ডা. মাহাবুবা রহমান
Advertisement
আউটডোরে একবার একজন নারী রোগী পেয়েছিলাম, সত্তরোর্ধ্ব বয়স। রোগীকে নিয়ে এসেছিলেন তারই ছেলে, ছেলের বয়স চল্লিশের ঘরে। কী অসুবিধা জিজ্ঞেস করতেই ছেলে জানালেন, রোগীর মাথা ব্যথা। ব্যথায় উনি ঘুমাতে পারেন না, কোনো কাজ করতে পারেন না। এর আগেও চিকিৎসা নিয়েছিলেন, কিছুটা ভালো হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আবার ব্যথাটা বেড়েছে।
আমি এবার রোগীর দিকে তাকালাম। ‘আপনি বলেন দেখি মা, কী কষ্ট আপনার?’ রোগী মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনেও মুখ তুললেন না। মাথা নিচু করেই জবাব দিতে লাগলেন-‘মাথার এই যে এদিকে ব্যথা, সারাক্ষণ ব্যথা করে। কোনোভাবেই শান্তি পাই না।’‘হুম। আর?’‘আর মাথা জ্বলে, সারা শরীর জ্বলে।’
আমি রোগীর কাছে তার আগের চিকিৎসাপত্র চাইলাম। ছেলে জানালেন, চিকিৎসাপত্র হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ওষুধের নাম মনে আছে। একটি এন্টিডিপ্রেসেন্টের নাম বললেন।
Advertisement
এবার আমি রোগীকে ডিপ্রেশনের লাইনে প্রশ্ন করা শুরু করলাম। দেখলাম ডিপ্রেশনের অনেক সিম্পটমই আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কতদিনের সমস্যা? পেশেন্টের ছেলে উত্তর দিলেন-‘ম্যাডাম, আম্মার সমস্যাটা আসলে শুরু হয় ৯৭ সাল থেকে। ৯৭ সালে আমার বড়ভাই মারা যান। তখন থেকেই আম্মার এরকম ঘুম হয় না, মন খারাপ, অস্থিরতা।’
ছেলে কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই রোগী কান্না শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘আমার ছেলেটা, আমার প্রথম সন্তান। তেইশটা বছর পালছি যারে। আমার সেই সন্তান, আমি বেঁচে থাকতে মরে গেল।’‘তেইশ বছর বয়সে মারা গেছেন?’‘জ্বি...’ রোগী তখনো কাঁদছেন।‘কিভাবে?’
প্রশ্ন করতেই রোগীর কান্না যেন আরও বেড়ে গেল। পরে রোগীর ছেলের থেকেই জানলাম, তার বড় ভাই মানে রোগীর বড় ছেলেটি সুইসাইড করে মারা যান। সুইসাইডের কারণ তারা কেউ জানেন না। ছেলেটির কোনো আচার-আচরণে কখনো বুঝতেও পারেননি এমন কিছু ঘটতে পারে। ছেলের এ আকস্মিক মৃত্যু মা মেনে নিতে পারেননি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত উনি ডিপ্রেশনের চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন।
ডিপ্রেশনের ভয়াবহতা: ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগীর হার শতকরা ৬.৭ শতাংশ। একজন মানুষকে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে বিকলাঙ্গ করে দিতে সক্ষম। বিশ্বব্যাপী এরকম সব অসুখের তালিকার মধ্যে ডিপ্রেশনের স্থান চতুর্থ। শুধু মানসিক রোগের তালিকার মধ্যে ডিপ্রেশনের অবস্থান প্রথম।
Advertisement
ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এ ডিপ্রেশন নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কথা যত বেশি; মানুষের ভুল ধারণা তার চেয়েও বেশি। একটু মন খারাপ হলেই আমরা তাকে ডিপ্রেশন নাম দিয়ে বসি। কিন্তু ডিপ্রেশন মানে কি শুধুই মন খারাপ? মন খারাপের সাথে আর কী কী বিষয় থাকলে কিংবা মন খারাপটাই ঠিক কতটুকু মাত্রায় থাকলে আমরা তাকে ডিপ্রেশন বলব? আসুন জানার চেষ্টা করি।
ডিপ্রেশন কী: যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের মন খারাপ করে দেয়। এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মন খারাপের মাত্রা কিংবা স্থায়িত্ব যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন সেটিকে বলে ডিপ্রেশন।
ডিপ্রেশনের ধরন: ডিপ্রেশনের ধরন বা ক্লাসিফিকেশনের তালিকাটা বেশ লম্বা। সবগুলো নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। তাই আমি গুরুত্বপূর্ণ দুটি ক্লাসিফিকেশন সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি। ক্লিনিক্যালি যে ক্লাসিফিকেশনটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, সেটি হলো-1. Endogenous depression2. Reactive/Exogenous depression.
