লাইফস্টাইল

করোনার এ সময়ে যেভাবে সতর্ক থাকবেন

করোনাভাইরাসের বিস্তার এবং প্রাণহানী বিশ্বজুড়ে বেড়েই চলেছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সবার উদ্বেগ। বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সংক্রমিত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৮ লাখেরও বেশি। বিগত ২০২০ সালেই বিশ্বের ১০৪তম দেশ হিসেবে কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ। যার দ্বিতীয় ওয়েভের রেশ এখনো বয়ে চলেছি আমরা। গতবছরের ৮ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ৩ জনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল আমাদের দেশে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখেরও বেশি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় ৯২০০ জন আক্রান্ত ব্যক্তিকে আমরা চিরতরে হারিয়েছি।

Advertisement

সম্প্রতি বেশ কিছু মাস যাবত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা পূর্ববর্তী দিনের আক্রান্তের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন থেকে যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে, তা মেনে চলার বিকল্প নেই। বস্তুত মার্চ মাসের শুরু থেকেই দ্বিতীয় দফায় করোনার ঊর্ধ্বগতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

মানুষ থেকে মানুষের দেহে এ ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়, সে বিষয়ে একদম শুরুর দিকে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না বিশেষজ্ঞরা। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাদুড় থেকেই এ ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। যা পরে শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মত একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সরাসরি বাদুড় থেকেই মানবদেহে না-কি বাদুড় থেকে মিঙ্ক বা প্যাঙ্গোলিন জাতীয় প্রাণি হয়ে মানবদেহে এ করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছে, তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে। প্রথমদিকে কোনো প্রতিরোধী ভ্যাকসিনও ছিল না এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনিকা, ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু ভ্যাকসিন এখন বাজারে আছে। কিন্তু আমাদের মত জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশের সব নাগরিকের জন্য ভ্যাকসিন প্রাপ্তি একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনকি ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও কিছু বিষয় মেনে চলা অনস্বীকার্য। তাই সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তার প্রতিরোধের জন্য সাধারণ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। নতুবা অচিরেই আমরা ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।

সচেতনতাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এজন্য সবাইকে সব সময় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ভালো করে সাবান-পানি অথবা অ্যালকোহল বেসড হ্যান্ডরাব অর্থাৎ ৭০% ইথানল বা আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল বিশিষ্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ড্রপলেট ইনফেকশন অর্থাৎ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। তাই হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ ঘঁষা থেকেও বিরত থাকতে হবে। করোনাভাইরাস কেবলমাত্র নাক, মুখ ও চোখের উন্মুক্ত শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়েই দেহে প্রবেশ করতে পারে। যথাযথ ব্যবস্থা ছাড়া সন্দেহজনক আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকেও বিরত থাকতে হবে। অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকিকাল পার হওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে।

Advertisement

বর্তমানের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ থেকে এড়াতে চাইলে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি-

১. সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মানতে হবে। করোনাভাইরাস কোনো লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই দু’ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যেকোনো ব্যক্তির দেহে তার অজান্তেই বিদ্যমান থাকতে পারে। করোনাভাইরাস বহনকারী ব্যক্তি যদি কোনো কারণে হাঁচি বা কাশি দেন, তাহলে তার আশপাশের বাতাসে ৩-৬ ফুট দূরত্বের মধ্যে করোনাভাইরাসবাহী জলীয় কণা (ড্রপলেট) বাতাসে ভাসতে শুরু করে এবং ওই পরিধির মধ্যে থাকা যেকোনো ব্যক্তির দেহে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি প্রবেশ করতে পারে।

২. অপ্রয়োজনীয় জনসমাবেশ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। অযথাই ভিড়ের সংস্পর্শে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। যেসব জায়গায় মানুষ বেশি জড়ো হয়, সেসব স্থান এড়িয়ে চলা কিংবা বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে খেলাধুলার স্থান, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় স্থানও আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় জুমার নামাজের সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পাশাপাশি বিয়ে, জন্মদিনসহ সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠান এ সময়ে স্বল্প পরিসরে করা দরকার।

