জোবায়ের মিলন
Advertisement
‘বিবর্ণ আকাশ, মেঘ রাশি রাশি/ কান্না হয়ে ভেঙে পড়ে বর্ষা অবিনাশী/ থাইগ্লাসে জমা হয় শিশিরের বেশে/ থেকে যায় বিষণ্নতা বৃষ্টিপাত শেষে।’ (বৃষ্টির কবিতা আর লিখবো না)। ‘ওই চোখে ছিলো জাদুকরী মায়া/ রাশিফল সংকেত নীল নেপচুন/ সম্মোহিত আমার অন্তরাত্মা/ দৈনিক পত্রিকার শিরোনামে খুন।’ (সম্মোহন)।উপর্যুক্ত কবিতা দুটি কবি ব্যারিস্টার রোবাইয়াৎ ইসলামের কাব্যগ্রন্থ ‘অবুঝ অনুধাবন’ থেকে উদ্বৃত। তরুণ এ কবির এটিই প্রথম কবিতার বই। বক্তব্যে নবীনতার ছাপ আছে, তবে বিশদে বলাটা পরিষ্কার। স্বপ্নের ঘোরে ঘোর লাগানোর ইশারার ইঙ্গিত পাওয়া যায় স্বল্প পরিসরে। কিন্তু উচ্চারণটা বিস্তর। কবিতায় শুধু কয়েক লাইনের পঙক্তিমালায় একটা পুরো জীবন, একটা আকাশ সমান ভালোবাসা, এক সমুদ্র জলোচ্ছ্বাসের বিপ্লব, মহাশূন্যের সবটুকু হাকাকার কবি লিখে দেন বলিষ্ঠ স্বরে।
কবি নিজেকে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবকে, ছোট-বড় দেখা-অদেখা সব আকাঙ্ক্ষাকে কবিতার সূক্ষ্ম বুননে নকশায়িত করেন। একেকটা কবিতা তখন যেন একেকটা বিমূর্ত মুহূর্ত। এ রকমই কিছু মুহূর্ত কারুকার্যময় শব্দের জালে বন্দি হয়ে, কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে ‘অবুঝ অনুধাবন’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয়। কিছু কবিতা কবির কলমে প্রেমিকের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার শাশ্বত রূপ হয়ে ভেসে উঠেছে। আবার কিছু কবিতায় যেন একেকটা ঘটমান মুহূর্তকে ফ্রেমে আটকে ফেলা হয়েছে।
‘নীল, মেরুন আর হলুদ রঙের মতো তোমার কথাগুলো/ প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে সমস্ত স্মৃতি আজ এলোমেলো/ জানি, প্রধান আসামি সমসময় একজনই হয়-/ স্মৃতির আঙিনায় আজ কথামালার অবক্ষয়।/ স্মৃতির কাঠগড়ায় আজ আমি দোষী/ মাঝে মাঝে তাই আনমনে হাসি,/ আমি স্মৃতিভ্রষ্ট নই-/কিন্তু পরাজয় বরণে আজন্ম অভ্যস্ত।’ (আমি স্মৃতিভ্রষ্ট নই)।
Advertisement
অনেক জায়গায় কবিকে নিভৃত পরিশ্রমী হিসাবে পাওয়া যায়। আবার অনেক জায়গায় রংটা ফ্যাকাসে লাগে সহজভাবে। চেষ্টার ত্রুটি নেই বটে, প্রকাশের তাড়াহুড়া আছে। গ্রন্থস্থ কবিতাগুলোয় উপরতলের ছবি বেশি। গভীরে ডুব দেওয়ার সুযোগ কম। সিঁড়ি নেই। কবিতায় সে সিঁড়িটা খুবই জরুরি।
‘আমি বহুদিন খুঁজেছি তোমার কাজলটানা দুচোখ/ তার অশ্রু, তার আগুন/ তার শঙ্খনীল ঝিনুকমালা/ আর নুড়িপাথর বিছানো সৈকত/ রক্তাক্ত ফাগুন।/ আমি মানুষের ভিড়ে খুঁজেছি পরিত্রাণ/ খুঁজেছি ব্যথা নিরাময় কেন্দ্র, বিপণিবিতান/ মানুষ আর কিই বা দিতে পারে!/ স্বপ্ন আর কতদূর যায়?/ শবাযাত্রায়- কাঁধে করে নিয়ে আমারই লাশ/ আমার দুচোখে আজ ধোঁয়াশা ধূসর তীব্র অবিশ্বাস।’ (অবিশ্বাস)।