যে ডিপ্রেশনের পেছনে আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ পাওয়া যায় না, তাকে বলে Endogenous বা বায়োলজিকাল ডিপ্রেশন। আর যে ডিপ্রেশনের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা সমস্যা পাওয়া যায়, সেটি হলো Reactive depression.
ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার প্রকারভেদটি সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডিপ্রেশন সম্পর্কিত প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোর একটি হচ্ছে- ডিপ্রেশন হতে হলে তার পেছনে অবশ্যই কোনো না কোন কারণ থাকতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই, এমন কোনো মানুষ যদি ডিপ্রেশনের কথা বলেন, আমরা তার সমস্যাকে হেসেই উড়িয়ে দেই। ফলাফল, এ মানুষগুলো সঠিক চিকিৎসার অভাবে দিনের পর দিন মানসিক কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসিফিকেশন হল- ইউনিপোলার অ্যান্ড বাইপোলার ডিপ্রেশন। ইউনিপোলার ডিপ্রেশন হলো- যেই রোগে রোগীর সারা জীবন যতগুলো এপিসোড আসে; সবগুলোই ডিপ্রেসিভ এপিসোড। অন্যদিকে বাইপোলার ডিপ্রেশন হচ্ছে- বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের দুটি বিপরীতমুখী এপিসোডের (ম্যানিক এবং ডিপ্রেসিভ এপিসোড) মধ্যে অন্যতম এপিসোড।
ডিপ্রেশনের কারণ: ডিপ্রেশনের কারণ হিসেবে এককথায় বলা যায় সেরোটনিনের হ্রাস। কথায় বলে, ‘Serotonin is happiness.’ যদিও সেরোটনিন ছাড়া আরও নিউরোট্রান্সমিটারের (যেমন- ডোপামিন, নরইপিনেফ্রিন, গাবা ইত্যাদি) তারতম্য ঘটে থাকে। তবুও সবচেয়ে বেশি প্রভাব হচ্ছে সেরোটনিনের।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেরোটনিন কেন কমে? এর উত্তর বেশ লম্বা। প্রথমত, কারো যদি বংশে ডিপ্রেশনের হিস্ট্রি থাকে (ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভদের মাঝে)। তাদের রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ২০-৩০%। অন্যদিকে কারো কারো ব্যক্তিত্বের ধরন থাকে এমন যেটি ডিপ্রেশনের প্রভাবক। আবার আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ ছাড়াই সেরোটনিন কমতে পারে (এটি সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যেই বলেছি- বায়োলজিকাল ডিপ্রেশন)।
দ্বিতীয়ত, প্রতিকূল পরিবেশ বা ঘটনা ডিপ্রেশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। বিশেষত, জীবনের প্রথমার্ধে ঘটে যাওয়া কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, যেটিকে আমরা বলি Adverse early life experiences। পরবর্তী জীবনে ডিপ্রেশন হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এজন্য দেখা যায়, যেসব বাচ্চা ছোটবেলার কোনো ঘটনায় বড় ধরনের মানসিক আঘাত পেয়ে থাকে (যেমন- বাবা-মায়ের ডিভোর্স, বাবা-মা মারা যাওয়া, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি)। তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই পরবর্তীতে ব্যক্তিত্বের সমস্যা দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে দেখা দেয় বিষণ্নতা।
