ফিচার

প্রতিবন্ধী ও তাদের বাবা-মার সুরক্ষায় ভ্যাকসিন জরুরি

ডা. সেলিনা সুলতানা

Advertisement

সবার জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা জরুরি। ‘নিজেকে সুরক্ষিত করব এবং অন্যকেও সুরক্ষিত রাখব’- স্লোগানটি হোক সবার জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলা ইনস্টিটিউট অব ইমিউনোলজির মতে, করোনার সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর অন্তত প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মানবদেহে থেকে যায়। ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগের গবেষণায়ও একই ধরনের ফলাফল দেখা গেছে। তারা বলছেন, কোভিড থেকে সেরে ওঠা বেশিরভাগ রোগী অন্তত পাঁচ মাস আবার সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবেন। তবে প্রথম সংক্রমণের ঘটনা যেহেতু পাঁচ মাসের খুব বেশি আগে ঘটেনি। তাই কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন, ইমিউনিটি থেকে যাবে বহুদিন। সম্ভবত কয়েক বছর। তাই ভ্যাকসিন জরুরি।

কোনো রোগের কারণ হতে পারে এমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য জীবাণুর সংক্রামক এজেন্টকে অনুকরণ করেই সাধারণত ভ্যাকসিনগুলো তৈরি করা হয়। আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে শেখায় এটি। সাধারণত সংক্রামক এজেন্টের দুর্বল ধরন জানার মাধ্যমে ভ্যাকসিনগুলো তৈরি করা হয়। যা আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এটির একটি স্মৃতি তৈরি করতে দেয়। ভাইরাসটি এভাবে আমাদের অসুস্থ করার আগেই রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা একে দ্রুত সনাক্ত করতে এবং ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এভাবেই বর্তমানে কোভিড-১৯ এর জন্য ভ্যাকসিনের পরিকল্পনা করা হয়।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভ্যাকসিন বা টিকাটি অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কার করা। যা ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি করা। এটি ২ ডিগ্রি থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় কমপক্ষে ৬ মাস। ফলে ফাইজার, বায়োএনটেকের টিকার চেয়ে এটি সহজে বিতরণযোগ্য। টিকাটি ১৮ বছরের নিচে দেওয়ার জন্য নিষেধ করা হয়েছে পরবর্তী নির্দেশনা আসার আগ পর্যন্ত। (সংগৃহীত)

Advertisement

ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি কুর্মিটোলা হাসপাতালে একজন নার্সকে প্রথম টিকা দিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা উদ্বোধন করা হয়েছে। এরপর বাংলাদেশের সব জেলা উপজেলার ১০০৫টি কেন্দ্র থেকে এ টিকা কর্মসূচি একযোগে শুরু করা হয়েছে। এজন্য কাজ করেছে প্রথমে ২৪০০টি টিম।

করোনা ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশন করতে সুরক্ষা অ্যাপ আছে। সুরক্ষা অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট থেকে করোনা ভ্যাকসিন নিবন্ধন করতে প্রয়োজন- জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা, শারীরিক পরিস্থিতি, ফোন নম্বর ইত্যাদি তথ্য। সুরক্ষা অ্যাপ পাওয়া যাচ্ছে অ্যাপ স্টোরে। www.surokkha.gov.bd এ ওয়েব পোর্টালে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধন সম্পন্ন হলে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের তারিখ ও কেন্দ্র জানিয়ে দেওয়া হয়। অথবা ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে কেন্দ্রে গেলে নিবন্ধন করা যাবে। নিবন্ধনের ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার পর তাকে একটি কার্ডে পরবর্তী ডোজের সময় ও তারিখ লিখে দেওয়া হয়। প্রথমটি নেওয়ার চার থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এ টিকা কার্যক্রম চলছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানানো হয়।

যে জনগোষ্ঠীর ভ্যাকসিনের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে আছেন- মুক্তিযোদ্ধা, করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, সম্মুখসারীর কর্মী, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠী, দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী, শিক্ষাকর্মী, সংবাদকর্মী, গণপরিবহনকর্মী ও ব্যাংকে কর্মরত। বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে ষাটোর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের বোঝানো হচ্ছে।

