রাস্তার দুই পাশে ঘন সবুজ গাছ। বড় গাছ, ছোট গাছ। রাস্তার মাঝের লেনেও সবুজের নেতৃত্ব দিচ্ছে নানা রকম বনসাই আর লতানো গাছ। সুন্দর-ঝকঝকে রাজপথ। রাস্তার পাশে বিশাল সব অট্টালিকাগুলোকেও নিচ থেকে দেখে মনে হয় এক টকুরো সবুজের ছাতা। সেগুলোর বারান্দা জুড়ে আছে নানা প্রজাতির লতানো গাছ। ছাদে মিষ্টি হাওয়ারা দোল খায় আম-জাম-গোলাপ-শিউলির পাতায় পাতায়। মিষ্টি হাওয়ায় প্রাণ দোলে যায় সতেজ আর সজীব স্পর্শে। ফুল-পাখির কুজনে নাচে মন। পরিস্কার যানবাহনের ভিড়ে প্রসন্ন মন নিয়ে রাজধানী ঢাকাবাসীর আনাগোনা।না পাঠক, অবাক হাবার কিছু নেই। ক্রমশই বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠা প্রিয় শহর ঢাকাকে নিয়ে এমনই এক অসাধারণ স্বপ্ন দেখেন কিছু মানুষ। তাদেরই একজনের গল্প নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি। তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশে আলোচিত ‘নন্দিনী’ নামের চমৎকার এক প্রজাতির ফুলের উদ্ভাবক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। দীর্ঘ এক দশক ধরেই এই মানুষটি স্বপ্ন দেখছেন, পরিকল্পনা করছেন, সম্প্রতি নানা কর্মসূচিও হাতে নিয়েছেন ‘সবুজ ঢাকা’র জন্য। সেসব ভাবনা ও ভবিষ্যতের গল্পে নিভৃতচারী এই শিক্ষকের সাথে একান্ত আলাপে ছিলেন লিমন আহমেদজাগো নিউজ : প্রথমেই বলুন সবুজ ঢাকার চিন্তাটা মাথায় এলো কীভাবে?জামাল উদ্দিন : আমি জাপানে পড়াশোনা করেছি এবং সেখানেই চাকরি করতাম। সেখানেই সংসার পেতেছিলাম। পরে ২০০৪ সালের দিকে আমি নিজ দেশে চলে আসি। তখন আমার সঙ্গে ছিলো স্ত্রী ও ছোট ছোট দুইটি মেয়ে। আমি আর আমার স্ত্রী এদেশের মানুষ। তাই রাজধানী ঢাকা নিয়ে আমাদের ধারণা ছিলো স্পষ্ট। কিন্তু আমার মেয়েরা প্রথমবারের মতো ঢাকায় এলো। তারা যখন বিমান থেকে নেমে রাজপথে এলো খুব আহত হলো। চারদিকে গাড়ির যানজট, গিজগিজ করছে মানুষ, যত্রতত্র হর্ন বাজছে। এক ফোটা সবুজ নেই কোথাও। বড় মেয়ে হঠাৎ বললো, ‘বাবা সবাই এভাবে হর্ন দিচ্ছে কেন? এরা কী পাগল? যখন বিশ্বরোড পেরিয়ে খিলক্ষেতে এলাম চারপাশে খোলা ডাস্টবিন আর ময়লা দেখে সে বলে উঠলো, ‘বাবা, তোমার দেশ এত নোংরা কেন?’আমার মেয়ে এমনভাবে কথাটা বললো আমার খুব কষ্ট হলো। আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসছিলো। আমার বাবার দেশ, মায়ের গন্ধ মাখা অপূর্ব এই দেশটাকে আমার মেয়ে এই ঢাকার জন্য নোংরা বললো! ও তো জানেনা, এই ঢাকার বাইরে আমার সোনার দেশটা কতো সুন্দর। ও না জেনেই জাপানের সাথে আমার দেশটাকে তুলনা করতে চেয়েছে। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমার মেয়ে বুঝতে পারলো যে আমি তার কথাবার্তায় কষ্ট পেয়েছি। সে তখন আমার দুটি হাত ধরে বললো, ‘বাবা মন খারাপ করছ কেন? আমরা সবাই মিলে কী এই দেশটাকেও জাপানের মতো সুন্দর করতে পারি না?।’আমার মেয়ের সেই কথাটা আজীবনের মতো মনে গেঁথে গেল। বাসায় ফিরে ভাবলাম সত্যি কিছু করা দরকার। এভাবে চললে ঢাকায় বাস করা যাবে না। আমার মেয়ের জন্য, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঢাকায় সবুজায়ন, শৃঙ্খলা, শান্তি, পরিচ্ছন্নতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। তখন থেকেই আমি যেখানে যাই বিশেষ করে স্কুল-কলেজে গেলে সবাইকে বলি ‘ক্লিন ঢাকা-গ্রীন ঢাকা’র কথা। শিখিয়েছি নিজের কাজ নিজে করো, ময়লা পরিস্কার করার নিয়ম ও গুরুত্ব। জাগো নিউজ : এটি আনুষ্ঠানিক রুপ পেলো কী করে?