ফিচার

ওগো বিদেশিনী, তোমার চেরি ফুল দাও

মীম নোশিন নাওয়াল খান

Advertisement

আমেরিকায় বসন্ত মানে প্রাণ। কয়েক মাস শীতে বিবর্ণ, মলিন থাকার পর প্রকৃতির আবার প্রাণ ফিরে পাওয়ার ঋতু বসন্ত। পাতা ঝরে ন্যাড়া হয়ে থাকা গাছগুলোর ডালে যখন কচি সবুজ পাতা উঁকি দেয়, সে এক অন্যরকম আনন্দ! এই সময়টা নানা রঙে প্রকৃতির সেজে ওঠার সময়। কিছু গাছ ঘুম থেকে জেগে উঠে সবুজ পাতায় সাজে, কিছু গাছ সাজে নানা রঙের ফুলে। ম্যাগনোলিয়া, টিউলিপসহ নানা ফুলের রঙে মাখামাখি হয়ে থাকে প্রকৃতি। ম্যাগনোলিয়ার মতো গাছগুলোয় পাতাঝরা শীতের পর প্রথমে ফুল আসে। সেই ফুল ঝরে গিয়ে সবুজ পাতা আসে। এ ধরনের গাছের মধ্যে খুব পরিচিত একটা গাছ হচ্ছে জাপানিজ চেরি ফুল বা সাকুরা। বসন্তের শুরুতে চেরি ফুল ফুটতে শুরু করে। হালকা গোলাপি আর সাদা রঙের ফুলে ঢাকা গাছগুলোকে অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো লাগে।

চেরি ফুলের জন্য জাপান পরিচিত হলেও আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় চেরি ফুলের গাছ আছে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি চেরি ফুলের জন্য এতটাই জনপ্রিয় যে চেরি ফুল ফোটার সময় তারা রীতিমতো একটা জাতীয় উৎসব করে—ন্যাশনাল চেরি ব্লজম ফেস্টিভ্যাল।

আমেরিকায় চেরি ফুল আসার ইতিহাসটা মূলত জাপান থেকেই। বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে জাপান ২০০০ চেরি ফুল গাছ উপহার দিয়েছিল আমেরিকাকে। ১৯১০ সালে এক রোগে আক্রান্ত হয়ে সেই গাছগুলো মারা গেলে জাপান ১৯১২ সালে আবার ৩০২০টি চেরি ফুল গাছ পাঠায় আমেরিকায়। এই গাছগুলো লাগানো হয় নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানের সাকুরা পার্কে এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৯৬৫ সালে জাপান আবার ৩৮০০টি চেরি ফুল গাছ উপহার পাঠায় আমেরিকাকে।

Advertisement

বর্তমানে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে চেরি ফুল গাছ আছে। ওয়াশিংটন ডিসি ছাড়াও পেন্সিলভানিয়া, ম্যারিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিভিন্ন স্টেটে অনেক চেরি গাছ আছে। তবে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি চেরি গাছ আছে নিউ জার্সির ব্র্যাঞ্চ ব্রুক পার্কে। বিভিন্ন শহরে চেরি ফুল ফোটার উৎসব হয় মার্চ মাসে। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎসব পর্যটকদের কাছে ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল চেরি ব্লজম ফেস্টিভ্যাল।

এ বছর এই উৎসব ছিল ২০ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল। গেটিসবার্গ থেকে ওয়াশিংটন ডিসি যেতে গাড়িতে লাগে দেড় ঘণ্টা। তাই অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম, চেরি ফুলের উৎসবে যেতেই হবে। আমাদের ক্যাম্পাসেও কয়েকটা চেরি ফুল গাছ আছে। গেটিসবার্গ শহরে বিভিন্ন বাড়ির বাগানে চেরি ফুল গাছ আছে। কিন্তু ওয়াশিংটন ডিসিতে হাজার হাজার চেরি ফুল গাছে একসঙ্গে ফুল ফুটলে দেখতে যে স্বর্গীয় লাগে—তার কোনো তুলনা নেই।

মার্চের ২০-২৪ তারিখ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে একটা কনফারেন্স ছিল। তাই চেরি ব্লজম ফেস্টিভ্যালের প্রথম দিন যেতে চাইলেও সেটা হয়ে উঠল না। গেটিসবার্গ কলেজ থেকে শিক্ষার্থীদের উৎসবে পাঠানোর জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হলো। বাকি সবার সাথে সেভাবে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেটাও হয়ে উঠল না নানা ব্যস্ততায়। তাই শেষমেশ ২৬ মার্চ বন্ধু ব্রেইডেনের সঙ্গে তার গাড়িতে রওনা হলাম।

