সজীব ওয়াফি
Advertisement
করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.১.৫২৯। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। নানা নিষেধাজ্ঞা এবং সতর্কতা জারি হয়েছে উন্নত রাষ্ট্রগুলোয়। সংক্রমিত হচ্ছে আগের চেয়েও বেশি হারে। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশে করোনার জিনগত মিউটেশনে বিশ্বজুড়ে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে এমন শঙ্কাময় পরিস্থিতি।
বেশ কিছুদিন হলো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জারি করা হয়েছে ১৫ দফা সতর্কতা। সরকার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে জানুয়ারি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্ধিত সময়। জানানো হয়েছে, মার্চ থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পুরোপুরি হবে কি না সেটা নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। গণপরিবহন, হাট-বাজার ও রাস্তাঘাটসহ ঘরের বাইরে বের হলেই স্বাস্থ্যবিধি পালনের জোর তাগিদ দেওয়া হলেও কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অনীহা-অনাগ্রহে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হওয়া এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ।
গত বছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের নানা প্রান্তে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়। আহ্বান জানানো হয় সামাজিক দূরত্বের। বাধ্যতামূলকভাবে এ ভূখণ্ডেও অচল পরিস্থিতি বরণ করেছিল। কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি কোম্পানির ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে বেকারত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল অসংখ্য মানুষ। বন্ধ ছিল রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ। কেবল অপেক্ষা ছিল আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর সাইরেন শোনা।
Advertisement
বিদেশফেরত অনেক প্রবাসী আর ফিরে যেতে পারেননি। চাপে-বিপাকে, উৎপাদন সংকটে নানান জটিলতা আছড়ে পড়ে দ্রব্যমূল্যের ওপর। সংকটকালীন এই সময়ে প্রবাসীদের সঞ্চয় রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতি সামাল দিয়েছে। জনজীবনে হাপিত্যেশ উঠেছিল– কবে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে? করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো অর্থনীতি। যদিও ততদিনে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে!
অতিমারিকালীন জোর দেওয়া হয়েছে অনলাইন শিক্ষণ কার্যক্রম। শহরের এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনের আওতায় এলেও সক্ষমতা ছিল না প্রান্তিক পর্যায়ে। পরিণামে শহর এবং গ্রামের ভিতরে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরে বাস্তবে দেখা গেল– নীতিনির্ধারকদের ভুলের মাশুল দিতে ভুক্তভোগী হয়েছে গরিব পরিবারগুলো। ঝরে পড়েছে গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে পড়াশোনার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আগ্রহ হারিয়েছে কেউ কেউ। মেয়েরা শিকার হয়েছে বাল্যবিবাহের। গণমাধ্যম মারফত প্রকাশিত হলো বিয়ে হয়ে যাওয়ায় কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মতো কেউ ছিল না।
করোনা প্রতিরোধ করতে আগে ভ্যাকসিন পেয়েছে উন্নত দেশগুলো। এমনকি কিছু সংখ্যক রাষ্ট্রে ইতোমধ্যে বুস্টার ডোজ দেওয়া শেষ। যেখানে অনুন্নত দারিদ্র্য রাষ্ট্রগুলো প্রথম ডোজ দেওয়াই এখনো শেষ করতে পারেনি। তাহলে দারিদ্র্য দেশগুলোকে পেছনে ফেলে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নিজেরা ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে ঝুঁকিমুক্ত হতে পারলো? পারলো না, বরং স্পষ্ট হয়ে উঠলো– পিছিয়ে পড়া দারিদ্র্য ওইসব দেশ থেকেই বারবার মিউটেশন হচ্ছে, অতঃপর পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এবং আগের টিকা অকার্যকর। এতেই প্রমাণিত হয় সামষ্টিক লড়াই ছাড়া করোনাভাইরাস অপ্রতিরোধ্য।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে ওমিক্রন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বন্ধ আছে ভারতে আমাদের গাঁঘেঁষা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সারাবিশ্বে সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ৪৫টির অধিক দেশ। অসহায় হয়ে পড়েছে সেখানকার নাগরিকরা। ওমিক্রন ধরা পড়েছে বাংলাদেশেও। বর্তমানে একদিনে আক্রান্ত হচ্ছে হাজারেরও বেশি মানুষ। অথচ ব্যক্তিপর্যায়ে আমাদের কোনো খেয়াল নেই, উদ্বেগ নেই। যে যার মতো লাগামছাড়া। একরকম খাপছাড়া পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষায় হয়তো আবার স্কুল-কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বিপরীতে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে ন্যায়সঙ্গত কারণেই হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার তুমুল বিরোধিতা। লকডাউনে না গেলেও অর্থনীতি এবার সামাল দেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে নিশ্চিত। চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে করোনায় ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা কাটিয়ে উঠতে। সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তির শতভাগ সদ্ব্যবহারের প্রস্তুতি রাখা এখন গুরুত্বপূর্ণ।
Advertisement
করোনা আক্রান্তের পর থেকে অসংখ্য মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ। তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ ঠেকাতে ঢালাওভাবে নিষেধাজ্ঞা কেবল বিলম্বিত করতে পারবে; কিন্তু প্রান্তিক পর্যায় থেকে নাগরিক সতর্কতা অবলম্বন না করলে ঠেকানো সম্ভব নয়। জীবনের ওপর মহামূল্যবান কিছু নেই। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধকরণ ছাড়া তখন বিকল্প কোন উপায় থাকবে না।
নাগরিক গণসচেতনতা জোরদার প্রত্যাশিত। ভবিষ্যৎ সুরক্ষা আমাদের সামষ্টিক আচরণের ওপর নির্ভর করছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ঢাকা।
এইচআর/ফারুক/এমএস