জামাল উদ্দিন : সবুজ ঢাকা আসলে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠণ নয়। এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। আমি শুরু থেকেই ভেবেছি হুট করে এত সমস্যার রাজধানীকে আমি বদলে দিতে পারব না। এর জন্য প্রয়োজন জনমত, সচেতনতা, দায়িত্ববোধ। সেটি আগে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাই আমি এই দশ বছর ধরে সবুজ ঢাকার প্রচারের চেষ্টা চালিয়েছি নিজের মতো করে। তবে সবুজ ঢাকার আজকের যে প্রসার ও জনপ্রিয়তা সেটি এসেছে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র আনিসুল হক সাহেবের হাত ধরে। তিনি সবুজ ঢাকার যে প্রচেষ্টা সেটিকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেছেন। নিজের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকায় সবুজায়ন ও পরিচ্ছন্নতার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। মেয়র হবার পর তিনি সেই কথা্ রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু মেয়রের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে তরুণদের।জাগো নিউজ : আপনার কী মনে হয় আজকের এই সময়ে এসে ঢাকাকে বদলানো সম্ভব?জামাল উদ্দিন : কষ্ট হবে। কিন্তু সম্ভব। আমি জাপানে দেখেছি তারা তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে আজকের জাপানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে তরুণদের আমরা ভালো কাজগুলোতে সম্পৃক্ত করতে পারছি না। অথচ আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের এবং বিভিন্ন এলাকার তরুণদের ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বিশ্বের যে কোনো তরুণদের চাইতে তারা অনেক বেশি সহনশীল, উদ্ভাবনীগুণ সম্পন্ন, কর্মঠ এবং মেধাবী। কিন্তু এদের নিয়ে উন্নয়নের চূড়ায় উঠার কোনো সুন্দর পরিকল্পনা আমাদের নেই। আর সবুজ ঢাকা বলুন কিংবা পরিবর্তনের যে ঢাকার কথাই বলুন তরুণদের না নিয়ে সেটি কখনোই সম্ভব হবে না। আমি আগামীর প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্যই সবুজ ঢাকা নিয়ে ভাবছি। যেহেতু বিষয়টা অনেক বেশি ভবিষ্যতমুখী তাই এর সাথে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব বা প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত হতেই হবে।জাগো নিউজ : তরুণদের জন্য এক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?জামাল উদ্দিন : প্রথমেই তাদের বুঝাতে হবে তোমার অনেক কিছু করার ক্ষমতা আছে, তুমি অনেক কিছু করতে পারো এবং তোমাকে অনেক কিছুই করা উচিত। বিশেষ করে সমাজ ও মানুষের জন্য ইতিবাচক কাজে তোমার নেতৃত্ব, শ্রম ও মেধার অবদান থাকা উচিত। তাদের যোগ্য হয়ে গড়ে ওঠতে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রচেষ্টা চাই। একটা গল্প বলি জাপান কিভাবে তরুণ প্রজন্মকে দিয়ে সাফল্য পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন জাপান পরাজিত হলো তখন তারা খুঁজে বের করলো তাদের হারের কারণ বেশি বেশি লবন খাওয়া। লবন মষ্তিষ্কে নেতিবাচত প্রভাব ফেলে। যার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না, মেধার সঠিক বিকাশ ঘটে না। জাপানিরা এবার ঠিক করলো লবন খাওয়া কমিয়ে দিবে।