ফিচার

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তরুণদের ভাবনা

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিবছর এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের আপামর জনগণ মহান ভাষা আন্দোলনের সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে। ১৯৫২ এর ভাষা শহীদদের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা। তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস।

Advertisement

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মূলমন্ত্র। বাঙালিকে করেছে একতাবদ্ধ। এই একতাবদ্ধে উজ্জীবিত হয়েই বাঙালিদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে স্বাধীনতার চেতনা। এই চেতনা থেকেই আজ আমরা স্বাধীন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য সম্পর্কে তরুণদের ভাবনা জানতে তাদের সঙ্গে কথা বলেন ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী সাজেদুর আবেদীন শান্ত।

সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান সোহান বলেন, ‘বছর ঘুরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি আসে শহীদের পুণ্যস্মৃতি নিয়ে চেতনার দীপ্ত মশাল হাতে। আমি প্রথমেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেসব শহীদদের প্রতি, যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি। ১৯৫২-২০২২ সাল, মাঝখানে ৭০ বছর, যদিও এক্ষেত্রে বয়সটা বড় কোনো ব্যাপার না, চেতনাটাই মুখ্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘একুশের চেতনায় আছে জাতীয়তাবোধ, সার্বজনীন বিশ্ব মানবিকতা, গণতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও শোষণ মুক্তির প্রেরণা। নতুন প্রজন্মকে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও দশের জন্য কাজ করতে হবে। দেশের যে কোনো কঠিন মূহুর্তে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য নিজেকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, একুশ আমাদেরকে ‘কোনোদিন মাথা নত না করতে’ শিখিয়েছে।’

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তর্ণিকা হাজরা বলেন, ‘মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির জীবনীশক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে বাংলা ভাষার সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে নতুন করে ভাবনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলা ভাষার নানা বিকৃত ব্যবহার প্রকৃত মাতৃভাষাপ্রেমীদের শঙ্কিত করে তুলছে। বর্তমানের সবস্থানে সহজলভ্য সংবাদপত্র থেকে শুরু করে নামিদামি বইয়ের দোকানের বাংলা বইয়ের পাতায় চোখে পড়ে অসংখ্য ভুল বানানের রাজত্ব, বানানের প্রমিত রীতির অবমাননা।’

‘এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন তরুণ প্রজন্মের ভুল বানান শিক্ষার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষাকে তার যথার্থ মর্যাদা প্রদানে জাতির অঙ্গীকার হোক নিজের ভাষায় যথাযথ শিক্ষা লাভ করা, শুদ্ধ বানান চর্চা করা ও বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে অনুভব করে সর্বদা ও সর্বত্র ভাষার সঠিক ব্যবহারে সচেষ্ট হওয়া।’

গণমাধ্যমকর্মী মেহেরুজ্জামান সেফু বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি আমাদের শোকস্তব্ধ অহংকারের আর গৌরবের। একটি ভাষা সমগ্র বিশ্বে পেয়ে থাকে ভিন্ন এক মর্যাদা। যার আছে নিজস্বতা। কারণ এই ভাষা পরিপূর্ণ। তবে স্পষ্টতা, যথাযথ সম্মান বজায় রেখে কত জন এই ভাষায় কথা বলছি। কতো জনই বা চর্চা করছি মাতৃভাষাকে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করার জন্য। আমরা এখন খুব আধুনিক। এমন অন্ধ উক্তি নিজের মাঝে ধারণ করে হয়ে যাচ্ছি অত্যাধুনিক। কি করছি তা ঠিক নিজেরাই জানি না ‘

‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ জোরে মাইক বাজিয়ে, খালি পা শহিদ মিনারের দিকে মুঠো ভর্তি ফুল নিয়ে একটা স্থিরচিত্র স্মার্ট ফোনে ধারণ করে আধুনিক সমাজের বেশ উল্লেখযোগ্য স্থান ফেইসবুক ওয়ালে দু’লাইন কবিতার ছন্দ লাগিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন সম্পন্ন করি। নিবেদিত এমন কর্মের মাঝে কখনো জুতা পরেই শহিদ বেদিতে কখনো বা দু’লাইন কবিতার চরণে চারটি শব্দে ভুল আমাদের অত্যাধুনিক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট জানান দেয়।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে তাদের প্রতি বছরের প্রতিদিন, প্রতিটা মুহুর্তে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের তৃপ্ততা, সন্তুষ্টির মাত্রাটা বাড়িয়ে নিতে পারি না..? এখন হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে সেটা কি করে সম্ভব..? বাংলা ভাষাকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার চর্চা চালিয়ে বর্ণের সঠিক উচ্চারণ করতে পারলেই সম্ভব। কেননা ভাষা শহিদরা তো এই ভাষাকে রক্ষার জন্যেই তাদের তাজা প্রাণ বলি দিয়েছেন।’

