পরিবার হচ্ছে শাশ্বত বিদ্যালয়। প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্বে বলা হয়েছে যে, ছয় বছর বয়স পর্যন্ত একটি শিশুকে আচরণ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এ শিক্ষা বিদ্যালয়ে নয় বরং তা হবে পরিবারের মধ্যে। আচরণ শিক্ষা বলতে বোঝায় কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে, চলতে হবে, বসতে হবে ইত্যাদি। তাছাড়া দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাও আচরণ শিক্ষা হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন- গোসল, খাওয়া-দাওয়া, শৌচকর্ম, পোশাক পরিধান রীতি, ধর্মচর্চা ইত্যাদি দক্ষতাভিত্তিক আচরণ শিক্ষা। শৈশবকালে প্রকৃত ব্যবহার বা আচরণ শিক্ষায় শিশুকে গড়ে তুললে ভবিষ্যতে তা সম্পদে পরিণত হয়। বড় হয়ে গেলে এগুলো অর্জন করা যায় না। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কের অধিকাংশ বিকাশ ঘটে। এ সময়টাতেই ব্যবহার তথা যে কোনো শিক্ষার বুনিয়াদ সৃষ্টি করতে হয়। এ সময়ে শারীরিক-মানসিক বিকাশটাও যদি সঠিক পথে হয়, তবেই ভবিষ্যৎ আলোকিত হয়। শিশুর পুষ্টি বিষয়টাও এ বয়সে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অপুষ্ট শিশুর মগজ যেমন পরিপুষ্ট হয় না, আচরণ ও তেমন ইতিবাচক হয় না। তাই দশ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর ভাগ্য অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যায় বলে আমি মনে করি। আর এসব কাজ তথা শিক্ষা দিতে হবে মূলত মা-বাবকেই। পাশাপাশি পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য শিশুর আচরণ, তথা ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করবেন।
Advertisement
যথার্থ পারিবারিক শিক্ষা অর্জন সহজ হয় যৌথ বা বর্ধিত পরিবারে। একক পরিবারে যেটা অনেকটাই কঠিন হয়ে যায়। সব শিক্ষা হয় ইন্টারেকশন, কাজ করে, শোনা বা দেখার মাধ্যমে। যৌথ পরিবারে লোকজন বেশি হওয়ায় আন্তঃক্রিয়া বেশি ঘটে। তাই শিক্ষাটাও শিশুর জন্য সহজ হয়ে যায়। সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটে যখন শিশুরা একসঙ্গে আন্তঃক্রিয়া বা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। হ্যাঁ, এসময় কিছু দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। সেটাও এক ধরনের শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করে। কেন ঝগড়া লাগলো, কীভাবে তা সমাধান করা যায় সেগুলোও শিশুরা জানতে পারে। বিভিন্ন কাজের দক্ষতাও শুরু হয় পরিবার থেকেই। যেমন- কৃষিকাজ, রান্নাবান্না, কম্পিউটার অপারেটিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ক্ষুদ্র প্রকৌশলবিদ্যা, ইলেকট্রিক্যাল ইত্যাদি আসলে পরিবার থেকে হাতেখড়ি নিতে হয়। অল্পে তুষ্ট থাকা, ভাগ করে খাওয়া, পড়ার টেবিল ভাগ করা ইত্যাদি যৌথ পরিবারের অন্যতম আদর্শ শিক্ষা। দারিদ্র্য, অভাব, কষ্ট, বৃদ্ধদের সেবা, বাজার করার শিক্ষাটা বর্ধিত তথা যৌথ পরিবারেই সম্ভব হয়। এটা ঠিক, বিশ্বায়নের যুগে বর্ধিত পরিবার টিকিয়ে রাখাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