রাষ্ট্র থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা দেয়া হলো। প্রত্যেক বাবা-মা-ই সন্তানদের লবন কম খাওয়াতে শুরু করলেন। জাপানিদের ধারণা, দীর্ঘ ৪৫ বছর লবন কম খাওয়ার পর তাদের একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা অনেক বেশি পরিশ্রমী, মেধাবী, উদ্ভাবক, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাদের দেশে ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে এমন একটি যুগান্তকারী কৌশলের উদাহরণ দেখাতে পারবেন? নেই। জাপানসহ বিশ্বের অন্য দেশগুলো তাদের নতুন প্রজন্মকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আর আমরা সারাদিন বাচ্চাদের সামনে ফোনে মিথ্যে কথা বলি, সারাদিন ভিনদেশের চ্যানেলে অখাদ্য-কুখাদ্য দেখি; যেখানে পরকীয়া, খুন, হত্যা, সেক্স, মিথ্যা, প্রতারণা দেখানো হচ্ছে। এসব দেখে ও শুনে তারাও এসবে অভ্যস্ত হয়, এগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করে। তারা ধরে নেয় যেহেতু সবাই মিথ্যে কথা বলছে আমারো বলতে দোষ হবে না। এখানে আরো একটি বাজে অভিজ্ঞতার কথা বলি। আগে আমরা দেখতাম কাজী অফিসের বিজ্ঞাপন বা প্রচারে বলা হতো ‘এখানে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়’। আর এখন বলা হচ্ছে ‘এখানে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করা হয়’। বুঝতে পারছ দুর্দশাটা! এই বিষয়টি প্রমাণ করছে বিয়ের মতোই স্বাভাবিক বিষয় তালাক। হচ্ছেও তাই। এসব দেখে দেখে আমাদের ছেলেমেয়েরাও শিখছে। এভাবেই নষ্ট হচ্ছে সম্পর্ক, বিশ্বাস, সামাজিকতা আর সম্ভাবনা। কিন্তু আমি মনে করি এদেশের মানুষের চাইতে ভালো মানুষ আর কোথাও নেই। আমরা ভালো কাজের প্রতি অনেক আগ্রহী। কিন্তু ভালো কাজটির উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না। কেউ শুরু করে দিলে দেখবে অংশগ্রহণ কেবল বাড়ছেই। তাই আমি একটি উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেছি। এর শেষ করবে আমার মেয়ে ও তার সময়ের মানুষেরা। জাপান যদি ৪৫ বছর অপেক্ষা করতে পারে তবে আমরাও পারবো। আমাদের পারতেই হবে আসলে টিকে থাকার স্বার্থে। এই ঢাকা সবুজ না হলে, পরিচ্ছন্ন না হলে আমরা স্রেফ ভুগে ভুগে মারা যাব।জাগো নিউজ : মারা যাবার কথা বললেন কেন?জামাল উদ্দিন : বর্তমানে যে ঢাকায় আমরা বাস করছি এখানে বাতাস বিশুদ্ধ নয়, পানি বিশুদ্ধ নয়, জীবন যাত্রা বিশুদ্ধ নয়। বাতাসে সীসা আর কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা অনেক বেশি। এইসব কারণেই শহরবাসীর ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিক, হার্টের অসুখসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। এসব রোগ আগে হতো উচ্চবিত্ত মানুষের। যারা সাধারণত পরিশ্রম একটু কম করতে। কিংবা যারা নেশাগ্রস্ত ছিলেন তাদের হাঁপানি ও ক্যান্সার হতো। কিন্তু এখন একজন পরিশ্রমী মানুষেরও হবার কথা নয় এমন রোগ হচ্ছে। এটি হচ্ছে শুধুমাত্র পরিবেশের নেতিবাচকতায়। এভাবেই একদিন অযোগ্য হবে ঢাকা। তাই সবুজায়নের বিকল্প নেই। শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণে গাছ থাকলে কিছুটা নোংরা আবর্জনা থাকলেও ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া যায়। তাই ক্লিন ঢাকার আগে গ্রিন ঢাকাকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আর সবুজায়ন করতে গেলে আপনা থেকেই শহরটা পরিস্কার হয়ে যাবে।জাগো নিউজ : বর্তমানে গ্রিন ঢাকা নিয়ে আপনার সাথে আর কারা কাজ করছেন?জামাল উদ্দিন : প্রথমেই তো মেয়র আনিসুল হক সাহেবের কথা বলতে হয়। উনি মানসিক, লোকবল, অর্থনৈতিক সমর্থনসহ নানাভাবে সাহায্য করছেন। চেষ্টা করছেন এই সামাজিক আন্দোলনটাকে বেগবান করতে। পাশাপাশি আমার নিজের কর্মস্থল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থিরা ও তাদের পরিবেশ বিষয়ক নানা সংগঠন, এক ঝাঁক তরুণদের দ্বারা পরিচালিত পরিবেশ বান্ধব সংগঠন প্রকৃতিবাংলা এবং নানা প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট সংগঠন এর ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি কিছু এনজিও আছে যারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রিন ঢাকার পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহায্য করছেন নানাভাবে।