‘তাই আমার মনে হয় বাংলা ভাষার পর্যাপ্ত যত্ন ও ভাষার যথাযথ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভাষাকে রক্ষায় শহিদদের প্রতি প্রতিটা মুহুর্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি। একজন গর্বিত বাঙালি হয়ে শোকাহত ও মহিমান্বিত এই ভাষার মাসে সব বাঙালিদের প্রতি আমার এই স্বল্প চাওয়া, আসুন নিজেকে ও আপনজনদের যেভাবে ভালোবাসি, ঠিক তেমনই ভালোবাসি সমাজ, দেশ ,দেশের মানুষ তথা সমগ্র পৃথিবীকে’।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনুভা তাহসিন বলেন, ‘বঙ্গদেশে বাঙালির আত্বত্যাগের ইতিহাস যুগ যুগ ধরে জ্বাজ্জল্যমান। সেই ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু ৭১’র যুদ্ধ অবধি যাদের আত্বত্যাগের কাহিনি বিশ্ব দরবারে সমাদৃত ও আলোচিত। সেই গৌরবময় দিন ২১শে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালে যেদিন ইতিহাস গড়েছিলেন এদেশের স্বর্ণসন্তানেরা!’

‘আজ তাদের স্মরণে মাথা নোয়ানোর দিন, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ অনেক বাঙালি দামাল ছেলেরা। ১৯৫২’র এই দিনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এক বিরাট ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল।’

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘শুধু ভাষার দাবিতে ছাত্রদের এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেসব সূর্যসন্তানের আত্মত্যাগ আমরা প্রতি বছর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ইতিহাস রচনা করেছিলেন সেই দামাল ছেলেরা, তারই প্রেক্ষিতে ৫ই আগষ্ট ২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস পালন করা হয়।’

‘এই যে গৌরবগাথা আমরা কতটুকু ধারণ করতে পারছি? যে বাংলা ভাষার জন্য বীরদের আত্মত্যাগ সে ভাষাই আজ হুমকির মুখে। স্বদেশি ভাষা প্রতিনিয়ত কলুষিত হচ্ছে বিদেডিদ ভাষা ও সংস্কৃতির আড়ালে। নিরবে নিভৃতে শহিদদের আত্মত্যাগ ম্লান হচ্ছে! আজ এই দিনে তাই একটি প্রত্যাশা আমার ভাষা, বাংলা ভাষা যেন থাকে বিদেশি ভাষা থেকে কলুষমুক্ত’।

সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের শিক্ষার্থী মো: রবিউল ইসলাম বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন এই বাংলায় মাতৃভাষা নিয়ে অনেক বেশি চর্চা হতো। এখন কেন যেনো বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ এই ভাষার জন্যই ১৯৫৪ সালে রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকেই তাদের জীবন উৎসর্গ করেন। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির বিকাশের ফলে যুব সমাজ আগে যারা বিভিন্ন সাহিত্যচর্চা বা সভা-সমিতি করতো, তারা এখন স্মার্ট ফোন ও নেট দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে।’

‘এর পাশাপাশি আবার আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তা বা আচার-আচরণে বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ এসে বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ চলছে। ভাষার মাসে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে ও বাংলা ভাষাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সর্বত্র বাংলা সাহিত্য চর্চা করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির পাশাপাশি কিছু সময় বাংলা ভাষার পেছনেও ব্যয় করতে হবে। মানুষ এখন ভাবের গভীরতা প্রকাশ করতে ইংরেজি শব্দের প্রতি যতটা আগ্রহী, তার ২০ শতাংশও বাংলার ক্ষেত্রে নয়।’

তরুণ লেখক সোনিয়া আফরিন বলেন, ‘নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আসে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এই মাস ভাষা আন্দোলনের মাস, পরম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও ভাবগাম্ভীর্যের মাস। আপামর বাঙালি একুশের চেতনা মনে-প্রাণে লালন করে। ১৯৫২ সালে ভাষা সৈনিকদের মহান আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা ভাষা। সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকেই ভাষা আন্দোলনের জন্য জীবন দিয়েছেন। ভাষা শহিদদের স্মৃতির মর্যাদা দিতে সর্বস্তরে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা হোক এই আশাবাদ ব্যক্ত করি’।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বাঙালি জাতি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, অধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের বাঁচার দাবিকে উদ্ভাসিত করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি।

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী

জেএমএস/জেআইএম