#তিন মাসে নিট এফডিআই বেড়েছে ১১৪ শতাংশ#২০২২ সালের পর বছরের প্রথম তিন মাসে সর্বোচ্চ এফডিআই# ইক্যুইটি বিনিয়োগ বেড়ে দ্বিগুণ# পুনর্বিনিয়োগ কমেছে ৪০ শতাংশ
Advertisement
ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভে চাপ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-সব মিলিয়ে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) এসেছে চমকপ্রদ সাফল্যের খবর। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) নিট এফডিআই বেড়েছে ১১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে মোট ১৫৭ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফেরত নিয়ে গেছেন ৭১ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। সে হিসাবে জানুয়ারি–মার্চ সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ৮৬ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। প্রতি ডলার ১২২ টাকা ৯০ পয়সা ধরলে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।
গত বছরের প্রথম তিন মাসে মোট এফডিআই ছিল ১০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফেরত নিয়ে যান ৬৫ কোটি ১১ লাখ ৯০ ডলার। অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নিট এফডিআই ছিল ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ হিসাবে গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে নিট এফডিআই বেড়েছে ৪৬ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার ডলার বা ১১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।
Advertisement
আরও পড়ুন
আকুর বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভ স্থিতিশীল ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারের ৪ অগ্রাধিকার: বিডা প্রধান নবায়নযোগ্য জ্বালানি গ্রিডে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত থামবো নাএদিকে ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসের সঙ্গে তুলনা করলেও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় দ্বিগুণ এফডিআই এসেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে নিট এফডিআই ছিল ৪৯ কোটি ৪ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এফডিআই বেশি এসেছে ৩৭ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ৭৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।
২০২২ সালের পর এবার বছরের প্রথম তিন মাসে সর্বোচ্চ এফডিআই এসেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি–মার্চ সময়ে নিট এফডিআই ছিল ৮৮ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এরপর গত দুই বছরে (২০২৩ ও ২০২৪ সাল) প্রথম তিন মাসে এফডিআই ৫০ কোটি ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে নিট এফডিআই ছিল ৩০ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
মূলধন বিনিয়োগ ও আন্তঃকোম্পানি ঋণ বড় চালকচলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নিট নতুন বিনিয়োগ বা ইক্যুইটি এসেছে ২৬ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গত বছরের একই সময়ে ইক্যুইটি এসেছে ১২ কোটি ৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ হিসাবে ইক্যুইটি বিনিয়োগ বেড়েছে ১৪ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার বা ১০০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।
Advertisement
এছাড়া চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে ১৯ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। এ সময়ে আন্তঃকোম্পানি ঋণ এসেছে ৪০ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ হয় ২৫ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ ছিল ২ কোটি ৫২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় আন্তঃকোম্পানি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ১৬৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে আয় থেকে পুনর্বিনিয়োগ ৪০ দশমিক ২৩ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) রাতে এক ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে নিট এফডিআই হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর অক্টোবর থেকে মার্চ—এই ছয় মাসে মোট এফডিআই এসেছে ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা বিগত সরকারের শেষ ছয় মাসের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।’
আরও পড়ুনবেপজায় ৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে ইউনিফা এক্সেসরিজবাণিজ্য-বিনিয়োগে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী চীন-কানাডাদেশি প্রতিষ্ঠানের মতোই ঋণ পাবে বিদেশি কোম্পানিতিনি আরও লেখেন, ‘দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে—বিনিয়োগ সম্মেলন, ব্যবসাবান্ধব সংস্কার, একচিন্তা ওয়ানস্টপ সার্ভিস—তা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে।’
নিট এফডিআই চিত্রবাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মোট নিট এফডিআই আসে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার এফডিআই কমে। এর আগে ২০২০ সালে দেশে নিট এফডিআই ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে ১.৫৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালে ১.৫২ বিলিয়ন ডলার।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে সম্প্রতি এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অধিকাংশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট গরমিল পাওয়া যায়, যেটা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে অডিট রিপোর্টে স্বচ্ছতা ও সঠিক তথ্য দিয়ে সাবমিট করতে হবে। এটার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক জয়েন্টলি কাজ করবে। পাওনা নিয়ে চার সরকারি প্রতিষ্ঠানে অডিট করতে গেলে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি। যদি অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড কোনো প্রতিষ্ঠান অনুসরণ না করে তাদের ওপর শাস্তি আরোপ করা উচিত। কারণ এটা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক দিক তৈরি হয়।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাখাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বর্তমান সরকারের নেওয়া উদ্যোগ, যেমন- বিনিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মকানুন সহজীকরণ, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সভা-সেমিনার এবং ওয়ানস্টপ সার্ভিস বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তবে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ধরে রাখতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্বচ্ছতা এবং কর কাঠামোয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে।
আরও পড়ুনমূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি, তিন বছর পর ৮ শতাংশের ঘরেবেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৭ শতাংশেরও কমবাধা পেরিয়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে, প্রত্যাশা ছুঁতে পারেনি প্রবৃদ্ধিবিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন ওয়েবসাইট চালু করলো বিডাএক বিনিয়োগ বিশ্লেষকের মতে, যেই সরকারই থাকুক, বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি ও পরিবেশই মুখ্য। এফডিআই বাড়ছে, এটিই প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা সুযোগ খুঁজছেন, বাংলাদেশের বাজারে সম্ভাবনা দেখছেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝেও এফডিআইয়ের এই উল্লম্ফন বাংলাদেশের জন্য আশার আলো। এই ধারা ধরে রাখতে হলে নীতির ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক স্থিতি এবং ব্যবসাবান্ধব সংস্কারই হবে মূল চাবিকাঠি।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নীতির ধারাবাহিকতা সবসময় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এ বিনিয়োগ প্রবাহ বোঝায়, কিছুটা হলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে। যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমে তাহলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
দেশের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক সংগঠক বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, বিনিয়োগ বাড়া মানে উদ্যোক্তাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। কারণ বিদেশি বিনিয়োগ মানে শুধু অর্থ নয়, প্রযুক্তি, জ্ঞান, দক্ষতা এবং নতুন বাজারেও প্রবেশের সুযোগ। তবে এই বিনিয়োগ শিল্পে নাকি সেবা খাতে সেটাও দেখতে হবে। কারণ সেবা খাতে দ্রুতই বিনিয়োগ আসে সেখান থেকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কিংবা প্রযুক্তি বিনিময়ের সুযোগ থাকে না। তবে শিল্পে বিনিয়োগ হলে এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক।
ইএআর/ইএ