জাগো নিউজ : গ্রিন ঢাকার বাস্তবায়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে?জামাল উদ্দিন : আমাদের অনেক কাজ। আমরা প্রথমেই নজর দিচ্ছি ঢাকার রাস্তার দিকে। রাস্তার দুই পাশে ও মাঝের লেনে গান লাগানোর পরিকল্পনা করছি। খালি স্থানগুলোকে পরিস্কার করে বাগান করার পরিকল্পনা আছে। বৃক্ষ রোপনে ঢাকাবাসীকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করা, গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা ও পরিবেশ দুষণ মুক্ত রাখা, পরিবারের জন্য তাজা শাক-সবজি, ফল ও ফুলের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি, অবকাঠামো তৈরিতে যে পরিমাণ জমি নষ্ট হয় ছাদে বাগানের মাধ্যমে তার কিছু অংশ পুষিয়ে নেওয়া, অবসর সময় কাটানোর জন্য ছাদে সবুজ সৌন্দর্য বর্ধন ও বিনোদনের সুবিধা সৃষ্টি, অতিবৃষ্টির পানি ছাদের ড্রামে/টবে শোষন করে জলাবদ্ধতা হ্রাসে ভূমিকা রাখা, ছাদ ও বাড়ির তাপমাত্রা হ্রাসে সহায়তা করা, ছাদে বাগান কার্যক্রমে মহিলা ও ছেলে মেয়েদের সম্পৃক্ত করা। তবে বাড়ির ভেতরে সবুজায়নের জন্য আমাদের সবচাইতে বেশি প্রয়োজন মহীলাদের সাহায্য ও সমর্থন। মেয়রের অর্থায়ন ও সহযোগীতায় আমরা বাড়ির মহীলাদের গাছ লাগানো ও এর যত্নআত্তি-পরিচর্যার জন্য প্রশিক্ষণ দেব। তাদের নামে মাত্র মূল্যে গাছ বিতরণ করবো। তাদের টব, সার-গোবরসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়াদি আমরা সাপ্লাই করবো। আমাদের ভ্রাম্যমাণ গাড়ি থাকবে, লোকবল থাকবে গাছের পরিচর্যার জন্য গাছ মালিকদের নানাভাবে সাহায্য করবে। একটি অনলাইন কলসেন্টার সেবার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে নাম নিবন্ধন করে আমাদের গ্রাহক হওয়া যাবে। যারা গ্রাহক হবেন তারা ২৪ ঘণ্টাই গাছের সমস্যার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। আমরা তাদের সমস্যার সমাধাণের চেষ্টা করবো। গ্রাহকরা এখানে বিনামূল্যে সেবা পাবেন। জাগো নিউজ : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলবো। আপনার নিজের উদ্ভাবন করা ‘নন্দিনী’ নামের ফুল সম্পর্কে জানতে চাই……জামাল উদ্দিন : এই ফুলটিকে হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে গোলাপ। আবার খাড়া পাতাসহ ডগা দূর থেকে অনেকটা টিউলিপের মতো দেখায়। রঙেরও ছড়াছড়ি। প্রায় ৪৫টি রঙের এ ফুলটি গাছ থেকে তোলার পর ১৫ দিন পর্যন্ত সতেজ থাকে। জাপানি এই ফুলটি নিজ দেশে তরুকোগিকিও নামে পরিচিত। নন্দিনী একটি উন্নতমানের কাট-ফ্লাওয়ার। গাছ থেকে যেসব ফুল তুলে ঘর কিংবা মঞ্চ সাজানোর কাজে বেশি দিন ব্যবহার করা যায় তাকেই কাট-ফ্লাওয়ার বলা হয়। বর্ণবৈচিত্র্যের কারণে ফুলটি অল্প সময়ের মধ্যে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুলের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রকি পর্বত এলাকায় ইউস্টোমার উৎপত্তি। মেক্সিকো, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশের উষ্ণ অঞ্চলেও এই ফুল হয়। বাংলাদেশেও এই ফুলের চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে ১৭ বছর ধরে গবেষণা করেছি। এ বিষয়ে আমার গবেষণার নিবন্ধটি বাংলাদেশ কৃষি ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞান সাময়িকী দি এগ্রিকালচারিস্টস-এ প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই ফুলটি নিয়ে প্রশংসা করেছেন। বাণিজ্যিকভাবে ফুলটি দেশে উৎপাদন শুরু হলে প্রতিটির দাম পড়বে ১০ টাকার মতো। বর্তমানে যার দাম প্রায় প্রতি পিস ১০০-১৫০ টাকা।