একুশে বইমেলা

‌‘বি ক্যাটাগরির ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার তিনবার প্রত্যাখ্যান করেছি’

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করছেন। তাঁর কবিতায় গ্রামবাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ন, নাগরিক জীবন, জীবনের জটিলতা, প্রেম, পরবাস, পরাবাস্তব প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়। তিনি ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৯৬ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।

Advertisement

তাঁর প্রকাশিত বই অর্ধশতাধিক। সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও গবেষণায় অবদানের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর লেখা বেশকিছু গান ও নাটক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এক সময়ের বিটিভির ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। বর্তমানে তিনি কানাডায় বসবাস করছেন। সেখানেও তিনি সাংবাদিকতার সাথেও যুক্ত রয়েছেন। প্রবাসী বাঙালিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নিউজ এজেন্সি ‘স্বরব্যঞ্জন’, সেই সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা ‘পাঠশালা’। 

সম্প্রতি তিনি লেখালেখি ও আগামী বইমেলা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী ও গণমাধ্যমকর্মী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হচ্ছে। এবারের বইমেলায় আপনার কয়টি বই আসছে? বইগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন—সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ছয়-সাতটি বই আসছে। এর মধ্যে কবিতার বই ‘পাখিদের অবিবাহিত জীবন (স্বরব্যঞ্জন)’, ‘তালগাছ দুই পায়ে দাঁড়িয়ে (দেয়াঙ পাবলিশার্স)’, ‘মেইড ইন চায়না (অনন্যা)’, ‘প্রিয় পঞ্চাশ (বইতরণী, কলকাতা)’। গদ্য ও সম্পাদনা ‘স্মৃতিগদ্য (বাংলাপ্রকাশ)’, ‘মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু কিশোর সমগ্র (অন্বেষা)’, ‘কানাডায় মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো (ঐতিহ্য)’। এ ছাড়াও ‘বঙ্গবন্ধুসমগ্র’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু: ১০০ কবির ১০০ কবিতা’র দ্বিতীয় ও তৃতীয় মুদ্রণ আসছে।

Advertisement

জাগো নিউজ: দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পাঠকের ভালোবাসা ও পুরস্কার দুটোই পেয়েছেন। তারপরও মনের মধ্যে কোনো আক্ষেপ কি জেগে ওঠে?সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: না তো। বরং আমি তৃপ্ত।

জাগো নিউজ: বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম রয়েছে। এসব কাজের মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। তাতে অন্যরাও উৎসাহিত হবেন। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: ‘মূল্যায়ন হওয়া জরুরি’—এ বিষয়ে আমার বলার কিছু নেই। তবে ‘মূল্যায়ন’ তো হচ্ছেই। হচ্ছে বলেই তো প্রশ্নটি তুমি করলে। সবাই জানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার সাহিত্যকর্ম আছে। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখিও।

যে সময় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাও অপরাধ; সেই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে কাজ করছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯৯৩ সালে আমার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ বের হয়েছিল ‘সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব’ অনিন্দ্য থেকে। তারপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একের পক এক বহুমুখী কাজ করে যাচ্ছি। কবিতা, গল্প, নাটক, ছড়া, রাজনৈতিক প্রবন্ধ। এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার মৌলিক গ্রন্থ আটটি এবং সম্পাদনা চারটি। বিশেষ করে ‘বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা’ সংকলনটি একটি দুর্দান্ত কাজ। সেই সংকলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।

ইতোমধ্যে মৌলিক গ্রন্থগুলো নিয়ে তৃতীয় সংস্করণ বের হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুসমগ্র’ নামে। এসবের জন্যই খালেদা সরকার আমাকে চাকরিচ্যুত করেছে। নানা প্রতিকূলতায় এক পর্যায়ে দেশান্তরীও হতে হয়েছে। কানাডা গিয়েও অনেকটা আত্মগোপনে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনি নূর চৌধুরীকে নিয়ে অনুসন্ধানী গ্রন্থ রচনা করেছি ‘কানাডায় খুনি নূর চৌধুরী’ নামে। তার বাসায় একাই জুতো-স্যান্ডেল ঝুলিয়ে দিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুনির বাসার সামনে থেকে ফেসবুক লাইভ করেছি। ইতোপূর্বে বন্ধু বাবুল মোশারফকে নিয়ে খন্দকার মোশতাকের আগামসি লেনে ঝাড়ু এবং দাউদকান্দির দশপাড়ায় তার কবরে ঘৃণার জুতো ছুঁড়ে দিয়ে এসেছি। আমার সাথে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন আহমদ।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনি দীর্ঘ সময় কানাডা অবস্থান করছেন। প্রবাসে থেকে সাহিত্যচর্চায় কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কি?সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এখন প্রযুক্তির যুগে তেমন ‘প্রতিবন্ধকতা’ হয় না। তবে কিছু কিছু দূরত্ব তৈরি হয়েছে। যেমন- অনেক তরুণ লেখককে চিনি না। এক সময় বিটিভিতে নাটক লিখতাম, গান লিখতাম, উপস্থাপনা করতাম। সেগুলো এখন সম্ভব নয়। ঢাকার নানামুখী আড্ডা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি ইত্যাদি।

জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার গতি-প্রকৃতি ও পুরস্কার প্রদান নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা লক্ষ্য করা যায়। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: পুরস্কারের দুর্নীতি নিয়ে আমি সব সময় সোচ্চার। আমার সম্পাদিত ‘প্রচ্ছদ’ ও ‘সূচিপত্রে’ আশি-নব্বই দশকে দেশের বিচিত্র পাঁচ শতাধিকসহ দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। যা খুব তোলপাড় তুলেছিল।

অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত বিভিন্ন জনকে দেওয়া পুরস্কার প্রত্যাহার করার জন্য একাধিকবার তীব্র প্রতিবাদ করে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। জনৈক কবির পদক প্রত্যাহারের জন্য বইমেলায় ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেছি।

কবি, শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদক আবু কায়সার তাঁর অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ ‘আমি খুব লাল একটি গাড়িকে’ এবং পাঠকনন্দিত ‘রায়হানের রাজহাঁস’ উপন্যাস লিখেও জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি, পাননি একুশে পদকও। তেমনই আরেক খ্যাতিমান কথাশিল্পী শহীদুল জহির ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ অথবা ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’র মতো গ্রন্থ রচনার পরও তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদক থেকে। তাই দুঃখ করে হাসান আজিজুল হক জানিয়েছিলেন, দুই দুই বার চেষ্টা করে শহীদুল জহিরকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এ তালিকা দীর্ঘ। যেমন আবিদ আজাদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কথাও বাদ দিচ্ছি। আমাদের বিদ্রোহী কবি এবং পল্লীকবিকেও এ একাডেমির সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা জাতির জন্য লজ্জার।

একজন অচেনা-অজানা অলেখককে অকারণে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দিলে আমি প্রতিবাদ জানাই। ২০১১ সাল থেকে বাংলা একাডেমির নাম ব্যবহার করে ‘প্রবাসী লেখক পুরস্কার’ চালু করা হয়। পরে নাম পাল্টে ২০১৪ সালে করা হয় ‘বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’। এ সান্ত্বনামূলক পুরস্কার বা বি ক্যাটাগরির পুরস্কারের প্রতিবাদ করেছি। তথাকথিত পুরস্কার তিন তিন বার আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। ২০২০ সালে দুই প্রবাসীকে পদক দেওয়া হয়। তা নিয়েও সমালোচনা হয়েছে, হচ্ছে, হবে। পুরস্কার নিয়ে আমার লেখা আলোচিত এবং মজার একটি কবিতাও আছে।

জাগো নিউজ: দেরীতে হলেও এবার অনুষ্ঠিত হবে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা। আয়োজকদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: গতবছরের বইমেলা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। বিশ্বের বৃহত্তর ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা থেকে শুরু করে টোকিও আন্তর্জাতিক বইমেলা কোভিডের কারণে দুই বছর ধরে হচ্ছে না। কাজেই আমি এ চরম অস্থিরতা এবং ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে বইমেলা না করার পক্ষে। আমার নিজের প্রকাশনী পাঠশালা সে কারণে এবারও অংশ নিচ্ছে না।

জাগো নিউজ: কবিতা-প্রবন্ধ-গবেষণায় আপনার পদচারণা উল্লেখ করার মতো। আগামীর জন্য এমন কি পরিকল্পনা করেছেন, যা আমাদের উপকৃত করবে।সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: লেখালেখি করেই একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম। জীবনের শেষ দিকে এসে বেশ কিছু কাজ করার ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা আছে। যেমন-পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কানাডায় কী হয়েছিল, কেমন ছিল কানাডার ভূমিকা; তা আমরা পুরোপুরি জানি না। অর্ধশতাব্দীর আড়ালে থাকা সেই ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে ২০০৫ সাল থেকে গবেষণা করছি। এখন তিনটি পাণ্ডুলিপির কাজ প্রায় শেষ করেছি। আত্মজীবনী লিখতে চাই। কবিতাসমগ্র, শিশু-কিশোরসমগ্র, গদ্যসমগ্র করতে চাই। লিখতে চাই কবিতা বিষয়ক একটি গ্রন্থ।

জাগো নিউজ: আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমি একটা সরকারি পত্রিকায় কাজ করতাম। আশির দশকের প্রথম দিকে কবি আহসান হাবীবের একটি সাক্ষাৎকার নিই। সে সময় তাঁকে ৫০০ টাকা সম্মানি দিয়েছিলেন পত্রিকার সম্পাদক আরেফিন বাদল। সেদিন হাবীব ভাই সে সম্মানি পেয়ে অবাক হয়েছিলেন। বিদেশেও সাক্ষাৎকার দিলে মিডিয়া টাকা দেয়। তা তোমার ধন্যবাদের সাথে একটা ‘খাম’ দেবে না? হা হা হা!

এসইউ/জিকেএস