দুর্জয় খান
Advertisement
এক শীতের রাতে জবুথবু হয়ে আমি পাঠ করেছি কবি শব্দনীলের কাব্যগ্রন্থ ‘ভাদি পুঁটির ঝাঁক’। পাঠ করতে করতে ককতোর কবিতা সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু কথা মনে পড়ে যায়। যে কারণে ভাদি পুঁটির ঝাঁক নিয়ে কিছু বলতে মন চাইলো। কবি শব্দনীল তার ভাদি পুঁটির ঝাঁক কাব্যগ্রন্থে আবেগজনিত ভ্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো এড়িয়ে গেছেন। চলে গেছেন জীবনস্তের দিকে। কবিতায় মূল কাহিনি, কাঠামো, অবকাঠামো ঠিক অবিকৃত রেখে ভিন্ন রূপান্তরে আবির্ভূত হয়েছেন। এই যে রূপান্তরের ধ্বনি কবিতার সমস্ত লেলিহান নদী যেন এক কন্যাকুমারি বিমূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে!
মানুষের মনোজাগতিক এত বিচিত্র রঙের সমাহার যার পর্দা সরিয়ে দেখলে মৃত্যু হা করে বসে থাকে! এই যে পতনবিভূতির অনুভব, মহানুভবের যাত্রায় কেবল পতনই অস্পষ্টভাবে চেতনজুড়ে থাকে। তবুও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে পতনই কি শেষযাত্রা! যেখানে কবি শব্দনীল স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ‘ঝরে যাওয়া ফুলেরা মৃত?’ আমি এ ধ্বনির রহস্য আজও উন্মোচন করতে পারিনি। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারছি কিংবা উপলব্ধি করছি, এখানে আদিম এক সৌন্দর্যের নিগূঢ় নির্দেশনা কিংবা অ্যালিউশন স্পষ্ট করেছেন কবি। এই একটি বাক্যে বিষয়বস্তুর মধ্যে ব্যাপকতা ও গভীরতা তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছে। কিভাবে করেছেন? পড়া যাক তার একটি কবিতা, যেখানে তিনি অ্যালিউশন থেকে অ্যালিটারেশনে ঘুরিয়ে দিয়েছেন!‘সকালের রোদ ছুঁয়ে আমার মা প্রজাপতি হতে চায়ডানা মেলে, নিত্য একটু সময় খুঁজতে আমি’বা তার সংসার সে সুযোগ কখনও দিয়েছি কি? ঠিক মনে পড়ে না। তার এক জনম যাচ্ছে কেটে ক্ষয়ে ক্ষয়েধোয়াপালার থালাবাসনের সঙ্গে।একদিন মাকে বললাম, ‘আপনি কবে প্রথম শাড়ি পরেছেন?’ সাধারণ প্রশ্ন, কিন্তু কী আশ্চর্য! এই প্রশ্নে জেনে গেলাম মা হাসতে পারে,মাও লজ্জায় কিশোরী মেয়ের ঢঙে কথা বলতে পারে!অথচ আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি,আমার মায়ের শৈশব ছিলো।’ (রোজিনামা)
খুব কাছাকাছি অবস্থিত গুটিকয়েক শব্দাবলী। আসলেই শব্দনীল যে শব্দের কারুকাজ সাজিয়েছেন তার উচ্চারণ-ধ্বনির পৌনঃপুনিক ব্যবহারে অ্যালিটেরশনের পথকে সুবিস্তীর্ণ দৃশ্যপথের ভেতর আবিষ্কার করা যায়। এখানে আমি ভাবনা ও উপলব্ধির বিষয়ে পরে আসছি, আগে বিচার করা যাক এসব ধ্বনি ও ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রে এবং শব্দের আদি থেকে আদিতে কিভাবে তিনি অ্যালিটেরশনকে পরিপূর্ণভাবে যোগ করে দিয়েছেন। এ ধরনের শব্দযোগ প্রাচীন ইংরেজি কাব্যে