ফিচার

করোনা গড়ছে রেকর্ড, আমরা করছি হিসাব

করোনা সংক্রমণে গতবছর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত রাজধানীর বাসাবো থাকি আমি। প্রতিদিনই জীবিকার তাগিদে এখানকার মানুষগুলো ছুটে চলে। এই ছুটে চলা মানুষের ভিড়ে আমিও হারিয়ে যাই। সকালে যখন ঘর থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হই; তখন আমার যাত্রাপথে বেশ কয়েকটি গলিপথ পড়ে। এসব পথের একপাশে কিছু চায়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান দেখা যায় প্রতিদিনই। বিভিন্ন পেশার মানুষের খোশগল্পে প্রাণ পায় দোকানগুলো। তাদের দিকে তাকালে মনে হয়, করোনার উৎসব পালন করছেন তারা।

Advertisement

কৌতূহলবশত একজনের সঙ্গে কথা বললাম। তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা। সেখান থেকে শহরে ছুটে এসেছেন জীবিকার তাগিদে। চায়ের দোকানের পেছনেই রিকশার গ্যারেজ। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে চালান। একাই থাকেন সেই গ্যারেজে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেন?’ তার জবাবে বুঝলাম, স্বাস্থ্যবিধি মানা বিষয়টিই বোঝেন না তিনি।

পরে মুখে মাস্ক নেই কেন জিজ্ঞেস করলাম। এবার তিনি জবাব দিলেন। বললেন, ‘আর মাস্ক দিয়া কী অইব? দ্যাশে কি আর কোরুনা (করোনা) আছেনি? এতদিনই কিছু অয় নাই, আর অইবোও না!’ তার জবাব শুনে দু’একটা পরামর্শ দিলে চলে এলাম। যদিও তিনি সেভাবে আমলে নেননি।

এরপর হাঁটতে থাকলাম। ছোট গলি পাড় হতেই আরেকটি প্রধান গলি। চোখের সামনে অসংখ্য মানুষ ছুটে চলছে। তাদের দিকে তাকিয়েও অবাক হই। দেখা যাচ্ছে, ১০ জনের ৬ জনের মুখে মাস্ক নেই। বাকি যাদের আছে, তাদের মধ্যেও অনেকেরটা মুখে নেই। এভাবেই এলাম বাসাবো-বৌদ্ধমন্দির বিশ্বরোড পর্যন্ত।

Advertisement

সেখান থেকে একটি গণপরিবহনে উঠলাম। বাসের মধ্যে অনেকেই মাস্ক পরেছেন, তবে সবাই না। আমি একটি সিটে বসলাম। আমার পাশে বয়স্ক এক মুরুব্বি বসেছেন। পান খেয়ে পুরো মুখ লাল করে ফেলেছেন। মাস্ক না পরায় তা দেখতে পেরেছি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আঙ্কেল দেশে তো করোনা বাড়ছে, আপনি মাস্ক পরেননি কেন?’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। বললেন, ‘বাবা এখন কি আর মাস্ক পরা লাগে? করোনা আর কিছুই করতে পারব না। সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে।’ আমি কথা বাড়ালাম না।

এদিকে বাসে পর্যাপ্ত যাত্রী রয়েছে। তবুও মুগদা থেকে বেশ কিছু যাত্রী উঠিয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এখানেও স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই দেখলাম না। করোনার মধ্যে সিটের অতিরিক্ত যাত্রী উঠাতে বাস চালকের সহকারীকে নিষেধ করলাম। কিন্তু সে আমলে নিল না। এভাবেই বাস থেকে ধাক্কাধাক্কি করে নিজের কর্মস্থলে পৌঁছলাম।

তিনটি উদাহরণের দেখানো এ চিত্র শুধু আমার দেখা নয়, পুরো ঢাকা শহরের প্রতিদিনের পরিচিত চিত্র এটি। এখন যদিও ৩১ মার্চ থেকে ৫০ শতাংশ যাত্রী তোলা হচ্ছে। ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৬০ শতাংশ। এর আগের দৃশ্যগুলো এমনই ছিল। এখন যদি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে, সেটাই ভরসা।

এদিকে দেশে করোনাভাইরাস ফের ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই একটি রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ছে। শেষ খবর পর্যন্ত (৩১ মার্চ) এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ৭ মাসের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ মৃত্যু। এছাড়াও নতুন করে ৫ হাজার ৩৫৮ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে, যা দেশে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। গত সোমবার করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ১৮ দফা নির্দেশনাও দিয়েছে সরকার।

Advertisement

তাতে কী? করোনার একবছর পরেও আমাদের শহরের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে সচেতন নয়। মাস্ক পরা নিয়েও উদাসীন তারা। জনসমাগম এড়ানোর চেষ্টা করেন না। নিজে সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করেন না, অন্যকেও সতর্ক করেন না। তাই এভাবেই করোনা তার আপন গতিতে রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। আমরা শুধু সংখ্যার হিসাব করছি, ভবিষ্যতেও হয়তো করব।

লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।

এসইউ/জিকেএস