ধর্ম

নবিজির (সা) রওজা মোবারক জিয়ারতের গুরুত্ব ও ফজিলত

ফখরুল ইসলাম নোমানী

Advertisement

মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন মদিনাতুল মুনাওয়ারা। যারা মদিনার প্রেমে আত্মহারা তাঁদের জন্য মদিনার প্রতিটি স্থানের জন্যই রয়েছে হৃদয়ের সীমাহীন ভালোবাসা। আর সে স্থানটি যদি হয় মসজিদে নববির ভেতরের দৃশ্য। তাহলে অনুভূতি কেমন হবে!

মদিনা মুসলমানদের তীর্থস্থান, ভালোবাসার নিকুঞ্জ, আবেগের সৌধ-শিখর। কারণ পবিত্র এ ভূমিতেই জীবনের মূল্যবান ১০টি বছর কাটিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি শুয়ে আছেন এই ভূমির কোলে, নীরবে নিভৃতে। মসজিদে নববির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সবুজ গম্বুজের নিচে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লামের পবিত্র রওজা মোবারকের অবস্থান।

মদিনার মসজিদে নববি। মসজিদে নববির সবুজ গম্বুজ। মসজিদে নববির সবাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মোবারক। যা উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হুজরার (কামরা) মধ্যে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র রওজা মোবারক অবস্থিত।

Advertisement

হজ ও ওমরা পালনকারীদের মদিনা যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো-নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মোবারক জিয়ারত করা, রওজায় সালাম পেশ করা। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজার পাশে আছেন ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক ও হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুমার কবর। পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি। এখানে হবে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের কবর।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে আমার রওজা জিয়ারত করলো তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে গেলো। (মুসলিম) নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘যে হজ করলো কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করলো না ; সে আমার প্রতি জুলুম করলো।’ (তিরমিজি)

মদিনার গম্বুজে খাজ্বরা বা সবুজ গম্বুজ। সেখানে কী আকর্ষণ তা আশেক মাত্রই জানেন। সবুজ গম্বুজের ছায়ায় কী মজা যারা সেখানে বসেন তারাই জানেন। রমজান মাস এলে আসরের পর থেকে ইফতারির দস্তরখান বিছানো হয় মদিনায়; আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সবুজ গম্বুজের পূর্বপার্শ্বে বাবে বেলালে কোনো দস্তরখান বিছানো হয় না। কারণ, বেলালের উত্তরসূরি আশেকে রাসুলরা এখানে বসে থাকে ইফতারি আশায় নয় নবীর প্রেমের আশায়। ঠিক ইফতারির আগ মুহূর্তে হাতে হাতে ইফতারি দিয়ে দেয় নবিপ্রেমিকগণ।

মসজিদে নববির আশপাশটা যেন জান্নাত। সব সময় ভালো লাগার একটা আবেশ বিরাজ করে চারপাশে। মানুষগুলোর হৃদয়ও বেশ কোমল। হজে গিয়ে সবুজ গম্বুজটি দেখলেই হাজি সাহেবদের মনে বইতে থাকে আনন্দের ফল্গুধারা। আবেগের অশ্রু প্রবাহিত হয় দুচোখ ছাপিয়ে। উদ্বেলিত হৃদয়ে তাঁরা সালাম পেশ করেন রওজা পাকে।

Advertisement

সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে সবুজ গম্বুজকে ঘিরে রয়েছে অগাধ ভালোবাসা আর গভীর আবেগ। তাইতো তা দর্শনের জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাকুল থাকে মুমিনের মন।

মসজিদে নববিতে প্রবেশের অনেকগুলো দরজা রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম পাশে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা জিয়ারতের জন্য যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় ওই দরজাকে বাবুস সালাম বলা হয়। বাবুস সালাম দিয়ে প্রবেশ করে রওজায় সালাম শেষে বাবুল বাকি দিয়ে বের হতে হয়।

রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ

মদিনায় হৃদয় শীতল করা অপার বিস্ময় রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ। মদিনা জিয়ারতে এটি হাজিদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। মদিনায় এসে দুনিয়ায় জীবিত থাকতে জান্নাতে ভ্রমণের সুযোগ মেলে। কারণ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিম্বর পর্যন্ত স্বল্প পরিসরের স্থানটুকুই রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগান। এটি দুনিয়াতে একমাত্র জান্নাতের অংশ। এই স্থানে স্বতন্ত্র রংয়ের কার্পেট বিছানো।

 