একক পরিবারে ঠিক উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা যায়। এ পরিবারগুলোয় শিশুরা মূলত বস্তুর সঙ্গে আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে বড় হতে থাকে। যেমন- তারা বিভিন্ন খেলনা, টেলিভিশন, ট্যাব আর বর্তমানে মোবাইল ফোনে গেইম ও কার্টুন দেখে দেখে বড় হতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় মগজের বিকাশ হলেও আত্মার ও মনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তবে মগজের বিকাশও সুচাররূপে হয় বলে মনে হয় না। কারণ মনের বা মূলবোধের বিকাশ যখন বাধাগ্রস্ত হয়; তখন মাথাও ভালো কাজ করবে না। কারণ মাথা তখন অস্থির ও অসংলগ্ন থাকায় সে কাজে ও ব্যবহারে মনোযোগ হারায়। এমন অবস্থায় একজন শিশু পার্থিব বিষয়ে বেশি মনোযোগী হবে। যা মানবিক বিষয়গুলো তার মন থেকে সরিয়ে দিতে থাকবে। ঐতিহ্যগত ব্যবহার, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ হারাতে হারাতে নতুন সমাজের জন্ম হবে। আমার মনে হয়, নতুন সমাজের জন্মের মধ্য দিয়ে বর্তমানে আমরা যাচ্ছি। এ সমাজে পাশ্চাত্য প্রভাব ও ধর্মীয় লেবাস থাকলেও প্রকৃত ধার্মিকতা তার জৌলুস হারাতে বসবে। আমরা মনে হয় সেই সময়টা পার করছি।
পরিবারে মূলত পরীক্ষায় ভালো ফলের যে পুঁথিগত বিদ্যা তা-ই আমরা আওরিয়ে যাচ্ছি। মা-বাবা সন্তানকে হাতেকলমে বা মুখোমুখি বসিয়ে আচরণ শিক্ষা দেবে, সে সময়টাও নেই। যেমন- সন্তান সকাল ৬টার সময়ই কোচিংয়ে দৌড়াচ্ছে। আবার বিকেলে যাচ্ছে অন্য কোচিংয়ে। ইতোমধ্যে বাবা-মাও চলে যাচ্ছে কর্মস্থলে, আসছেন রাতে। ততক্ষণে সবাই ক্লান্ত। কে কাকে ব্যবহার, আচরণ বা সামজিক শিক্ষা দেবেন। সবাই যাচ্ছেন বিছানায় রাতের ঘুমে। এরপরও মা-বাবা যখন সময় পান; তখনও সন্তানকে আচরণ শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে সম্পদের হিসাব বা বাইরে অর্থহীন ঘোরাঘুরিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে শিশুরা বুঝতেই পারছেন না দাদা, নানা বা প্রতিবেশীর সঙ্গে তার ব্যবহার কেমন হবে।
Advertisement
বড় হওয়ার পরে কেউ যদি ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সেই শিশু তখন খটকার জালে আটকে যায়। শিশুরা যেহেতু মা-বাবার কাছ থেকে যথাযথ আচরণ বা মূল্যবোধ শিক্ষা পাচ্ছে না, তখন তারা শিখছে ফেসবুক বা ইউটিউব থেকে; যেগুলো অপ্রকৃত বা মূল্যবোধহীন শিক্ষা দ্বারা পরিপূর্ণ। সন্তানরা মনে করছে এটাই আমাদের প্রকৃত শিক্ষা; কারণ অন্যকিছু তার সামনে নেই। আছে শুধু সোশ্যাল মিডিয়া। এ মিডিয়াগুলোর সবকিছুই খারাপ, তা আমি বলছি না। কিন্তু শিশুর জন্য কনটেন্ট সেগ্রেগেইট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর সেখানেই সমস্যাটা তৈরি হয়। এ কনটেন্ট বাছাই করার ক্ষেত্রেও মা-বাবা বা গুরুজনেরা এগিয়ে আসতে পারেন। না হলে তারা বন্ধু-বান্ধব দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে উঠবে। সোশ্যাল মিডিয়া মানেই বেশি বেশি ভার্চুয়াল বন্ধু, যারা ভার্চুয়ালই থাকেন, মানবিক বিষয়গুলো তাদের কাছ থেকে অপসারিত হতে থাকে। সন্তানের আসল বন্ধু তাহলে হতে হবে মা-বাবা, ভাই-বোনদের। এরা একসঙ্গে ফেসবুক চালাবে, ইউটিউব চালাবে। আস্তে আস্তে মা-বাবা সন্তানকে ভালো কনটেন্টগুলোতে প্রবেশ করাতে শেখাবে। যদিও কাজটা এত সহজ নয়। তবে যতটুকু হয়, ততটুকুই লাভ। সর্বদা চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো দিকগুলোর সঙ্গে প্রাকৃতিক বা জিনেটিক প্রভাবে আস্তে আস্তে শিশুরা রাস্তা খুঁজে পাবে।
কিন্তু সমস্যা হলো মা-বাবারও তো সময় নেই। অফিসের কাজে এতটা ব্যস্ত থাকেন তারা, সন্তানকে শিক্ষা তথা প্রকৃত বিনোদনের আবহ তৈরি করার মতো সময় দিতে পারছেন না। অন্যদিকে জীবনটা দিন দিন জটিল হয়ে পড়ছে। যেমন- বাড়ি, গাড়ি, আসবাবপত্র করার প্রতিযোগিতাটা মনে হয় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য এক ধরনের আজাব। এ প্রতিযোগিতা থেকে যখন আমরা বের হতে পারছি না, তখন মা-বাবাও অফিস থেকে এসেই টাকা-পয়সার হিসাব ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সময় পাচ্ছেন না। দিন দিন বাজার উত্তপ্ত হওয়ায় বা সামাজিক