পরিলক্ষিত হয়। কবি শব্দনীল অ্যালিটেরশনের প্রথম চিহ্ন রোজিনামা কবিতার প্রথম চরণেই ফুটিয়ে তুলেছেন, ‘সকালের রোদ ছুঁয়ে আমার মা প্রজাপতি হতে চায়’। এই অ্যালিটেরশন কিংবা অনুপ্রাসে কলরবের লুপ্ত গানে তথা আবহনির্মাণ করেছেন। শব্দ ও শব্দার্থকে গাঢ়তর ব্যঞ্জনা দান করেছেন। ধ্বনি-মাধুর্যের পরম্পরাকে ছিঁড়ে পৃথিবীর সন্তান তথা মানুষের বিভূতিকে দুলিয়েছেন।
Advertisement
শব্দনীলের ভাবনার মতোই সুবেহ সাদিক, মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে ওঠা আজানে মানুষের আগমনী চিৎকার ভাসে যেন! বিষণ্ন যন্ত্রণার পথে ছুটতে ছুটতে মানুষ তার সন্ধ্যার সাঁঝবাতি অথবা খাঁচার প্রিয় পাখিটিকে আজন্মের মতো হারিয়ে ফেলে। এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের সংবেদনশীলতার বিচ্ছেদ তো ঘটেই গেছে; সেইসাথে উত্তরাধুনিকতার চাদরে আমরা এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছি যে প্রেম ও সমর্পণের অন্তঃস্থ সুর প্রায় ভুলে গেছি। এমন আর্তনাদের সময়ে কবি শব্দনীল ছন্দ, শব্দ বা ভাবের দিক থেকে অসামঞ্জস্য, কর্কষতা বা অসঙ্গতি কিংবা ডিসোন্যান্স একেবারে ত্যাগ করে অনাবৃত সময়ের ভেতর জীবন-প্রেম-প্রশ্নের সবগুলো উত্তর লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। ‘মাইকে ভেসে আসা শোক সংবাদেখুব মনোযোগ দিলে শুনতে পাবে /*খসে পড়া বরই পাতার মতো মানুষও আচমকা পড়ে খসে।’ (শূন্য)পতনের সুর এর চেয়ে আর কী হতে পারে! কবি তো এখানেই দ্রষ্টা, তিনি শুধু ভবিষ্যৎ দেখেন না। দেখছেন নিজের ও মানুষের অন্তঃকরণ, ছায়া, মগ্নচৈতন্য, হৃদয় খুঁড়ে জাগাবেন বেদনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, ললাটলিপির মতো যুক্তিহীনতা! শব্দনীল বেশিদূর না এগিয়ে অদৃশ্য এক সাবলীল পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন, যেখানে পাঠক ছোট ছোট ইমেজগুলো কুড়োচ্ছে আর জোড়া লাগাচ্ছে। কবিতার শেষ ঝড়ো হওয়া ইমেজগুলোর উদযাপন উপলব্ধি করছে। এতে পাঠকের কী আনন্দ! ওদিকে শব্দনীল নির্লিপ্তে গল্প বলার ভঙ্গিতে অনবরত কবিতা অর্থাৎ জীবন-প্রেম ও সমর্পণের উলম্ব চিত্র এঁকে যাচ্ছেন। এক বিদৃশ্যাবলী থেকে ভাদি পুঁটির ঝাঁক ধীরে ধীরে শস্য-জলের ভেতর একক ভাষাহীনতার জগৎ গড়ে তুলেছেন, যেখানে পাঠক ভাবনায় নিমজ্জিত তথা পাঠক কথা বলছেন নিজের সাথে। ভাবনায় ভাবনায়। মনোরম এক আবহসংগীতে সমস্ত দীনতা, হীনতা, অসুখ, পুরাতন কথাকলি কিংবা অস্পষ্ট কোনো স্বর নিয়ে অনবরত খেলছেন।
