মতামত

উন্নয়ন আর দুর্নীতি মাসতুতো ভাই নয়

তাহলে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিই হেরেছে? যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের (আইআরআই) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনটি দেখলে মনে হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি রাজনীতি।মার্কিন সংস্থাটি যখন বলে বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি মেনে নিয়েছে তখন মনে হয় এটি রাজনীতিরই পরাজয়। উন্নযন চাই, মানুষের সমৃদ্ধ জীবন চাই, কিন্তু সেই সাথেতো গণতন্ত্রও চাই, এটাই স্বাভাবিক চাওয়া। সেখান থেকে মানুষের সরে আসার এই প্রত্যয় বলে দেয়, রাজনীতি তার পথে হাঁটতে পারেনি।    আইআরআই জরিপ বলছে, দেশের ৬৪ ভাগ মানুষের মতে, সঠিক পথেই এগোচ্ছে দেশ। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করে, আগামী বছর তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নতি হবে। জরিপে উঠে আসা এসব তথ্যে বাংলাদেশের উন্নয়নে মানুষের আস্থার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। এ দেশের মানুষ যে আশাবাদী, এ জরিপের মধ্য দিয়ে সেটিরও প্রকাশ ঘটেছে বলা চলে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় যে কোনো দেশের উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা গুরুত্ব পাবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন চায়, আর এজন্য তারা যেকোন মূল্যে শান্তি আর স্থিতিশীলতা চায়। তাই সহিংস ধরনের যে আন্দোলনের সংস্কৃতি আমাদের সরকারবিরোধীরা করছিল তা যে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, এই জরিপ তার আরেক প্রমাণ। তাই ৫১ শতাংশ মানুষের মত হল, তারা চায় বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এতে বোঝা যায়, জনগণের অর্ধেকের কিছু বেশি অংশ মনে করে, দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য একটি নির্বাচিত সরকারের পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা উচিত। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখা যায়। এছাড়া ৫৯ শতাংশ মনে করে, আওয়ামী লীগে শক্তিশালী নেতৃত্ব আছে। এতে বোঝা যায় জনগণের বড় অংশ বিশ্বাস করে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে জনগণের ভাগ্যেরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিশীল ধারাই জনগণকে এ ব্যাপারে আশাবাদী করে তুলেছে বলে ধারণা করা যায়।আজ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলমান। সেই সাথে নানা অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আগামীতে দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের নানামুখি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে দেশে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে, এটা বলাই বাহুল্য। কাজেই দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সহিংস রাজনীতির পথ ছেড়ে নতুন করে রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় এখন। যে রাজনৈতিক দল বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে মুখে ফেনা তুলে, সেই দলগুলো নিজেরা কতটা গণতান্ত্রিক পথে চলে তা জনগণ জানে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের ঘাটতির কথা সবাই জানে, জানেন দলের নেতা কর্মীরাও, কিন্তু মানবেন না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব স্পষ্ট। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র ক্ষমতায় যায়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত হয়, কিন্তু সেই দলগুলোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। অথচ একথাতো সত্য যে, রাজনৈতিক দলই দেশ পরিচালনা করবে, সমাজের গণতান্ত্রিক উত্তরণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখবে। এখন তারাই যদি গণতান্ত্রিক চর্চা বা সংস্কৃতি থেকে সরে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক না হয় তাহলে সমাজের গণতন্ত্রায়ণ, সমাজ আলোকিত হবে আশা করি কিভাবে?