লিঙ্গভেদেও ডিপ্রেশনের তারতম্য দেখা যায়। সাধারণত ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ডিপ্রেশন হওয়ার হার দ্বিগুণ। এর কারণ হিসেবে অনেকগুলো হাইপোথিসিস আছে। এক, মেয়েরা স্বভাবগতভাবেই তাদের কষ্টের অনুভূতিগুলো মনের মধ্যে চেপে রাখে। যেটা পরবর্তীতে প্রকাশ পায় ডিপ্রেশন আকারে। দুই, বিভিন্ন সমাজে প্রথাগতভাবেই ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার বেশি হয় মেয়েরা। তিন, মেয়েদের হরমোনাল তারতম্য।
এসবের বাইরে ছেলেদের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের হার কম হওয়ার দুটি ইন্টারেস্টিং থিওরি আছে। যার একটি হলো- ছেলেরা সহজে ডিপ্রেশনের কথা স্বীকার করতে চায় না। এর কারণ সম্ভবত সমাজের সেই চিরায়ত রীতি, ‘ছেলেদের কখনো কষ্ট পেতে নেই। কষ্ট পাওয়া, কান্নাকাটি করা সেসব তো মেয়েদের কাজ!’ আরেকটি হলো- ভুল ডায়াগনোসিস। বেশিরভাগ ছেলেই ডিপ্রেশন ভুলতে গিয়ে নেশার জগতে ডুব দেয়। ডাক্তারের কাছে যখন আসে; তখন সে একজন পুরোদস্তুর মাদকাসক্ত। ফলাফল, এসব রোগীরা ডিপ্রেসড হিসেবে ডায়াগনোসড না হয়ে ডায়াগনোসড হয় ‘সাবস্টেন্স এবিউজার’ হিসেবে।
লক্ষণসমূহ: ডিএসএম-৫ অনুযায়ী ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারগুলোর একটি লম্বা ক্লাসিফিকেশন আছে। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কমন ডিজঅর্ডারটি হলো ‘Major Depressive Disorder’ বা সংক্ষেপে এমডিডি। এই এমডিডি’র কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ আছে। লক্ষণগুলো নিম্নরূপ-১. Depressed mood, অর্থাৎ দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকা এবং এই মন খারাপ ঘরে-বাইরে সব জায়গায়, সব পরিস্থিতিতেই বিদ্যমান।২. Diminished Interest বা pleasure, অর্থাৎ কোনো কাজেই আগ্রহ বা আনন্দ না পাওয়া।৩. খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া কিংবা স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়ার পরও ওজনের তারতম্য হওয়া।৪. ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা অথবা অতিরিক্ত ঘুমানো।৫. অতিরিক্ত উত্তেজনা অথবা একেবারে ঝিম ধরে থাকা।৬. শারীরিকভাবে দুর্বল লাগা।৭. নিজেকে ভীষণ রকমের অযোগ্য মনে হওয়া অথবা অযাচিত অপরাধবোধে ভোগা।৮. কাজে-কর্মে মনোযোগ দিতে না পারা অথবা সিদ্ধান্তহীনতা।
অনেক সময় এ মনোযোগহীনতার ব্যাপারটি পেশেন্ট এভাবে নিয়ে আসে যে, ‘ইদানীং সবকিছু ভুলে যাচ্ছি’। আসলে প্রধান সমস্যা এখানে ভুলে যাওয়া নয়, কাজ করার সময় যথাযথ মনোযোগ দিতে না পারার কারণে পরবর্তীতে সেই বিষয়টি ব্যক্তি আর মনে করতে পারেন না।
৯. জীবনকে অর্থহীন মনে হওয়া, মরে যেতে ইচ্ছা করা, অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পরিকল্পনা থাকা কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াও আত্মহত্যার ইচ্ছা অথবা ইতোমধ্যে কোনো সুইসাইড অ্যাটেম্পটের হিস্ট্রি থাকা।