বলা যায়, সাধারণভাবে প্রগাঢ় অনুভূতি। কবিতায় এ ধরনের চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ে। তবে একেকজন কবির প্রয়োগ ক্ষমতা এক নয়। বস্তুত, এ ক্ষমতাটুকু একজন কবি আবিষ্কার করেন মানুষের মৌলিক একাকিত্বের জায়গা থেকে। যেখানে তার সৃষ্ট সুবিস্তৃত শিল্পের জগতে মূলত ভয়াবহ একাকিত্বের ফসল ফলে, সোনালি ফসল! এত সব চিত্রকল্পের ভেতর প্রেম, শরীর, নারীত্ব, পৌরুষ, সবকিছুই শিল্পের দিকে হেঁটে চলে। ‘প্রশ্ন’ কবিতায় কবি ঈশ্বর ও নারীকে আদর্শিক সংঘর্ষের মধ্যে দাঁড় করিয়েছেন। যেখানে কবির আত্মদ্বন্দ্ব অত্যন্ত সাংঘাতিক পাঠকের জন্য। বিশেষত নারীর জন্য! হয়তো জীবনের প্রত্যুষে কোনোকালে রঙের মায়া ধরেছিল কবির চোখে। যে মায়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের সর্বাংশ ব্যয় করে ফেলেছেন। তারপর কি! ওই যে পতন বিভূতির স্বর চেপে ধরলে বিনম্রভাবে বেছে নিয়েছেন ঘরের এক কোণ। যখন কবিতা কিংবা প্রেমিকা হঠাৎ আবির্ভূত হয়; তখন স্বপ্ন দেখে বিছানা থেকে পড়ার উপক্রম বটেই! ‘প্রশ্ন’ কবিতায় প্রেমিকাকে ধরবো না-কি কবিতাকে ধরবো, এই শৈল্পিক মারপ্যাঁচের ডগায় পাঠককে হতচকিত করার দুঃসাহস করেছেন কবি! যতদূর জানি, কবিতা কিংবা প্রেমিকা ঈশ্বরের মন নরম হলেই কবির পৃথিবীতে কিংবা দরজার সামনে এসে উপস্থিত হয়।
শুধু প্রাপ্তিতে বা মিলনে সুখ নেই, অপ্রাপ্তি বা বিরহেও সুখ আছে। অপ্রাপ্তি কিংবা বিরহের এই পারিজাত শব্দনীলের কবিতায় ফুটে উঠেছে শব্দের মর্জিতে, জোরজবরদস্তি কিংবা বেহিসাবিভাবে নয়। কবিতায় সব শব্দ যেন আমার শব্দ, পাঠকের শব্দ। সাবলীল শব্দ প্রয়োগই স্বতঃস্ফূর্ত করেছে শব্দনীলের কাব্যভাষা। শব্দের পাশাপাশি উপমা প্রয়োগ ও চিত্রকল্পের ব্যবহারও পাঠকের অনুভূতিকে নাড়িয়ে দেয়। এটা পুরোপুরি যথার্থ কি-না জানি না, তবে কবিতাদেহের শিরা-উপশিরায় মিশেল করে দেওয়ার ক্ষমতা শব্দনীলের আছে। যেখানে পাঠকের মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। মনোযোগ বাড়িয়ে দেওয়ার আরেকটা কারণ হলো কবিতায় প্যারাডক্স। যাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পরস্পরবিরোধী এবং উদ্ভট। কিন্তু যার মধ্যে পরে একটি যুক্তিগ্রাহ্য অর্থ আবিষ্কার হয়। বর্তমানে প্রায় সব কবি প্যারাডক্স ব্যবহার করেন। তবে এটি ‘মেটাফিজিক্যাল কাব্য’র কেন্দ্রীয় কৌশল। ভাদি পুঁটির ঝাঁক কাব্যগ্রন্থে ‘ঝরাদের কথা’ কবিতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর পোয়েটিক ডিকশনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্যণীয়। যেমন: শব্দের প্রাচীন রূপ ব্যবহার; বিমূর্ত কিংবা জড়বস্তুর মানবিকীকরণ, সরাসরি ও সহজভাবে কিংবা সাবলীলভাবে ঘরোয়া ভঙ্গিতে সুপরিচিত শব্দের সাহায্যে বক্তব্য উপস্থাপন করা। কবি শব্দনীল লিখেছেন, ‘ঝরে যাওয়া ফুলেরা কি মৃত/ যেমন মানুষ ঝরলে লাশ!’ অর্থাৎ একই ধরনের শব্দসম্ভার কিন্তু পোয়েটিক ডিকশনে সর্বদাই উপস্থিত।
