মতামত

ভ্যাটে কাহিল জনতা, মহার্ঘে ধন্য সরকারিরা

সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে এবং তা খুবই যৌক্তিক বলে জানানো হয়েছে আবার। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, আশপাশের দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীরা খুবই কম বেতন পান। অমানবিক বেতন দেয়া হয় তাদের। শতাধিক পণ্যে বাড়ানো ভ্যাট কমিয়ে জনগণকে একটু স্বস্তি দেয়ার আশ্বাসটির প্রতিফলন নেই। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের বোঝা বাড়ানো মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না। মহার্ঘ ভাতা বাড়াতে গিয়ে এক বছরে সরকারের বাড়তি খরচ হবে অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

সরকারের এমন সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতির অগ্নি অবস্থাকে আরও উসকে দিল। একদিকে, আয় বাড়িয়ে দেয়া হলো সরকারি চাকুরেদের। অন্যদিকে, খরচ-ভোগান্তি বাড়িয়ে দেয়া হলো সাধারণ মানুষের। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কথা বলে অসময়ে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর মাঝে জনকল্যাণ চিন্তার চেয়ে একতরফা শাসনের চিন্তা বেশি স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের পরামর্শ ছিল করজাল বিস্তৃত করে রাজস্ব বাড়ানোর। সেখানে প্রকারান্তরে জালে ফেলা হলো সাধারণ জনগণকে। বেতন বাড়াতে গিয়ে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর চেয়ে ১৭ কোটি মানুষকে এক অর্থে শিকারই বানানো হলো। অথচ সরকারের দিক থেকে জানানো হয়েছিল, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা। বাস্তবে দেখা গেল আরেক বৈষম্য। একটা পক্ষের আয় বাড়ানো, আরেকপক্ষের ব্যয় বাড়ানো।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করার কথা শোনানো লেও করা হলো উল্টোটা। সরকারিদের মহার্ঘে নিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের টিসিবির ট্রাক দেখিয়ে দেয়া। সেখানেও গোলমাল। প্রচুর সংখ্যক ভুয়াকার্ডের কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজেই। তারপরও বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রতি মাসে হাজারে হাজার অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রাজধানী ঢাকাতেই তাদের প্রতিদিন ৮-১০টি টিম কাজ করে। বন্ধের দিনও অভিযান চলে। অন্যায়, বৈষম্যের সঙ্গে একটি সমাজের বেশির ভাগ মানুষের মাখামাখিতে যা হবার বাজারে আসলে তা-ই হচ্ছে। সামনে রমজান, তখন কী হবে?-উদ্বেগের বিষয়।

রমজানের সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সয়াবিন তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, সেমাই। সরকার এসব পণ্যের ডিউটি ও ট্যারিফ কমিয়েছে। কিন্তু, বাজারে এর সুফল মেলার লক্ষণ এখন পর্যন্ত নেই। তবে, টিসিবির ট্রাক সেল বেশ জমেছে। নাক-মুখ ঢেকে বা মাস্ক পরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকের ট্রাকের লাইনে ঢুকে পড়ার নমুনা বলে দিচ্ছে টিসিবির পণ্যের কদর। নিত্যপণ্যের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি ও সংসারের অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারিদের পে-স্কেল, মহার্ঘ ভাতা ইত্যাদির প্রচলন। অসরকারি বা বেসরকারিদের এ শুমারিতে আনা হয় না। তাদের ভরসা টিসিবির ট্রাকে।

Advertisement

আরেকটু খোলাসা করে বললে তারা টিসিবির ট্রাকের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে নিত্যপণ্য কিনবে, আর অতিরিক্ত কর দিয়ে এই মহার্ঘ ভাতার টাকার জোগান দেবে। দেশে রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ভ্যাট। আয়কর বা কাস্টমস ডিউটি নয়। আর এই ভ্যাট পরোক্ষে আদায় করা হয় বিধায়, তা রাস্তার ফকির থেকে সর্বস্তরের মানুষকে দিতে হয়। অথচ এই সব মানুষের আয় বৃদ্ধি দূরে থাক, মূল্যস্ফীতির চাপে আয়-রোজগারই কমে আসছে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ ঘোষণা করা বেতনকাঠামোতে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ালে তাঁরা দুর্নীতিতে জড়াবেন না। বৈধ উপার্জন দিয়েই তারা স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবেন। বাস্তবটা এ রকম হয়নি। বরং দুর্নীতি-চুরিসহ নানা পাপাচার আরো বেড়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার অযৌক্তিক সুবিধা দিয়েও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করতে চেয়েছে; বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিনা সুদে গাড়ির ঋণ ও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ভাতা। এ ছাড়া সরকারের হঠাৎ মনে হয়েছিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষেও একটা ভাতা দেওয়া যায়। সরকার চাইলে যে কাউকে ভাতা দিতে পারে। তা বাতিলও করতে পারে। এ বিষয়ে যুক্তি এবং উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে না সরকার। যুক্তির নামে কথা বলে এদিকে-ওদিকে। সরকার বা নিয়োগকর্তারা চাইলেও বেসরকারি খাতের কর্মীদের জন্য মহার্ঘের মতো কোনো ভাত-ভাতার ব্যবস্থা করতে পারবে না। সমাজের সব মানুষ ভাতা চায়ও না। কারো কারো কাছে অসম্মানের। তারা চায় কাজ। কাজের মাধ্যমে আয়-রোজগার। ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা চান পুঁজির গ্যারান্টি।

পুঁজিতে টান পড়ে গেছে ব্যবসায়ীদের অনেকের। না পারছেন সইতে, না ব্যবসা ছেড়ে দিতে। বিতাড়িত সরকারের আমলে রাজনৈতিক টালমাটাল সময় থেকেই একটা অব্যক্ত অস্বস্তিতে ভুগেছেন। বিনিয়োগে খরার টানের কথা বললেও সরকারের একতরফা উন্নয়নের বাজনায় তা তলিয়ে গেছে। সচরাচর রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই কমে।

সেই গ্যারান্টি নেই। পুঁজিতে টান পড়ে গেছে ব্যবসায়ীদের অনেকের। না পারছেন সইতে, না ব্যবসা ছেড়ে দিতে। বিতাড়িত সরকারের আমলে রাজনৈতিক টালমাটাল সময় থেকেই একটা অব্যক্ত অস্বস্তিতে ভুগেছেন। বিনিয়োগে খরার টানের কথা বললেও সরকারের একতরফা উন্নয়নের বাজনায় তা তলিয়ে গেছে। সচরাচর রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই কমে।

Advertisement

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে এ প্রবণতা হজম করতে অভ্যস্ত ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা। গেল বছরের ৭ জানুয়ারি একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর , জুলাই-আগস্টে গণ-আন্দোলনে দেশ আরও অস্থির হয়েছে। নতুন সরকার আসার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা কমেও কমলো না। বরং নতুন ডালপালা বিস্তার। এর জেরে ব্যবসা-বিনিয়োগ কমতে কমতে এখন তলানিতে। এসব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে আলাপ-আলোচনা ও সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ দরকার, সেখানে মোটাদাগের ঘাটতি।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম