আবদুল কাইয়ুম শেখ
Advertisement
পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে আমরা বেশ কিছু ইবাদত-বন্দেগিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। নিয়মিত নামাজ আদায় করছিলাম। কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করছিলাম। তারাবির নামাজ পড়ছিলাম। বিভিন্ন নফল ইবাদত-বন্দেগি পালন করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রকমারি দান-অনুদান প্রদান করছিলাম। এগুলোর সবই নেক আমল। এগুলোকে রমজানের পরও ধরে রাখতে হবে। সারাজীবন নেক আমল চালিয়ে যেতে হবে। আমরণ ইবাদত করার নির্দেশনা মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এভাবে এসেছে, 'পালনকর্তার ইবাদত করুন, যে পর্যন্ত আপনার কাছে নিশ্চিত কথা (মৃত্যু) না আসে।' (সুরা হিজর : ৯৯)।
আমৃত্যু ঐশী নির্দেশনানুযায়ী জীবন পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, 'হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত, ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাকো। আর অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরো না।' (সুরা আলে ইমরান : ১০২)। তাই এমন কিছু ইবাদতের কথা আলোচনা করা হলো, যেগুলো আমরণ চালিয়ে যাওয়া দরকার। মাহে রমজানের পরও পালন করে যাওয়া কর্তব্য।
নামাজ আদায় করাঅন্য মাসে নামাজ আদায় করে না, এমন বহু লোকও পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নামাজ পড়া শুরু করেছিলেন। আর যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন, তারা তাদের নামাজের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নফল নামাজ বেশি বেশি আদায় করছিলেন। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছিলেন। তারাবির নামাজ আদায় করছিলেন। রমজানের পরও নামাজ পড়ার এ অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। কেননা, যারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করে, তাদের প্রশংসা করার পর আল্লাহতায়ালা একপর্যায়ে বলেছেন, 'যারা তাদের নামাজে যত্নবান, তারাই জান্নাতে সম্মানিত হবে।' (সুরা মাআরিজ : ২৩)।
Advertisement
হাদিস শরিফেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। একদিন খুব বেশি নামাজ পড়লাম, আর অন্যদিন একদম পড়লাম না, এমনটি যেন না হয়। কেননা, সেই আমলই অধিক প্রিয়, যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পালন করা হয়। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আল্লাহর কাছে ওই আমল সবচেয়ে প্রিয়, যা সর্বদা করা হয়; তা কম হলেও।' (বোখারি : ৫৮৬১)।
রোজা রাখাআমরা রমজান মাসে রোজা রেখে রোজা পালনে বহুলাংশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। নফল রোজা পালন করার মাধ্যমে এ অভ্যাস অন্যান্য মাসেও ধরে রাখতে পারি। এতে ইহলৌকিক কল্যাণ অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে পরলৌকিক প্রভূত পুণ্যের ভাগিদার হব, ইনশাআল্লাহ। আবু আইয়ুব (রা.) বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছর রোজা রাখল।' (সুনানে আবি দাউদ : ২৪৩৩)। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, আবু জর (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি প্রতি মাসে তিনদিন রোজা পালন করল, সে যেন সারা বছর রোজা পালন করল।' (সুনানে নাসাঈ : ২৪০৯)।
কোরআন তেলাওয়াত করাকোরআন তেলাওয়াত অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে আমরা এ পুণ্যময় কাজে বহুলাংশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। দিনে-রাতে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করছিলাম। তারাবির নামাজে পবিত্র কোরআন শ্রবণ করছিলাম। কোরআন তেলাওয়াতের এ অভ্যাস অন্যান্য মাসেও ধরে রাখতে হবে। যারা কোরআন শরিফ হতে বিমুখ থাকে, তাদের ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, 'যে আমার উপদেশ (কোরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে। আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।' (সুরা তহা : ১২৪)।
