সাহিত্য

বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

বাংলার মহীয়সী নারী বেগম শেখ ফজিল্লাতুনেছা মুজিব। যিনি প্রজ্ঞা, ধৈর্য, সাহসিকতা, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে পালন করেছেন নারী জীবনের সব দায়িত্ব। পাশাপাশি রাজনীতিবিদ না হয়েও দেশের দুঃসময়ে জনগণকে আগলে রেখেছেন নিজের মেধা ও বিচক্ষণতা দিয়ে। যার জন্য সবার কাছে তিনি ‘বঙ্গমাতা’ হিসেবে সমাদৃত। শেখ ফজিলাতুন্নেছার শৈশব-কৈশোর কেটেছে টুঙ্গিপাড়ার প্রকৃতির কোলে; পাখি ডাকা, গাছগাছালি ঘেরা মধুমতী নদীর তীরে। শৈশব থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, মানসিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা; প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। বঙ্গমাতা তাঁর সামগ্রিক জীবনাচরণের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন এবং যাপিত জীবনকে। সে জন্যই তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিতে পেরেছিলেন একজন লড়াকু আদর্শ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে।

Advertisement

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থেকেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস ছিলেন বেগম মুজিব। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জাতির পিতার পাশে থেকে দেশ ও জাতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর কর্মের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন একটি সংগ্রামমুখর জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে জীবন কোটি জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের সঙ্গে দ্বিধাহীনভাবে যুক্ত হয়েছিল ত্যাগ ও নিপীড়ন মোকাবেলা করার দৃপ্ত প্রতিজ্ঞায়।

ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু যে পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, শেখ ফজিলাতুন্নেছাও সেই একই পরিবেশে বড় হয়েছেন। এমনকি একই পরিবারে বেড়ে ওঠেন। স্বাভাবিকভাবেই মুজিবের আদর্শ, তাঁর সহজাত মানসিকতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাসী সত্তা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। সেই কিশোরী বয়স থেকে সব ক্ষেত্রে স্বামী মুজিবকে সমর্থন করার মধ্যে এটি লক্ষ্য করা যায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়েছেন। মনোবল ও সাহস জুগিয়েছেন। অপরিসীম প্রেরণা জুগিয়েছেন। এর সবই তিনি করে গেছেন একান্ত নিভৃতে।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষায় ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কবিতাটি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। এ কথা সত্য, প্রত্যেক সার্থক পুরুষের নেপথ্যে থাকেন একজন নারী। কথায় বলে, ‘প্রত্যেক সফল পুরুষের সফলতার পেছনে একজন নারীর হাত রয়েছে’। আর এই ধারণাকে আরও একধাপ উপরে নিয়েছে একটি গবেষণা। যেখানে দেখা গেছে, শুধু নারীর হাত নয়- সফল হওয়ার পেছনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসালভেনিয়ার দ্য কার্নেইগিমেলন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানীদের দাবির ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সম্পর্কবিষয়ক একটি ওয়েবসাইট।

Advertisement

সঙ্গী সহযোগী হলে মানুষ ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পায়। আর ঝুঁকি নেওয়ার সৎ সাহসই মানুষের জীবনে বয়ে আনে সফলতা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, মানসিক শান্তি এবং সুসম্পর্ক। যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি; তিনি হলেন মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ওরফে রেনু। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সংগ্রামী সেই মহীয়সী নারী, যিনি নিজেকে নেপথ্যে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছেন।

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অনন্য ভূমিকার কথা আমরা বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণা এবং লেখা থেকে জানতে পারি। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ, সাহস আর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন আমৃত্যু। কোনো পদ-পদবির অধিকারী না হয়েও বঙ্গমাতা ছিলেন নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য প্রতীক।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি ও সাহসের উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা।’ ৫৫ বছরের জীবনকালে বঙ্গবন্ধুকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এক নাগাড়ে দুই বছরের বেশি সময় বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বঙ্গমাতা সংসার সামলে পাঁচটি সন্তানকে মানুষ করেছেন। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, নানা রকম প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো, আর্থিক সহযোগিতা করা, সমস্যাশঙ্কুল সময়ে আওয়ামী লীগকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা, দলের আলোচনার সারাংশ কৌশলে জেলখানায় পৌঁছে দেওয়া; আবার বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে তুলে ধরা, বঙ্গবন্ধুর মামলার নথিপত্র সংরক্ষণ করা, মামলার খরচ জোগানোর জন্য প্রয়োজনে নিজের গয়না বিক্রি করা; এ সবই তিনি করেছেন নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্মের ওপর আস্থা রেখে এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার তুলে এনেছেন তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বা রেনুর প্রসঙ্গ। মহীয়সী এই নারীর আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতি নয়, দেশের প্রতিও। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার জীবনে আমি দেখেছি, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনোদিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’

Advertisement

বঙ্গমাতার অপর অনন্যসাধারণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। আমরা জেনেছি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যে বঙ্গমাতার সঠিক পরামর্শ ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেই সময় তাঁর সহচররা ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বঙ্গমাতা এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে যা মন থেকে বলতে ইচ্ছে করে, যা বলা উচিত, তা-ই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বাধীনতার ডাকে বঙ্গমাতার মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল। এভাবে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেছেন নতুন ইতিহাস রচনায়। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন এই মহীয়সী নারী।

১৯৭৫ সালের সেই ভয়াল কালরাতে নির্মম, অপরিণামদর্শী ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে তাঁর জীবনটাও কেড়ে নেয়। কিন্তু সারাজীবন একজন যোগ্য সহচরের মতো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে তিনি যেন বাস্তবে প্রমাণ করে গেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অসাধারণ কবিতার মর্মবাণীকে—‘কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী,/ প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’ মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ। তিনি তাঁর সচেতন বোধ এবং নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় তার সময়কে যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভিন্নমাত্রা লাভ করে নিঃসন্দেহে।

শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের একটি মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি (শেখ ফজিলাতুন্নেছা) আমাদের সময়ের খনা, এই সময়ের বেগম রোকেয়া, এই সময়ের চন্দ্রাবতী। তিনি ইতিহাসের মানুষ।’ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, মানবিকতা, মমত্ববোধ আর ভালোবাসা দিয়ে রচনা করেছিলেন ইতিহাসের এক মহাযজ্ঞ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কণ্টকাকীর্ণ পথে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান ও গুরুত্ব নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়ার কথা, তা হয়নি। আমরা তার সুমহান ব্যক্তিত্ব ও অপরিসীম ত্যাগের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশমাতৃকার প্রতি নির্মোহ চিত্তে আত্মনিবেদনের তাড়নাকে জাগ্রত করতে পারি। সুতরাং সরকার ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। বঙ্গমাতার অবদান আরও বেশি প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেম ও ত্যাগের মহিমা তুলে ধরে তার আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া সময়ের দাবি।

শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান ইতিহাসে নিশ্চয় বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু কথাটি যেমন যৌক্তিক তেমন যৌক্তিক স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সুতরাং আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে বঙ্গমাতার অবদানের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংশ্লিষ্টদের সময়োপযোগী পদক্ষেপে বঙ্গমাতার ইতিহাস সংরক্ষণ হলে, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবনী দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে বলে বিশ্বাস করি।

লেখক: সাবেক সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

এসইউ/জিকেএস