শব্দনীল সহজানন্দের নৌকা বেয়ে শূন্যতার মিলনে মহানন্দে প্রবেশ করেছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন ধ্যান-জ্ঞান-গান। ধান তুলে অপরিশুদ্ধ চিত্তকে প্রভাস্বর প্রকৃতিতে বিলীন করে রূপবেদনাদির উজ্জ্বল পেয়ালায় দ্ব্যর্থহীনভাবে গলধঃকরণ করেছেন ভেদজ্ঞান! শূন্যতা আর রূপজগতের সব ধারণা তিনি লুপ্ত করে ফেলেছেন। এখন তিনি সর্বদাই সর্বশূন্যতায় লীন। তরু নামক মনের এবং শাখা-প্রশাখা নামক পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সব কামনা-বাসনা ছেদন করে পুনরায় নিজেকে উৎপন্ন করেছেন। সেই উৎপন্নের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ভাদি পুঁটির ঝাঁক। মূলত যা কিছু মনের দ্বারা গ্রাহ্য হয়, সবই বিকল্পাত্মক। মোটকথা সবই ইন্দ্রজালের মতো মায়াময়। কবিতা যেমন সহজানন্দসহিত লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা অনুভব করতে হয়, ঠিক তেমনই ধীর অথবা স্থির হতে হয়। আমাদের বোধিচিত্ত যতটা শুভ্র; ততটাই সহজানন্দকে আয়ত্ত করা যায়। প্রথমত কবি শব্দনীল কবিতায় যথাযথ ভাষা ব্যবহারের যৌক্তিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
Advertisement
কবি শব্দনীল দ্বিধাহীনভাবে কবিতার প্রতি তার কাব্যভাষা প্রয়োগ করেছেন সাবলীলভাবে। চমৎকার অলংকার পরিয়ে কবিতাকে নতুন বধূর মতো সুন্দরী করে তুলেছেন। ভাষা নিয়ে তৈরি করেছেন স্বর্গীয় উদ্যান। যে উদ্যানে শব্দে শব্দে ফুটিয়ে তুলেছেন অমৃত কোমলগান্ধার! এ প্রসঙ্গে তার ‘ভাষা’ কবিতাটি পাঠ করা যাক:‘মুখভার করা আষাঢ়ের আকাশ দুপুরকালে, অঝোরে কাঁদতে শুরু করায় আশ্রয় নিলাম কাঁঠালতলায়। কাঁঠালতলায় শানবাঁধা পুকুরে তখন তোমার চিবুকে ভাসা তিলের মতো নয়, মধ্য কপালের আহ্লাদী কালো টিপের মতো ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরা নোনা।....কিশোরীর নরম পেটের মতো তার অঙ্গে লেপ্টে যাওয়া হলুদ শাড়ি দেখে, ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক-পানিতে আচমকা ঘাঁইমারা শৈলমাছের মত খিলখিল করে উঠলো।’ (ভাষা) এখানে আষাঢ়, আকাশ, দুপুরকাল, অঝোর, কাঁদা, কাঁঠালতলা, শানবাঁধা পুকুর শব্দগুলো অতি পরিচিত। শব্দনীল কবিতার শুরুতেই এসব শব্দ ব্যবহার করে একটি চিত্রপট তৈরি করেছেন। পরে সেই চিত্রে রং মিশিয়েছেন! বালিকার চিবুকে ভাসা তিল আর মধ্য কপালের কালো টিপ! এ দুটি হলো কবিতার মূল অলংকার বা রং। সবগুলোই সাবলীল শব্দ কিন্তু শব্দের পিঠে শব্দ বসিয়ে হৃদয়কে আন্দোলিত করে পূর্ণাঙ্গ চিত্রের মাধ্যমে পাঠককে আকর্ষিত করেছেন। পরে পুকুরের উঠোনে স্বমহিমায় নববধূ! যার হলুদ শাড়ি কিশোরীর নরম পেটের মতো অঙ্গে লেপ্টে আছে। কবি লক্ষ্য করেছেন, এখানে একজন পাঠক নয় বরং একজন চিত্রশিল্পী তৈরি হবেন। সেই চিত্রশিল্পীর ভেতর থেকে এমন এক সহজানন্দের উৎপত্তি হবে, যা সৃষ্টির আদি থেকে অনাদি পর্যন্ত বহমান, অনস্বীকার্য।
