ফিচার

নাচতে নাচতে মারা যায় শত শত মানুষ

প্রতি শতাব্দীতে পৃথিবীতে এসেছে মহামারি। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে সে সময়, স্থবির হয়েছে অর্থনৈতিক অবস্থা, ক্ষতির মুখে পড়েছে বিশ্ব। যা গত দুই বছরের করোনাকালীন চিত্র দেখলেই সহজে বোঝা যায়। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মাসের পর মাস লকডাউনে ঘরবন্দি থেকেছে মানুষ।

Advertisement

দিনে হাজার হাজার মৃত্যু দেখেছে পৃথিবী। সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়েছে মনের দূরত্ব। ভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কে প্রিয় মানুষের শেষ সময়ে পাশে থাকার সুযোগও পাননি অনেকে। বর্তমানে করোনা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও দেখা দিয়েছে নতুন আতঙ্ক। এ সময় চোখ রাঙাচ্ছে নতুন এক সংক্রামক ‘মাঙ্কিপক্স’।

এটি একটি সংক্রামক রোগ। যার এখনো নেই কোনো সঠিক চিকিৎসা। এরই মধ্যে ১৫টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে গেছে এ ভাইরাস। শিগগির এটি মহামারি আকারে দেখা দেবে বলে ধারণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে করোনা কিংবা মাঙ্কিপক্স, এসবের রয়েছে ধরন ও লক্ষণ। তবে ১৫ শতাব্দীতে দেখা দিয়েছিল ভিন্ন এক রোগ। যার ফলে মানুষ নাচতে শুরু করত এবং তা চলতো মৃত্যু পর্যন্ত।

১৫১৮ সালের দিনটি ছিল অন্য আর দশটা দিনের মতোই। তবে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ শহরের সকালটি খানিকটা বদলে যেতে থাকে যখন রাস্তায় নেমে নাচতে শুরু করলেন একদল মানুষ! নৃত্যরত নর-নারী ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে, নাচতে নাচতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে পুরো শহরভর্তি লোক, তবু থামছে না! এরকম দৃশ্য কেউ কখনো কল্পনা না করলেও বাস্তবেই ঘটেছিল এমন রহস্যময় ঘটনা।

Advertisement

প্রায় ৫০০ বছর আগে এ মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্সে। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ফরাসি শহর স্ট্রাসবার্গে, এক এক করে শত শত মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। তবে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ঠিক কতজন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন এ ভয়ংকর রোগে, তার সঠিক সংখ্যা নেই কোথাও। এ রোগে আক্রান্ত রোগী নাচতে থাকতেন তার মৃত্যু পর্যন্ত। নাচের কারণেই তাদের মৃত্যু হতো।

একদিন সকালে ফ্রাউ ত্রাফেয়া নামের এক নারী হঠাৎ শহরের রাস্তায় নেমে এলেন নাচতে নাচতে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে পাগলামিই বলে ধরে নিয়েছিলেন আশেপাশের মানুষ। তবে দৃশ্যপট বদলে গেল খানিক পরেই। একে একে নৃত্যরত ত্রাফোয়ার দল ভারী হতে লাগলো। তার সঙ্গে নাচে যোগ দিতে থাকলো শত শত মানুষ।

খুব দ্রুতই অবস্থা চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। থামার কোনো লক্ষণই নেই। হঠাৎ দেখে যে কেউ ভাববেন, তারা হয়তো কোনো উৎসব পালন করছেন। একে একে তার চারপাশের সবাই যোগ দিলো নাচে। কল্পকাহিনির মতো শোনালেও এ ঘটনা সম্পূর্ণ বাস্তব। সেই নাচ শুরু হলো ঠিকই, শেষ হওয়ার কোনো নাম নেই।