সংক্রমণ ছড়ানোকে বাধাগ্রস্ত করতে হলে ৬৫% থেকে ৭০% মানুষের টিকা নিতে হবে- এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত। তার মানে হচ্ছে, এখানে মানুষকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অনেকে অবশ্য যে দ্রুততার সাথে কোভিডের টিকা উদ্ভাবন করা হয়েছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এটা সত্য যে, বিজ্ঞানীরা একটি টিকার নকশা ও ট্রায়াল করতে কয়েক বছর পার করে দেন। তবে একটি সমাধান খুঁজে পাওয়ার পক্ষে বৈশ্বিক স্বার্থ কাজ করার কারণে করোনা টিকার উৎপাদন দ্রুততর হয়েছে। আর কাজটি করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিজ্ঞানী, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় করেছে।

Advertisement

আমাদের দেশে টিকা নেওয়ার জন্য মোটিভেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে বয়স। এখানে টিকা নেওয়ার বয়স ৪০ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। তাতে টিকা নিবন্ধন বেড়েছে, আগ্রহী বেড়েছে। সবার ধারণা, কার্যকর পরীক্ষা এবং বিদ্যমান প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এখনো বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতিশীল ভ্যাকসিন অনুমোদনের জন্য পর্যালোচনাধীন রয়েছে। ফাইজার, বায়োএনটেক, মডার্না এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনগুলো বেশ কয়েকটি কঠোর জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্বারা ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হওয়ায় নিরাপদ এবং কার্যকর ভ্যাকসিনের প্রতিযোগিতাটি এখন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট রোগটি শিশুদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তাৎক্ষণিক শারীরিক প্রভাবের চেয়েও রোগটির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আরও ব্যাপক। যদি লকডাউনের বিধি-নিষেধ অব্যাহত থাকে বা এগুলোকে পুনরায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে শিশুদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। বিশেষ করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের। রুটিন স্বাস্থ্যসেবা কাভারেজের ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া এবং তা থেকে সৃষ্ট মন্দাভাব একটি প্রজন্মের শিশুদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে করোনা মহামারী।

কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য ভ্যাকসিন সম্পর্কে অভিভাবকদের মনের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে। কারণ তারা নিজেদের থেকে সন্তানের জন্য বেশি চিন্তিত থাকেন। শিশু এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তাকে ইউনিসেফ সব সময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। নিরাপদ একটি ভ্যাকসিন সরবরাহ করাও এর অন্তর্ভুক্ত।

কোভাক্স পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন দেশে পাঠানো ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ডোজগুলো স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজসেবা কর্মী এবং ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে এমন উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ভ্যাকসিন শিশুদের দেওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সাধারণ শিশু ও বিশেষ শিশুদের বাবা-মার জন্য অবশ্যই ভ্যাকসিন জরুরি। এক্ষেত্রে বয়সটা একটু বিবেচনায় আনা সম্ভব রেজিস্ট্রেশনের জন্য।

সমাজসেবা অধিদফতরের করোনা সংক্রান্ত জাতীয় নির্দেশনাসমূহের মধ্যে ১২ এবং ১৩ ছিল:- কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিবেচ্য।- করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতাভুক্তকরণ। তার মানে বোঝা যায় যে, বর্তমান সরকারের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রাধান্য রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন দেশের অনগ্রসর, বঞ্চিত, অসহায়, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক এবং জন্মগতভাবে কিংবা অন্য যেকোনো কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ, উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও ক্ষমতায়নের জন্য বহুমাত্রিক সেবা প্রদান করে আসছে।

কোভিড-১৯ মহামারীতে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে প্রতিবন্ধী শিশু ও বয়স্করা। তাদের মধ্যে অনেকেরই সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয়। হতে পারে তা পরিবারের কেউ বা থেরাপিস্ট। তাই প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুঁকি একটু থেকেই যায়। ৪০ বছর বয়স হলেই করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করা যাবে। সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্দেশনা দেন। যদিও এ ৪০ বছর বয়সের মধ্যেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ও প্রতিবন্ধী শিশুর বাবা-মারা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন, ভ্যাকসিন ব্যবস্থায় চলে আসবেন- এটাই আশা করা যায়।

সিডিসি বলছে, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা দেয় এ টিকা। সেই সাথে অন্যকে সুরক্ষিত রাখতেও সহায়তা করে। এ টিকা মহামারী থেকে উত্তরণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সবাই। বিশেষ শিশুর বাবা-মা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে বা তাদের সুরক্ষিত করে ভ্যাকসিন কার্যক্রম সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ হবে। এটিও ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান কর্মসূচির একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখক: কনসালটেন্ট, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক স্পেশালিস্ট ইন নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম, বেটার লাইফ হসপিটাল।

এসইউ/এমএস