লক্ষণগুলোর মধ্যে যদি অন্তত ৫টি বা তার বেশি লক্ষণ (যাদের মধ্যে একটি অবশ্যই প্রথম দুটির একটি) যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে অন্তত ২ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে থাকে এবং এগুলো তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায়, তবেই তাকে আমরা Major Depressive Disorder বলব।
মনে রাখবেন, ‘দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটা’ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, অনেকেই আছেন যারা লক্ষণগুলো নিয়েও হয়তো নিজেদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারছেন, তাদের আমরা ডিপ্রেশনের আওতায় আনব না।
ব্যতিক্রমী লক্ষণসমূহ: আলোচ্য লক্ষণগুলো ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের কিছু ব্যতিক্রমী লক্ষণ দেখা যায়। বিশেষত, বাচ্চারা বেশিরভাগ সময়ই মন খারাপের চেয়ে ‘খিটখিটে মেজাজ’ নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে কোনো বাবা-মা যদি এমন অভিযোগ করেন যে, তার হাসিখুশি সন্তান হঠাৎ করেই খুব খিটখিটে হয়ে গেছে। তখন অন্যান্য ডায়াগনোসিসের সাথে সাথে ডিপ্রেশনের ব্যাপারটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
আরেকটি ব্যতিক্রমী লক্ষণ হলো ‘মুড রিয়্যাক্টিভিটি’। সাধারণত ডিপ্রেসড মানুষের কোনো কিছুতেই মন ভালো হয় না, আনন্দের সংবাদ শুনলেও আনন্দ লাগে না। তবে যাদের মুড রিয়্যাক্টিভিটি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে মন খারাপ থাকলেও কোনো আনন্দের সংবাদ শুনলে বা আনন্দের ঘটনা হলে তাদের মন কিছু সময়ের জন্য হলেও ভালো লাগে।
এর বাদে ডিপ্রেশনের রোগীরা প্রায়ই বিভিন্ন শারীরিক কম্পলেইন নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে; আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে গ্রামাঞ্চলে এবং পরিবারের নারী সদস্যদের, যেখানে মনের রোগের তেমন কোনো গুরুত্বই নেই, সেখানে ‘আমার মন খারাপ’ কথাটি বলার চেয়ে ‘আমার মাথা ব্যথা, মাথার তালু জ্বলে’ বললে পরিবারের সদস্যদের কাছে ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া যায়।
তবে এর মানে এই নয় যে, রোগী এগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলেন। সত্যিকার অর্থেই ডিপ্রেশনের রোগীদের সোমাটিক সিম্পটমস থাকে। কিন্তু সেই সাথে তাদের মনটাও খারাপ থাকে। একটু ভালোমত হিস্ট্রি নিলেই যেটা বের হয়ে আসে।
ডিপ্রেশন এবং বিরেভমেন্ট: ডিপ্রেশনের কাছাকাছি কিছু বিষয় আছে, যেগুলো অনেক সময় ডিপ্রেশন হিসেবে ভুল ডায়াগনোসিস হয়। তেমন একটি বিষয় হচ্ছে বিরেভমেন্ট (Bereavement)। বিরেভমেন্ট অর্থ খুব কাছের কোনো মানুষের আকস্মিক মৃত্যু পরবর্তী শোক। প্রিয় মানুষের মৃত্যু কারোরই কাম্য নয়। আর সেই মৃত্যু যদি হয় অনাকাঙ্ক্ষিত, তাহলে শোকের পাল্লা আরও ভারি হয়ে যায়।