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ স্থানটুকু সম্পর্কে বলেছেন আমার রওজা ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগান বিদ্যমান। এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা। তৎপর্য ও মাহাত্ম্যের বিবেচনায় রিয়াজুল জান্নাত হলো-দুনিয়ায় অবস্থিত জান্নাতের বাগানসমূহের একটি। তাই জিয়ারতকারীরা এখানে নামাজ আদায় ও দোয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন। এখানে একবার নামাজ আদায় বাইরে এক হাজার বার নামাজ আদায়ের সমতুল্য।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত ও রওজার স্থান নির্ধারণ

সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল চাশতের সময় হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে তাঁরই কোলে মাথা রেখে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। ইন্তেকালের পর সবার ঐকমত্যে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করা হয়। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোথায় দাফন করা হবে, তা নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাইনের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ বলেন জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হোক, কেউ বলেন মসজিদে নববিতে দাফন করা হোক, আবার কেউ প্রস্তাব করলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পাশে সমাহিত করা হোক। এ অবস্থায় হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহুা আনহু বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, নবিরা যেখানে মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই সমাহিত হন। তাঁর এ কথা সবাই মেনে নেন এবং সবার ঐকমত্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হুজরায় যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন সেখানেই সমাহিত করা হয়।

রওজা জিয়ারতের আদব

রওজা শরিফ জিয়ারতের সময় পরিপূর্ণ আদব সম্মান ও ভক্তির সঙ্গে জিয়ারত করতে হবে। মনে থাকবে আবেগ ও ব্যাকুলতা। এরপর সুন্দর করে গোসল করে ভালো পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি লাগিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মনটা রওজা পাকের দিকে রুজু করে আদবের সঙ্গে রওনা হতে হবে। রওজা পাকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব না হলে প্রথমে মসজিদে নববিতে বাবে জিবরাঈল বা অন্য কোনো দরজা দিয়ে আদবের সঙ্গে প্রবেশ করতে হবে। মসজিদে নববিতে প্রবেশের পর মিম্বার ও রওজা পাকের মাঝামাঝি স্থানে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ পড়তে পারলে ভালো। সময় পেলে দুই রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়ে প্রাণ খুলে দোয়া করতে হবে। এরপর রওজা পাকের দিকে বিনয়ের সঙ্গে এগোতে হবে। রওজা পাকে প্রবেশ করে আদব ও ভক্তির সঙ্গে পায়ের দিক থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিয়রের কাছে আসতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা মোবারক বরাবর দাঁড়িয়ে রওজাকে সামনে রেখে বিনয়ের সঙ্গে ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে সালাম পেশ করতে হবে। এই বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমীপে দরূদ ও সালাম পেশ করতে হবে-‘আস্‌সালাতু আস্‌সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ।’ বিদায় নেওয়ার সময় আদবের সঙ্গে আস্তে আস্তে বের হতে হবে।

রওজা জিয়ারতের গুরুত্ব ও ফজিলত

হজরত মোল্লা আলী কারি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন কিছু লোক ছাড়া সারা বিশ্বের মুসলিমের অভিমত হলো, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা পাকের জিয়ারত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং পুণ্যময় ইবাদত। যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা পাকে এলো না, সে যেন নিজের নফসের ওপর জুলুম করলো। চার মাজহাবের প্রখ্যাত ইমামগণ এ বিষয়ে একমত যে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা পাক জিয়ারতের নিয়ত করা মুস্তাহাব। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন আমার ওফাতের পর যে আমার রওজা পাক জিয়ারত করলো সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো। (বায়হাকি)

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার রওজা জিয়ারত করবে কিয়ামতের দিন সে আমার প্রতিবেশী হবে। আর যে (পবিত্র) মদিনায় বসবাস করে এখানের দুঃখকষ্টের ওপর সবর করবে তার জন্য কেয়ামতের দিন আমি সাক্ষী থাকব এবং সুপারিশ করবো। আর যে ব্যক্তি হারামে (পবিত্র) মক্কা অথবা হারামে (পবিত্র) মদিনায় ইন্তেকাল করবে সে কেয়ামতের দিন নিশ্চিন্তে থাকবে। (তাবরানি)

সবুজ গম্বুজের নিবিড় ছায়ায় শুয়ে আছেন মানবতার পরম সুহৃদ। এই সবুজ গম্বুজ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। তাই তারা অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রচন্ড আবেগের টানে সবুজ গম্বুজের একটু ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ছুটে আসে। মদিনার সবচেয়ে বড় কাজ নবিজিকে সালাম দেওয়া আর চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ তাকবিরে উলার সঙ্গে মসজিদে নববিতে আদায় করা। এর বিনিময়ে নেফাকি বা মনের কুটিলতা দূর হওয়া আর জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্তির কথা বলেছেন নবিজি।

আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করো। সবাইকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বেশি বেশি দরূদ ও সালাম পাঠানোর তাওফিক দান করো। সবাইকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

এমএমএস/জিকেএস