আমাদের দেশের রাজনীতি প্রায় পুরোটাই ‘জিরো সাম গেম’, অর্থাৎ winner take all, যে জেতে সবই তার। যে হারে তার ভাগ্যে শুধুই যন্ত্রণা। এর চরম নমুনা দেখেছিলাম ২০০১ এর নির্বাচনের পর। যারা জিতেছিল, তারা যেন রাষ্ট্রের মালিক বনে গিয়েছিল, ফলে আজ যখন তারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে আবারো জনগণকে পেট্রল বোমায় মারে, মানুষ মরে ঠিকই, কিন্তু আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না। জিততেই হবে, এমন প্রতিজ্ঞায় প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত দলীয়করণ হয়ে যায়, পেশাদারিত্ব, প্রাতিষ্ঠানিকতা নষ্ট হয়ে যায়। দলের প্রভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো তার সামর্থ্য ও সক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। ঠিক এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। তাই যেদিন আইআরআই জরিপ প্রকাশে সরকারের ভেতর এক ধরনের স্বস্তি, তার পর দিন জানা গেল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৫ সালের ০-১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২০১৪-এর মতো ২৫ পেয়ে অপরিবর্তিত রয়েছে। তার মানে উন্নতি হয়নি। ১৬৮টি দেশের মধ্যে উচ্চক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৩৯তম, যা ২০১৪-এর তুলনায় ছয় ধাপ ওপরে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৪৫তম অবস্থান পেয়েছিল। ছয় ধাপ অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক মনে হতে পারে, যদিও বাস্তবে তা হয়েছে এ জন্য যে, যে সাতটি দেশ এবার জরিপের আওতাভুক্ত হয়নি, তারা সব সময় বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্কোর পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে এবারও আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থান বাংলাদেশের। ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ এবার ২০১৪ সালের ১৪তম অবস্থানের এক ধাপ নিচে ১৩তম, যা ২০১৩ সালের তুলনায় তিন ধাপ নিচে ও দুই পয়েন্ট কম। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় এবারও আমাদের অগ্রগতি হলো না।এখানেই উন্নয়নের সাথে আইনের শাসন ও সুশাসন ভাবনাটায় নজর দেয়ার সময় শাসক দলের।   আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সরকার নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে, এমন একটা কথা দীর্ঘদিনের। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ বেশ কিছু ঘটনায় প্রমাণিত হলো, মানুষের আইনের কাছে সাহায্য পাওয়ার শেষ আশ্রয়টুকু দ্রুত উবে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা বা সিটি কর্পোরেশনের পরিদর্শককে মারধরের ঘটনা, চাঁদা চাওয়া, যতটা মানুষকে অবাক করেছে, তার চেয়েও তাদের বেশি ভয় নির্যাতনকারী পুলিশের পক্ষেই পুলিশ প্রধানের অবস্থান নেয়ায়। যদি তাই হয়, তবে এমন সময় আসতে পারে, যখন মানুষ আইনের ওপর ভরসা না পেয়ে নিজ হাতেই আইন তুলে নিবে। উন্নযনের অগ্রযাত্রার পথে এটা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আশা করবো, সে পথে যাওয়ার আগেই হাল টেনে ধরবে সরকার। আইআরআই জরিপ আবারো প্রমাণ করলো বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামী। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানুষ এগিয়ে রেখেছে তার অর্থনীতিকে। সুশাসন ও স্থিতিশীলতা থাকলে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হতো, এটাই বাস্তবতা। সুশাসনের প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। টিআই এর কথা মেনে নিয়েছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। আমরা উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু মনে রাখা দরকার উন্নয়ন আর দুর্নীতি মাসতুতো ভাই হতে পারে না। আসলে দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থানকে ভঙ্গুর করে দেওয়ার চক্রান্তে কম-বেশি শামিল প্রায় সবাই। আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূল্যবোধ তৈরির ব্যাপারে আমাদের সামাজিক অনীহা চোখে পড়ার মতো। প্রতিনিয়ত মাত্রাতিরিক্ত বৈভবের প্রদর্শনীকে নিয়ন্ত্রণ করার গুরুদায়িত্ব শেষ পর্যন্ত  সরকারেরই। উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্যের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে। সেটাও না হয় কিছুটা মানা গেলো। কিন্তু উন্নয়ন মানেই কি দুর্নীতি? কখনো কখনো উন্নয়ন এবং দুর্নীতি হাতে হাত ধরে এগোয়, অর্থাৎ, উন্নয়নও হয়, দুর্নীতিও চলতে থাকে। কিন্তু উন্নয়নের নামে শুধুই দুর্নীতি হলে এক সময় উন্নয়নই বিপথে হারিয়ে যায়। তাই উন্নয়নের যে অঙ্গীকার সরকারের আছে, সাথে এদিকে নজরটা দেয়া জরুরি। তাই হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, কিংবা হাল আমলের ফার্মার্স ব্যাংকসহ স্তরে স্তরে যেসব দুর্নীতির কাহিনী রূপকথাসম হয়ে রয়েছে সেসব বিষয়ে এ বছরই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু হোক। এইচআর/এমএস

Advertisement