কোরআন শরিফকে ভালোবাসা ও কোরআনের সঙ্গে প্রেম করা প্রকারান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই ভালোবাসা এবং তাদের সঙ্গে প্রেম করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি এটা জানতে চায় যে, সে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসে কি-না, সে যেন এ বিষয়ে লক্ষ্য করে, যদি সে কোরআন শরিফকে ভালোবাসে, তাহলে সে প্রকারান্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই ভালোবাসে।' (সুনানে বায়হাকি, শুআবুল ঈমান)।
Advertisement
দান করারমজান মাস উপলক্ষে আমরা প্রচুর পরিমাণে দান-অনুদান প্রদান করছিলাম। জাকাত দিচ্ছিলাম ও সদকাতুল ফিতর আদায় করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ দান-খয়রাতের মাধ্যমেও গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। দানের এ অভ্যাস আমাদের ধরে রাখা দরকার। দান করায় রয়েছে প্রচুর সওয়াব ও প্রভূত পুণ্য। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধনসম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশত করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।' (সুরা বাকারা : ২৬১)। দান-অনুদান প্রদান করার মাধ্যমে বিপদ-আপদ ও বালা-মসিবত হতে মুক্ত থাকা যায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যায়, অপরাধ ও পাপমোচন হয়। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'দান-খয়রাত এমনভাবে পাপসমূহ বিলীন করে দেয়, যেমন পানি আগুনকে বিলীন করে (নিভিয়ে) দেয়।' (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৫৪২)।
নফল ইবাদত করাপবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে আমরা বিভিন্নধর্মী নফল ইবাদতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। ইশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ ও কদরের নামাজসহ আরও অন্যান্য নফল নামাজ প্রচুর পরিমাণে আদায় করছিলাম। জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিলসহ অন্যান্য নফল ইবাদত-বন্দেগিতে রত ছিলাম। এসব ইবাদত অন্যান্য মাসেও চালিয়ে যেতে হবে। কেননা, নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার প্রিয় পাত্র হওয়া যায়। তাঁর নৈকট্য অর্জন করা সম্ভব হয়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাহলে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দিই। আমি কোনো কাজ করতে চাইলে তা করতে কোনো দ্বিধা করি-না, যতটা দ্বিধা করি মোমিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকা অপছন্দ করি।' (বোখারি : ৬৫০২)।
মৃত্যুর সময়টা বড়ই সঙ্গিন। এ সময় একজন মানুষের মধ্যে দু'ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করে। এক হলো, সে তার পরিবার-পরিজন রেখে যাচ্ছে। তারা কোন অবস্থায় থাকবে? কে তাদের হাল ধরবে? তাদের দেখাশোনা কে করবে? তারা দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হবে কি-না? এসব দুশ্চিন্তা তার মধ্যে কাজ করে। অপরদিকে তার মধ্যে এ দুর্ভাবনাও ক্রিয়াশীল থাকে যে, তার পরকালীন জীবন কেমন হবে? কবরের জীবন সুখময় হবে কি-না? কেয়ামত, হাশর ও পুনরুত্থান তার অনুকূলে হবে কি-না? সে আজাবের পাকড়াও হতে পরিত্রাণ পাবে কি-না? এসব দুশ্চিন্তায় সে অস্থির থাকে। কিন্তু যেসব লোক নিয়মিত আল্লাহতায়ালার ইবাদত করে এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে অবিচল থাকে, তাদের মৃত্যুর সময় তিনি এ দু'ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, 'নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় কোরো না, চিন্তা কোরো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোনো। ইহ-পরকালে আমি তোমাদের বন্ধু। সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে তোমরা যা দাবি কর।' (সুরা হামিম সেজদা : ৩০-৩১)। তাই আসুন, পবিত্র মাহে রমজানের মতো আমরা বারো মাস আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে অটল ও অবিচল থাকি। তার দাসত্ব ও অর্চনায় নিরত থাকি। রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা
মুনশি/এসইউ/এমএস