বইটির অনেকগুলো কবিতাই ভালো। অনেকগুলো কবিতার শুরু শেষে খাপছাড়া। অনেকগুলো কবিতায় আছে চুম্বুকাংশ। অনেকগুলো কবিতায় ছন্দ মেলানোর আগ্রহ দেখা গেছে কিন্তু মিলটা ছুটে গেছে একটু এগিয়েই। কবিতার কথাগুলো পরিষ্কার হলেও অনেক জায়গায় একেবারে কাঁচা হাতের মনে হয়। মনে হয়েছে, কবি আরও একটু অভিজ্ঞ হয়ে বই প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারতেন। আরও একটু সময় নিয়ে কবিতাগুলো কেটেকুটে আর একটু পোক্ত করতে পারতেন। আধুনিক কবিতায় কবির পাঠ যে কম, তা বোঝা যায় কবিতাগুলো পড়তে থাকলে। কবিতা নিয়ে উলোট-পালটের চর্চাও যে কম তা-ও অস্বীকারের সুযোগ তৈরি করে না কবিতাগুলো।
‘হাজার বুলেট নেব না/ একটি কবিতা দাও/ লক্ষ লক্ষ পরাক্রমশালী বুলেট-/ আনতে পারেনি এক চিলতে-ও পরিবর্তন/ কিন্তু একটি মামুলি-অধম কবিতা ভেদ করে যায় কোটি কোটি হৃদয়।/ প্রেমিকের আদর মাখা চুমু নেব না/ একটি কবিতা দাও।’ (একটি মামুলি-অধম কবিতা)।
Advertisement
কবিতার মতো কবিতা হলে একটি কবিতাই যেমন ভেদ করতে পারে কোটি হৃদয়; তেমনই একটি বইকেও করে তুলতে পারে যুগের সার্থক বই। সেরকম কবিতা নির্মাণের জন্য একদিকে যেমন থাকতে হয় প্রচুর অভিজ্ঞান; তেমনই থাকতে হয় প্রচুর পাঠাভ্যাস। যুগ যুগের কবিতার ধারায় চোখ রেখে আপন ধারাকে এগিয়ে নিতে হয় নিমগ্ন মনে। সেই সাথে বইয়ের প্রচ্ছদ, বাইন্ডিং, পেপার, পেস্টিং ইত্যাদির দিকেও নজর রাখতে হয় সচেতনভাবে।
‘রাত আড়াইটা বাজবার আগেই আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হই/ কারণ ঘড়ির টিক-টক শব্দ আমার বুকে-/ কফিনের শেষ পেরেকসম বিদ্ধ হয়।/ অ্যাম্বুলেন্সের বিপদ সংকেত/ আমাকে ট্রমাটাইজড করে,/ সুনিপুণভাবে ভয় ধরায় মেরুরজ্জু ও অস্থিমজ্জায়।/ অবসন্নতা জেঁকে বসে করোটির দুপাশে/ ঠান্ডা ঘামবিন্দু নেমে আসে কপালে,/ অতীত হিংস্র থাবা আমাকে ভিক্টিম বানায়/ তোমার স্মৃতি আজ সায়ানাইড বিষ/ নিমিষে খুন করে আমায়।’ (ট্রমাটাইজড)।
ত্রুটি একটু বেশি আলোচিত হলো বলে এটা ভাবার কারণ নেই যে, গ্রন্থস্থ ছাপ্পান্নটি কবিতার সবগুলোই প্রভাবহীন। অনেকগুলো কবিতা বেশ সুন্দর। পাঠতৃপ্তির। ভালো লাগলো বলেই আলোচনা। আর কবির হাতে আরও ভালো করার সামর্থ আছে বলেই সমালোচনা। কবি শেখ রোবাইয়াৎ ইসলাম তার পরবর্তী বইতে আমাদের আরও কাব্যগুণ সম্পন্ন কবিতা উপহার দেবেন, সেই আশা রেখে ‘অবুঝ অনুধাবন’ কাব্যগ্রন্থটির সাফল্য কামনা করছি।
বই: অবুঝ অনুধাবন ধরন: কবিতাকবি: ব্যাবিস্টার শেখ রোবাইয়াৎ ইসলাম প্রচ্ছদ: রাজু আহমেদ প্রকাশনী: শব্দশিল্প দাম: ১৫০ টাকা।
আলোচক: কবি ও কথাশিল্পী, সহকারী প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি।
এসইউ/এএসএম