অসাম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় টাকা-পয়সার হিসাবটা সব সময় মাথায় ঘুরপাক খায়। সন্তানরা এ হিসাব-নিকাশের বলি হচ্ছে নীরবে। আবার মা-বাবা যদি অসৎ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে সন্তানের মূল্যবোধ শিক্ষাটা যেন চিরদিনের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ শিশুরাও অসৎ মা-বাবার বাহ্যিক আচরণটাই শিখতে থাকে। যেমন- অহংকার, বিলাসী জীবন, সত্য-মিথ্যার বাছ-বিচার না করার প্রবণতা তাকে পেয়ে বসে। সন্তানরা তখন মেকি আনন্দের জালে আটকা পড়ে জীবন শেষ করে দেয়। তারা মনে করে এটাই আসল জীবন। ভদ্র বা বিনয়ী ছেলেমেয়েদের তারা শুধু এড়িয়েই চলে না, তারা মনে করে এসব ছেলেমেয়ে সেকেলে, নিম্ন পরিবারের। তাই তারা তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেও পিছপা হয় না। ফলে সমাজে দ্রুতই বিভাজন সৃষ্টি হয়। আমাদের শিক্ষিত নারীরা এখন অফিস-আদালতে চাকরি করছেন। এটি সমাজের ইতিবাচক রূপান্তর। তবে এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, যা দূর করার জন্য সচেষ্ট থাকা দরকার। অফিস চলাকালীন সন্তান কীভাবে নারচারড হবে, এ বিষয়টা অ্যাড্রেস করা জরুরি বলে মনে করি। যেমন এক্ষেত্রে বর্ধিত পরিবারের সদস্যরাই হতে পারে প্রধান অবলম্বন। দাদা-দাদি, নানা-নানিরাই এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারেন। অন্যদিকে ডে-কেয়ার বা চাইল্ড হোম আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খুব বেশি যায় না। বিধায় তা খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।
পরিবারভিত্তিক ধর্মশিক্ষা, যা নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে; তা-ও সংকুচিত হচ্ছে বলে মনে হয়। আগে ধর্মগ্রন্থ চর্চার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা ছিল একটি আদর্শ। কিন্তু এখন নৈতিক শিক্ষার প্রভাবটা কমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। শৈশবকালে ধর্মগ্রন্থটা কোনোরকম শেষ করেই শিশুরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষায়। এখানে পড়ালেখার চাপ এত বেশি যে, তাদের বইয়ের ব্যাগকে বহন করতে হচ্ছে বাড়ির গৃহকর্মীকে। এসব করতে গিয়ে নৈতিকতাভিত্তিক ধর্মশিক্ষা আর নেওয়া হচ্ছে না। ফলে আচরণ থেকে যাচ্ছে অপূর্ণ। কর্মজীবনে এর বিশাল প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ একজন অফিসিয়েল জানেনই না, তাকে কার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে। বিশেষ করে সেবাগ্রহীতারা বরাবরই হয়রানির শিকার হচ্ছে। মূল্যবোধ বা বিবেক তাকে কামড় দিচ্ছে না। ফলে ওই অফিসিয়েল যা বলছেন বা করছেন; তা তার কাছে সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। ফলে শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, বিনয়, শালীনতা ও লজ্জা ধারন করা প্রতিটি বিষয়ই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এসবের ফলে মানুষের মনের প্রশান্তি হ্রাস পাচ্ছে। টাকা-পয়সা আছে, গাড়ি-বাড়ি আছে কিন্তু মনে শান্তি নেই। তাই নৈতিকতাভিত্তিক পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মশিক্ষা খুবই জরুরি। তবে অবশ্যই এসবের জন্য আধুনিক শিক্ষা যেন বাদ না পড়ে। অন্যথায় যুগ থেকে ছিটকে পড়তে হবে। সেটাও একজন মানুষের জন্য কাম্য নয়। কারণ মানবজাতির বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি নেই। টেকসই সমাজব্যবস্থার জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তি শিক্ষা আমদের জন্য জরুরি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।
Advertisement
এসইউ/জিকেএস