জাগো নিউজ : এই ফুলের নাম নন্দিনী কেন?জামাল উদ্দিন : আমি জাপানে যখন পিএইচডি করতে যাই তখন আমার শিক্ষক এই ফুলটি নিয়ে আমাকে কাজ করতে দেন। আমি যখন গবেষণার মাধ্যমে ফুলটিকে ফুটাতে সমর্থ হই তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘তোমার নামের সাথে মিলিয়ে ফুলের নাম রাখ জামাল ফুল’। শুনে আমি হাসলাম। বললাম যে এমন চমৎকার একটি ফুলের পুরুষ নাম হলে এটি বাংলাদেশে কখনোই জনপ্রিয়তা পাবে না। তাছাড়া পুরুষদের নামের সাথে ফুলের নাম খাপছাড়া লাগে। পরে নিজে ভেবেচিন্তে নন্দিনী নামকরণ করলাম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Eustoma grandiflorum। জাপান থেকে বীজ ও মাটি নিয়ে আসার পর সেই মাটিতে ২০০৭ সালে প্রথম ফুটেছিল ফুলটি। এখণ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮ প্রজাতির নন্দিনী ফুটেছে। জাগো নিউজ : জাপান এবং বাংলাদেশে ফোটা নন্দিনীর মধ্যে পার্থক্য আছে কী?জামাল উদ্দিন : পার্থক্য কেবল বীজের অঙ্কুরোদ্গমে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এ ফুলের সবচেয়ে ভালো মানের বীজ তৈরি হচ্ছে, যার অঙ্কুরোদ্গম হার ৮০ ভাগের বেশি। আর কোনো দেশে এত ভালো মানের বীজ উৎপাদন করা এখনো সম্ভব হয়নি। ঝড়, বৃষ্টি, প্রচণ্ড গরম বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এটি অক্ষত থাকে। প্রতিটি ফুল শক্ত ডাঁটা বা বৃন্তের ওপর থাকে বলে কখনো বেঁকে যায় না বা নুয়ে পড়ে না। একটানা ১৫ দিন পর্যন্ত ফুলটি অবিকল থাকে। এজনই এ ফুলের দাম বেশি। ফুলদানির পানিতে সুক্রোজ মিশিয়ে ২৫ দিন পর্যন্ত তাজা রাখা যায়। একটি গাছে একাধিক ফুল ফোটে। কলিগুলো ধারাবাহিকভাবে ফোটে বলে গাছটি ফুলশূন্য হয় না। একেকটি গাছ একাধিক মৌসুমে ফুল দিতে পারে। প্রতি মৌসুমে একটি গাছ থেকে অন্তত ১২০টি ফুল পাওয়া যেতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফুলের সঙ্গে চলে আসা কলিগুলো ঘরের স্বাভাবিক পরিবেশে ফুলদানিতেই কয়েক দিন পর সম্পূর্ণ ফোটে। জাগো নিউজ : এর চাষ পদ্ধতি কীভাবে?জামাল উদ্দিন : সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ফুলটি ফুটলেও সারা বছরই উৎপাদন সম্ভব। বেলে ও দোআঁশ মাটিতে নন্দিনীর বীজ ভালো হয়। অঙ্কুরোদ্গমের ১০-১২ দিন সময় লাগে। বীজ থেকে চারা উৎপাদনের জন্য তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হয়। এ দেশের আবহাওয়ায় তিন মাস পর্যন্ত লেগে যায়। লবণ-সহনশীল ফুলটি বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে চাষ করার সুযোগ রয়েছে। জাগো নিউজ : বাংলাদেশে এই ফুলের সম্ভাবনা নিয়ে বলুন…জামাল উদ্দিন : ফুল ও উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা নন্দিনীর সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছেন। তাদের মতে, গোলাপের বিকল্প হিসেবে ফুলটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ফুলের ব্যবসা বাংলাদেশ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি, অনেকাংশেই বিদেশি ফুল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। নন্দিনীর বাণিজ্যিক উৎপাদনে সাফল্য এলে ফুলের পাশাপাশি বীজ ও চারা রপ্তানি করেও বিদেশের বাজার ধরার সুযোগ রয়েছে।এলএ
Advertisement