অলোক আচার্য
Advertisement
গণহত্যা শব্দটি দ্বারা মূলত নির্বিচারে নিরপরাধ নারী-পুরুষ সবাইকে হত্যা করা বোঝায়। এটি একটি পরিকল্পিত নারকীয় অধ্যায়; যখন জীবনের মূল্য থাকে শাসকের অস্ত্রের সামনে। জেনেভা কনভেনশন ও জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী, গণহত্যা এমন এক কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়। আবার ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত ২৬০(৩) রেজুলেশনের অনুচ্ছেদ-২ এর অধীনে গণহত্যার যে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তাতেও বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি প্রমাণিত হয় (জেনোসাইড মিউজিয়াম বিডি ডটকম)।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু গণহত্যার নজির রয়েছে। পলিটিক্যাল ইন্সাটাবিলিটি টাস্ক ফোর্সের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৫৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৪০টি গণহত্যা সংঘটিত হয়, যেখানে শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রাণ হারানো মানুষের পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ। ভয়ংকর সে হত্যায় লাখ লাখ নিরীহ নির্দোষ মানুষের প্রাণ গেছে। আমাদের দেশেও এই নির্মম মুহূর্তটি এসেছিল। এক ভয়ংকর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে সেই রাতে এদেশের মাটি রক্তে ভিজেছিল। ২৫ মার্চ কালরাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে অন্তত ৫০ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান বলে বিভিন্ন তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরবর্তী ৯ মাসে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী শুধু পঁচিশে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ঘটনা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
Advertisement
এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
গণহত্যা সভ্যতার ইতিহাসে নতুন কোনো ইতিহাস নয়। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার মধ্যে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া, কম্বোডিয়া, হলোকাস্ট, ন্যানকিং এবং আর্মেনীয় গণহত্যা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য গণহত্যা। দারফুর গণহত্যাকে একুশ শতকের নৃশংসতম গণহত্যা হিসেবে ধরা হয়। আর রুয়ান্ডার গণহত্যায় ১৯৯৪ সালে সে দেশের সংখ্যালঘু টাটসি গোষ্ঠীর মানুষ এবং সংখ্যাগুরু হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে উদার ও মধ্যপন্থিদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল।
২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের গণহত্যার কথায় উঠে আসে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রে। একটি সাহসী নির্মাণ, যা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানিদের নির্মমতা পর্দায় তুলে ধরেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিরীহ বাঙালির ওপর অকথ্য নির্যাতন, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দুঃখ, বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের দিনকাল ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছিল।
তথ্যে জানা যায়, চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল এক অজ্ঞাত স্থানে। এখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। একটি চলচ্চিত্র কী ভূমিকা রাখতে সক্ষম, তার প্রমাণ স্টপ জেনোসাইড চলচ্চিত্র। স্টপ জেনোসাইড একটি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশটিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কীভাবে দমাতে চাইছে, তার প্রামাণ্য উদাহরণ।
Advertisement
বিশ্বের কাছে এই নিপীড়নের বার্তা পৌঁছে দেয়। প্রামাণ্যচিত্রটির শুরু হয়েছে লেলিনের বাণী দিয়ে। মূলত নির্যাতনের চিত্র, এত সংগ্রামের পরেও আমরা মুক্তি চাই, প্রতিরোধ গড়তে চাই এবং জুলুমের শেষ চাই এই প্রতিজ্ঞা ছিল প্রামাণ্যচিত্রটিতে। শুরুতেই গ্রামীণ কিশোরীর ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য। দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ, কাকের ডাক, গুলি, ব্রাশ ফায়ার, বুলেটের শব্দ, আর্তচিৎকার প্রভৃতি শব্দ শোনা যায়। কিশোরীর প্রথমে মুখে থাকা হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। একটি শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে মানুষ কীভাবে পালিয়ে যাচ্ছে, তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট দেখানো হয়। বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করা হয়। চলচ্চিত্রটি দেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার চলচ্চিত্র বিভাগকে এটি কিনতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিতরণ করার নির্দেশ দেন।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্রতিরোধকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে প্রচার করছিল। কিন্তু আদতে এটি একটি জাতির অস্তিত্বের লড়াই, স্বাধীনতার লড়াই এটিও স্পষ্ট করে দেন এই চলচ্চিত্রে। পাকিস্তানিরা যে নারকীয় পরিবেশ পূর্ব বাংলায় তৈরি করেছে, সেটাও দেখানো হয়। অসংখ্য আলোকচিত্রের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরা হয়। সেই সময় বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি বিশ্বের জনমত গঠনেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্টপ জেনোসাইড জহির রায়হানের অনবদ্য এক সৃষ্টি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, পাবনা।
এসইউ/এমএস