চেরি ব্লজম ফেস্টিভ্যাল ওয়াশিংটন ডিসির খুব জনপ্রিয় একটা উৎসব। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন। তাই পুরো শহরেই প্রচুর ট্র্যাফিক জ্যাম। আমরা একটা সাবওয়ে স্টেশনের বাইরে গাড়ি পার্ক করে সাবওয়ে ধরে উৎসবে যাব ঠিক করলাম। সাবওয়ের কার্ড কিনতে খুব অসুবিধে না হলেও স্টেশনে ঢুকে মনে হলো বাংলাদেশে ফিরে এসেছি, ঈদের আগে! অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করছে স্টেশনে। সবাই অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্য। ট্রেন থামতেই সবাই হুড়মুড় করে উঠতে শুরু করল। অর্ধেক মানুষকে ট্রেনে জায়গা না পেয়ে পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। অনেকে দাঁড়িয়ে থাকল ট্রেনে। এটি নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটন ডিসির নিত্যদিনের ঘটনা, বিশেষত এমন ব্যস্ত সময়ে। আমরা অবশ্য স্বেচ্ছায় পরের সাবওয়ের অপেক্ষায় রয়ে গেলাম যেন বসার জায়গা পাই।

Advertisement

সাবওয়েতে আমরা এলাম ন্যাশনাল মলে। এখানে লিংকন মেমোরিয়াল, ইউএস ক্যাপিটল বিল্ডিং, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, জেফারসন মনুমেন্ট, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র মনুমেন্টসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। হোয়াইট হাউজও এখান থেকে দেখা যায়। এ ছাড়া এই এলাকায় বেশ কতগুলো জাদুঘরও আছে। এখানেই চেরি ফুলের উৎসব। সাবওয়ে স্টেশন থেকে বের হতেই আমাদের চোখে পড়ল আকাশজুড়ে নানা রঙের, নানা আকার-আকৃতির অসংখ্য ঘুড়ি। সেদিন ছিল চেরি ব্লজম ফেস্টিভ্যালের ঘুড়ি দিবস। ছোট-বড় সবাই নানা রকম ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত। এরমধ্যে চোখ চলে গেল চেরি ফুল গাছগুলোর দিকে। মৃদু হাওয়ায় ফুলসহ ডালগুলো দোল খাচ্ছে। অনেক পরিবার চেরি ফুল গাছের নিচে চাদর বিছিয়ে পিকনিক করছে। অনেকে ছবি তুলছে। আমি ভীষণ উৎসাহ নিয়ে প্রচুর ছবি তুলতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে ব্রেইডেন আমাকে রীতিমতো টানতে টানতে সেখান থেকে সরিয়ে আনল। আমি মন খারাপ করে বললাম, চেরি ফুলই তো দেখতে এসেছি। সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ কেন?সে বলল, এখানে তো অল্প কিছু গাছ। তুমি তো উৎসবের মূল জায়গাটা দেখোইনি!

হেঁটে হেঁটে আমরা গেলাম টাইডাল ব্যাসিনের কাছে। ক্যাপিটল ভবনের সামনে একটি হ্রদের মতো—শান্ত পানি। পটোম্যাক নদীর সঙ্গে যুক্ত এই টাইডাল ব্যাসিন। তার চারপাশ দিয়ে প্রচুর চেরি গাছ। যে কোনো একপাশে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় শুধু সারি ধরে চেরি ফুলগাছ। এই জায়গাটা মূলত এই সময়টার, এই দৃশ্যটার জন্যই এত জনপ্রিয়। আমরা টাইডাল ব্যাসিনের একপাশে ফুটপাতে চেরি ফুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ইউএস ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। শত শত চেরি ফুলগাছের হালকা গোলাপি আর সাদা ফুলের ফাঁক দিয়ে কী যে সুন্দর লাগছিল ভবনটা! প্রচুর ছবি তুললাম। তাতে মন ভরল না। কিছু ভিডিও করলাম।

দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। ন্যাশনাল মলে অনেক খাবারের ট্রাক থাকে। এরমধ্যে হালাল খাবারের ট্রাকের সংখ্যা কম নয়। একটি হালাল ট্রাক থেকে বার্গার আর কোক খেলাম। শুধু খাবার অর্ডার করতেই প্রায় বিশ মিনিট লেগে গেল। উৎসবের দিন বলে সব জায়গায়ই প্রচুর ভিড়। খাবার নিয়ে চেরি ফুলগাছের নিচে বসে খেলাম। বাতাসে চেরি ফুলের পাপড়ি আমার কোলে এসে পড়তে লাগল।

বাবল টি বা বোবা চা এখানে খুব জনপ্রিয়। ন্যাশনাল মলে শুধু বোবা টি বিক্রির আলাদা ট্রাক আছে। তেমন একটা ট্রাক থেকে বোবা টি কিনলাম। সেটা করতে করতেই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করল। শুধু বৃষ্টি না, শিলাবৃষ্টি! সাথে ঝড়। প্রচুর মানুষ দৌড়াচ্ছে আশ্রয়ের জন্য। তাদের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে আশ্রয় মিলল সাবওয়ে স্টেশনে। শিলাবৃষ্টির জন্য সেখানে প্রচুর ভিড়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা একটা ট্রেনে উঠতে পারলাম। যতক্ষণে আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে পৌঁছে গাড়িতে ফিরলাম, ততক্ষণে বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই আর। গাড়ি রওনা হলো পেন্সিলভানিয়ার উদ্দেশে। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলা গাড়ি থেকে আমি তাকিয়ে রইলাম রাস্তার দু’পাশে আমাদের সাথে ছুটতে থাকা চেরি ফুলগাছগুলোর দিকে। তারা যেন মৃদু হেসে অভিবাদন জানাল, ধন্যবাদ জানাল তাদের দেখতে আসার জন্য।

এসইউ/জেআইএম