম বেশ আগেই বৃদ্ধাশ্রমে!

আমি কোন মুখে দাঁড়াবো গিয়ে শহীদ মিনারের কাছে?আমি তো আমার অস্তিত্ব বিকিয়ে দিয়েছি অজান্তেই!ভীষণ লজ্জা লাগে যখন একুশ আসে,যখন ভোরবেলায় প্রভাত ফেরির সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কোরাস গানটি এসে আমার শ্রবণেন্দ্রিয় স্পর্শ করে,আমি তখন দু’হাতের তর্জনী দিয়ে শক্ত করে ঢেকে রাখি আমার দুটি শ্রুতিপথ।

Advertisement

আমি তখন চোখ ঘুরিয়ে দেখি আমার ঘরের বিদেশি আসবাবপত্রের মাঝে কেমন একটা বিদ্রূপের হাসি,আমি ভাবতে থাকি আমি কি ভিনদেশি, নাকি বাঙালি-বাংলাদেশি!

আমার গায়ের স্লিপিং ড্রেসটা আমাকে বার বার যেতে বারণ করে প্রভাত ফেরিতে,আমার সন্তানের পাঠানো বিদেশি কম্বলখানি বার বার গভীর মোহ মায়ায় আটকে রাখে ভবনের চার দেয়ালের ভেতরে!

তাই আমি আর একুশ এলে ভোরবেলাতে প্রভাত ফেরিতে যাই না,কেন যাবো!কোন মুখে দাঁড়াবো গিয়ে শহীদ মিনারের কাছে?

**

শহীদ মিনারের কষ্ট

‘শহীদ মিনার’ বলছিআমি—ইট পাথরে গড়া,সবাই বলে লক্ষ প্রাণের রক্তের স্মৃতি ঘেরা!

কত ব্যথা মোর বক্ষ অতলে কার কাছে খুলে কইনিজেই নিজের লজ্জা ঢাকিএকা-একা সব সই!

কোথায় লালন-বাউল বাংলার ভাটিয়ালি সব গীতিকোথায় আমার জীবনানন্দেররূপসী বাংলার স্মৃতি?

কোথায় আমার স্নেহের ডাকামা-বাবা আর ঠাম্মি?সবার মুখে শুধুই যে আজড্যাড, ব্রাদার আর মাম্মি!

একুশ এলেই মুখে মুখে শুনিশহীদ প্রেমের গান,ইট পাথরের পাঁজর ভেদিজেগে ওঠে মোর প্রাণ।

কথায়-কথায় ভিনদেশি বোলবাংলায় শত ভুলএকুশ এলেই ভাষার প্রেমে আমার আঙিনায় ফুল!

একুশ এলে প্রাণ জাগে মোরকরে শুধু হাহাকার,সবার কাতারে দাঁড়ায় যখন দেখি কত রাজাকার!

একুশ এলে লাখো জনতার যখন নামে ঢলফুল পাহাড়ের তলায় দেখো আমার চোখের জল।

এসইউ/এএসএম