টানা ১ সপ্তাহ চলার পর, ভিন্ন জায়গা থেকে আসা আরও ৩৪ জন যোগ দিলো এ নাচে। একমাসে সংখ্যাটি দাঁড়ালো ৪০০ জনেরও বেশি! ৪০০ জন মানুষ একটানা একসঙ্গে শুধু নেচেই যাচ্ছেন, সম্পূর্ণ বিরতিহীনভাবে। কেন এরকম হচ্ছে কেউ জানেন না, কেউ বুঝতেও পারছেন না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের নাচিয়ে নিচ্ছে, শুধু নেচেই যাচ্ছেন তারা! অনেকে অশুভ কোনো কিছুর জন্য এমন হচ্ছে বলেই ভেবে নিলেন। চারদিকে ছড়িয়ে গেল এ খবর। এ মহামারির নাম দেওয়া হয় ডান্সিং প্লেগ।

Advertisement

নৃত্যের মিছিল ধীরে ধীরে মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই নাচতে নাচতে মারা যায় এক ডজনেরও বেশি মানুষ! এদের বেশিরভাগই মারা যায় একটানা নাচ, ডিহাইড্রেশন, স্ট্রোক এবং ক্লান্তিতে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, সর্বপ্রথম নাচ শুরু করা নারী ফ্রাউ ত্রাফেয়া তখনো বেঁচে ছিলেন এবং নেচে চলেছিলেন! দীর্ঘ একমাস বিরামহীন নাচতে থাকেন তিনি। একমাস পর নৃত্যদলের শেষ মানুষ হিসেবে তিনিও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।

তবে ঠিক কেন এমনটি হয়েছিল, সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো কারণ এখনো পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর সঠিক কোনো কারণ ৫০০ বছরেও বের করতে পারেননি কেউ। শুধু রহস্যের মধ্যে উঁকি দিয়েছে কিছু ধারণা। একেক ইতিহাসবিদ একেক ভাবে এ সমস্যাকে ব্যাখ্যা করেছেন।

ইতিহাসবিদ জন ওয়ালার বলেছিলেন, এমনটি হয়েছিল মূলত শহরের সব মানুষের মানসিক ভাঙনের জন্য। শহরটি এরই মধ্যে অনেক বেশি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। শহরের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষুধায় কাতর ছিল এবং রোগ-শোকে আক্রান্ত ছিল। কাজেই তারা ভেঙে পড়েছিলেন মানসিকভাবে। ফলে এক ধরনের মনোবৈকল্যের শিকার হয়ে তারা এমন নাচ শুরু করেছিলেন, নিজেদের অজান্তেই।

কিন্তু মানসিক ভাঙন থেকে মনোবৈকল্য একসঙ্গে সবার হবে কেন? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। এ ব্যাপারে আরেকটি জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে, এরগট ফাঙ্গাস নামে এক প্রজাতির ফাঙ্গাস এ ঘটনার জন্য দায়ী। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এরগট ফাঙ্গাস বিষাক্ত একটি ফাঙ্গাস হওয়ার কারণে মানুষ নাচতে শুরু করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এ ফাঙ্গাসের আক্রমণ মানুষকে এতক্ষণ ধরে নাচের শক্তি দিতো না।

এ ধারণায়ও কিছুই পরিষ্কার হয় না। এ সমস্যার কিন্তু সমাধান হয়েছিল এমনিতেই। ৪০০ মানুষের প্রাণ নিয়েই ক্ষান্ত হয় এ মহামারি। যেভাবে হঠাৎ করেই এসেছিল এ মহামারি; তেমনই নীরবেই চলে গেছে। খুব অল্প সময় স্থায়ী হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা ডান্সিং প্লেগকে মহামারি বলেই উল্লেখ করেছেন।

তবে ঠিক কেন শুরু হয়েছিল এ নাচ এবং ঠিক কী কারণে একটানা নাচতে নাচতে মৃত্যু হলো এতগুলো মানুষের। এ রহস্য আজও অজানা। বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ডান্সিং প্লেগ! তবে কি এটি শুধুই একটি ছোঁয়াচে রোগ বা প্লেগ নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য। তা হয়তো জানা যাবে সুদূর ভবিষ্যতে কিংবা ইতিহাসে থেকে যাবে এক অমিমাংসিত রহস্য হিসেবেই।

সূত্র: হিস্ট্রোরি ডটকম, বিবিসি

কেএসকে/এসইউ/এমএস