কবি শব্দনীল কবিতার সুষম, সংহত, প্রত্যক্ষ সৌন্দর্যময় রূপাবয়বের সৃষ্টি করেছেন। তার কবিতায় সৌন্দর্যময় রূপাবয়বের সৃষ্টি করে পাঠকদের নতুন জগৎ সন্ধানে আন্দোলিত করেছেন। যা স্বচ্ছ, প্রাঞ্জল এবং বোধগম্য। রূপাবয়বের সুন্দর বণ্টন করে সুন্দরের মানদণ্ড দাঁড় করিয়েছেন পাঠকের কাছে। কবিতায় দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়, একটি হলো রূপাবয়ববের বিন্যাসগত সৃষ্টি। অপরটি হলো ভাবাবেগের সুনিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস। প্রেম, বিরহ, মানুষ, জীবন, জগৎ, সমাজব্যবস্থা সবকিছু তিনি ক্ল্যাসিকের ধারণায় রূপগত এবং সংহতি, ঘন, প্রাঞ্জল সৌন্দর্যের দ্বারা কবিতার জগতের ভেতর তীব্র হৃদয়াবেগের শৈল্পিক নতুন কবিতার জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তার কবিতায় উপলব্ধি করেছি, আত্মস্থ ক্ল্যাসিক নির্মাণ ভেঙে পুনরায় উত্তরাধুনিকতার নির্মাণ করেছেন। ছোট ছোট সাধারণ বিষয় মানুষের জীবনের কথায় রূপায়িত করে স্বতঃস্ফূর্ত একাত্মতার অভিব্যক্তি নির্মাণ করেছেন।
কবিতায় তার কল্পনার বিস্তার ঘটিয়ে বিষয়মুখ্যতা, সাবয়বতা, প্রাঞ্জলতা ও শব্দের পৃথকীকরণ করে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন। কল্পনায় মৌলিকত্ব যোগ করে কাব্যব্যঞ্জনায় অবিচ্ছেদ্য লৌকিক চিত্রকল্প কিংবা প্রেমকল্পের অপূর্ব বিন্যাস ঘটিয়েছেন। যদি তার ‘আত্মকথা’ কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করি, তবে বুঝতে পারবো তিনি এক বিচিত্র জগৎ-সৌন্দর্য ও পার্থিব ভোগের পেয়ালা চান। যেখানে রোমান্টিকতার সঙ্গে ডিভাইন ডিসকনটেন্ট অর্থাৎ অমর্ত্যের রোমান্টিক অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে তিনি নারীর প্রতি অথবা প্রেমিকার প্রতি একইসঙ্গে যে ইমপ্রেশনিজম, সিম্বলিজম, এক্সপ্রেশনিজম, ডাডাইজম, সুররিয়ালিজম ইত্যাদি শিল্পতত্ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আবার যদি ‘স্পর্ধার ক্রুশ’ কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করেন, তবে উপলব্ধি করতে পারবেন মানুষ-জীবন-পাপ-পূণ্য এবং জাগতিক স্পর্ধা সম্পর্কে।
কবির কবিতা বিচার করলে লক্ষ্য করা যাবে, একদিকে তার আত্মিক সত্তা, যেই সত্তা জাগতিক ও অস্তিত্বের সসীমতা ও অসীমতা, জাগতিকতায় মানবদ্রষ্টা ও কাব্যস্রষ্টার মধ্যে এক অভিনব সংযোজনের মাধ্যমে মুক্তছন্দকে নিজের মতো উপস্থাপন করেছেন। কবিতার সব স্ট্রাকচার ভেঙে, কবিতার সব আঙ্গিক উপেক্ষা করে মনোধর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ কাঁটাছেঁড়া করেছেন। একটি কাব্যগ্রন্থে যখন একাধিক সমাচার থাকে; তখন পাঠককে নানা দীনতায় ভুগতে হয়। যা তিনি ভাদি পুঁটির ঝাঁকে করেছেন। পাঠককে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে পড়তে হয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। এর মূল কারণ কবিতা উপক্রম। ক্রমান্বয়ে সঠিক মতবাদগুলো প্রকাশ করা। বিছিন্নভাবে মুক্তছন্দের পাশাপাশি কাব্যভাবনা ব্যাপক, বিস্তৃত এবং বিচ্ছিন্ন। কবিতার বাক-প্রতিমা কিংবা ইমেজারি যাই হোক না কেন, বর্তমানে কবিতার ভাবনা বিচ্ছিন্ন বটে। তবে একে কবির দুর্বলতা বলা যায় না। বরং এখানে হিত ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
এসব বিষয় মাথায় রেখে ছন্দপ্রকরণ কিংবা যতিপ্রকরণ তিনি খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার করেছেন। জীবনের বহুবিচিত্র গতিশীল নিত্যপ্রবাহের প্রতি নিগূঢ়ভাবে মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন। যুক্তিশৃঙ্খলায় যাই হোক না কেন, প্রাকরণিক উৎকর্ষে নিখুঁত শিল্পনির্মাণই তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বলে সন্দেহ নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ততা, আপাতগ্রাহ্য দৃষ্টিভঙ্গিকে ইন্দ্রিয়াতীত অনুভবের জগতকে পরিচ্ছন্ন শৈলীতে অভিনব রোমান্টিক আন্দোলনের বীজ বপন করেছেন। একদিকে তার কবিতায় যেমন ফ্যান্টাসি লক্ষ্যণীয়, অন্যদিকে রোমান্টিকতার অনুপুঙ্ক্ষতার মধ্য দিয়ে ব্যঞ্জিত হয়েছে রহস্যময় দ্যোতনা। সাবলীল শ্বেতশুভ্র রচনার মধ্য দিয়েই ভাদি পুঁটির ঝাঁক আমার ও পাঠকের অনন্ত জিজ্ঞাসার প্রকরণগুলোকে আপ্লুত করে শিল্পরূপ সমুদ্রের ভেতর রহস্যময়তার অনুভব করিয়েছেন।
ভাদি পুঁটির ঝাঁক সেসব মন্ত্র আয়ত্ত করে প্রেমের, মনসত্ত্বের, শিল্পতত্ত্বের, মানসপুরাণের, নারী, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, শোষণ, ভোগ, বিলাস, আনন্দ, বেদনা কবিতায় সংযোজন করেছে। সংযোজন করেছে শব্দ, গন্ধ, বর্ণ ও স্পর্শ। জাগিয়েছে পরস্পরের ভেতর ইন্দ্রিয় বিপর্যাস। এ প্রসঙ্গে কবিও বলেছেন,‘তুমি নাই তাই আজ, ফোটেনি ড্যাফোডিলশুভ্র আসেনি সাতাশ নম্বর স্ট্রিটেশুধু আমি এসেছি’(যে কথা ছিলো না)কবি এভাবেই যাবতীয় যৌক্তিক পারস্পর্য ভেঙে বিমূর্ত অনুভবের স্পন্দন চালিয়ে দিয়েছেন পাঠকের মনন ও মগজে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে প্রতীকের মোড়কে গড়ে তুলেছেন অভিধা-অতিরিক্ত অনুভূতির জগৎ। ভাদি পুঁটির ঝাঁকের ‘নিথর সুখ’ কবিতায় প্রতীকের সন্ধান পাওয়া যায়। যা ‘শিশুর নরমগালে হাত বুলানোর সুখ’। ওই কবিতায় কবি বেশকিছু প্রতীক ব্যবহার করে কবিতার গভীরতাকে উন্মোচিত করেছেন সিম্বলিজমের দ্বারা। অর্থাৎ আভাস গন্ধ, স্বাদ-গন্ধ, উপহার দেওয়ার আনন্দে মেতে গিয়ে মানুষের মনস্তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কবিতায় কোনো বস্তু থাকে না। উলম্ব হয়ে ঝুলে থাকে কতগুলো অলীক চিহ্নের খেলা! যোগ-বিয়োগের খেলা!
এসইউ/এএসএম