৩. গণপরিবহন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। নিতান্তই তা সম্ভব না হলে অর্থাৎ গণপরিবহনে যেতে হলে বা বাইরে জনসমাগমের সংস্পর্শে যাওয়া লাগলে অবশ্যই যথাযথ উপায়ে মাস্ক পরিধান করুন। আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিচর্যাকারীর মুখে এন৯৫ জাতীয় বিশেষ মাস্ক পরতে হবে।

Advertisement

৪. কর্মক্ষেত্রে বা অফিসে একই ডেস্ক এবং কম্পিউটার ব্যবহার করলেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। কারণ হাঁচি-কাশি থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়। আর যেকোনো জায়গায় করোনাভাইরাস কয়েক ঘণ্টা এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। অফিসের ডেস্কে বসার আগে কম্পিউটার, কী-বোর্ড এবং মাউস পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।

৫. বিনা প্রয়োজনে বা কারণ ছাড়া দেশে-বিদেশে যাবেন না। কোন ভ্রমণ-পরিকল্পনা করে থাকলে কিছুদিনের জন্য তা বাতিল করুন।

৬. বিশেষ অনিবার্য কারণে দেশের কোথাও কিংবা বিদেশে ভ্রমণের প্রয়োজন পড়লে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন।

৭. বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর, হ্যান্ডশেকের পর বা হাঁচি-কাশি দেওয়ার পর ভালো করে সাবান দিয়ে অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে ফেলবেন। যেসব বস্তুতে অনেক মানুষের স্পর্শ লাগে, যেমন সিঁড়ির রেলিং, দরজার নব, পানির কল, কম্পিউটারের মাউস, কী-বোর্ড বা মোবাইল ফোন, গাড়ির বা রিকশার হাতল ইত্যাদি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে এসব বস্তু নিয়মিতভাবে কিছু সময় পরপর জীবাণু নিরোধক স্প্রে বা দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

৮. যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলার অভ্যাস ত্যাগ করুন।

৯. হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই রুমাল বা ট্যিসু ব্যবহার করুন। ব্যবহৃত টিস্যু বা রুমাল যেখানে-সেখানে না রেখে যথাযথ জায়গায় ফেলতে হবে।

১০. নাক-মুখ না ঢেকে কারো সামনে মুখের উপর গিয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করলে এ ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

১১. বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা যাদের পূর্ব থেকেই ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি জটিলতা প্রভৃতি সমস্যা বিদ্যমান তাদের প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে। তাদের প্রতি সব সময় খেয়াল রাখতে হবে।

১২. নিজের বা পরিচিত কারো করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা জরুরি ফোনে যোগাযোগ করতে হবে। যেন দ্রুত করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় এবং প্রয়োজনে সঙ্গনিরোধ তথা কোয়ারেন্টাইন পালন করা যায়।

১৩. টাকা উত্তোলনের জন্য যে এটিএম বুথ ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কারণ এটিএম বুথের বাটন অনেকে ব্যবহার করেন। এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আরেকটি জায়গা হতে পারে বাড়ি কিংবা অফিসের লিফট। কারণ লিফট ব্যবহারের সময়ও নির্ধারিত ফ্লোরে যাবার জন্য লিফটের বাটন অনেকে ব্যবহার করছেন এবং বিভিন্ন অফিস ভবনে প্রতিদিন শত-শত মানুষ লিফট ব্যবহার করছেন। তাদের মধ্যে কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থাকেন এবং সে লিফটের বাটনে অন্যদের আঙুলের সংস্পর্শ হলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। তাই যথাসম্ভব পাবলিক লিফট এবং এটিএম বুথ এড়িয়ে চলা শ্রেয়।

১৪. শুভেচ্ছা বিনিময়ে করমর্দন এবং কোলাকুলির মাধ্যমেও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে। কোনো ব্যক্তি অন্য যে ব্যক্তির সাথে কোলাকুলি এবং করমর্দন করছেন, তিনি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে ভাইরাসটি সুস্থ দেহেও সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য করমর্দন এবং কোলাকুলি না করার জন্য বিশেষজ্ঞগণ পরামর্শ দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সব কিছুর মূল কথা হচ্ছে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা। হাত না ধুয়ে নিজের মুখমণ্ডল স্পর্শ করবেন না। এটি হলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য নিয়মিত ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আগেই সবার জন্য সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে।

এসইউ/জিকেএস