এধরনের শোকে অনেক সময় মানুষের কিছু মানসিক লক্ষণ এবং আচরণ দেখা দেয়, যেগুলো এরকম পরিস্থিতি বিবেচনায় খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে এটিকে ডিপ্রেশন বলে মনে হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, বিরেভমেন্ট থেকে কী কখনো ডিপ্রেশন হতে পারে? এর উত্তর হচ্ছে- ‘হ্যাঁ’। বিরেভমেন্ট একটি স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেটি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এ নির্দিষ্ট সময়কাল হচ্ছে ছয় মাস। কিন্তু কারো যদি ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বিরেভমেন্টের সিম্পটমগুলো থেকে যায়, তখন সেটিকে আমরা কমপ্লেক্স বিরেভমেন্ট (complex bereavement) বলি। কমপ্লেক্স বিরেভমেন্ট একটি পর্যায়ে গিয়ে ডিপ্রেশনের আকার ধারন করতে পারে।
আমি শুরুতে যে রোগীর কথা লিখেছি, তার ক্ষেত্রে ঠিক এটিই হয়েছিল। ছেলের অস্বাভাবিক মৃত্যু ছিল তার জন্য বিরেভমেন্ট। এই বিরেভমেন্ট থাকতে থাকতে একসময় কমপ্লেক্স বিরেভমেন্টের আকার ধারন করে এবং তারই দীর্ঘমেয়াদী পরিনাম আজকের এই ডিপ্রেশন।
ডিপ্রেশনের চিকিৎসা: ডিপ্রেশনের চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে ডিপ্রেশনের মাত্রা এবং ধরন অনুযায়ী। সেই হিসেবে ওষুধ এবং সাইকোথেরাপি দুটোরই ভূমিকা আছে। যেমন মাইল্ড ডিপ্রেশনে ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, কিছু সাইকোথেরাপি যথেষ্ট। আবার মডারেট বা সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ওষুধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাইকোথেরাপিরও প্রয়োজন হয়।
যদিও অনেকের মনেই সন্দেহ থাকে, ওষুধ কিভাবে ডিপ্রেশন দূর করতে পারে? অথচ ডিপ্রেশনের কার্যকারণের মধ্যে সেরোটনিনের যে ভূমিকা আছে, সেটা সম্পর্কে ধারণা থাকলে এন্টিডিপ্রেসেন্ট নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
ডিপ্রেশনের ভবিষ্যৎ: ডিপ্রেশন বা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার একটি এপিসোডিক রোগ। তাই এপিসোড আকারে রোগটি বারবার ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। বলা হয়ে থাকে, একবার এ অসুখ হলে পরবর্তীতে অসুখ ফিরে আসার সম্ভাবনা শতকরা আশি ভাগ। তবে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে, বংশে এ রোগের ইতিহাস থেকে না থাকলে এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন ও ডাক্তারের ফলোআপে থাকলে রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
দুঃখের বিষয়, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেকেই ডিপ্রেশনকে ভান বা ন্যাকামি বলে থাকেন। অনেকে ডিপ্রেসড পেশেন্টকে উদ্দেশ্য করে এটাও বলেন, ‘তোমার তো সব আছে, তাও কিসের ডিপ্রেশন!’ আশা করি আজকের পর থেকে তারা অন্তত এটা বুঝবেন, ডিপ্রেশন হওয়ার জন্য বস্তুগত জিনিসের অভাব থাকতে হয় না, এক সেরোটনিনের অভাবই যথেষ্ট!
কাজেই আপনার আশেপাশের ডিপ্রেসড মানুষটিকে অবহেলা না করে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হন। সম্ভব হলে তাকে সঠিক চিকিৎসার আওতায় আনুন। জীবন তো একটাই। একজীবনে একজন মানুষ আনন্দ নিয়ে বাঁচবেন না, তা কি হয়?
লেখক: রেসিডেন্ট চিকিৎসক, ডিপার্টমেন্ট অব চাইল্ড অ্যান্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসইউ/জেআইএম