ফিচার

পথের ধারের খাবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি কেমন?

শেখ আনোয়ার

Advertisement

এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার প্রিয় খাবারের তালিকায় পথের ধারের ভাজা খাবার নেই। পথের ধারে তৈরি পিঁয়াজু, পুরি, সিঙ্গারা, জিলাপি, বুন্দিয়া, সমুচা, কাবাব, কাটলেট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, হটডগ, ফুচকা ইত্যাদি দেদারসে খাচ্ছে। যেন দস্তুরমতো কবিরাজি মহৌষধ। এসব খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় অনেকদিনের পুরাতন বাসি তেল, রং-কেমিক্যাল, পচা সবজি, পোকাযুক্ত আটা-ময়দা ও মানহীন নানা পণ্য। সঙ্গে পথের ধারের ধুলো-ময়লা ফ্রি। যে কারণে এগুলো আমাদের শরীরের জন্যে টক্সিক বা বিষাক্ত। প্রশ্ন উঠেছে, পথের ধারের ভাজা খাবারের মান কতটা ভালো? এসব খাবার শরীরের পক্ষে কতটা ঝুঁকি সৃষ্টি করে?

ফাঁকিতে ভরা: গ্লোবাল যুগে পথের ধারের খাবারের আধুনিক নাম ফাস্টফুড। আগেকার দিনে ফাস্টফুড ছিল ঘরে বানানো নানান পিঠা। যুগ বদলেছে। যুগের কালচার, পথের ধারের ভাজা খাবার না খেলে দিনই চলে না। বিদেশেও পথের ধারের খাবারের প্রচলন রয়েছে। তবে আমাদের দেশের মত নোংরা পরিবেশে নয়। পথের ধারে কাচ দিয়ে ঘেরা ফাস্টফুডের অধিকাংশ দোকান বাইরে দৃষ্টিনন্দন, চাকচিক্য ও সুন্দর করে সাজানো হলেও যেন মাকাল ফল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাওয়ানো হয় পচা-বাসি খাবার! ঠনঠনে বাসনের মতো ভেতরটা ফাঁকা ও ফাঁকিতে ভরা।

আবার খেতে মন চায় কেন: এমনিতে তেলের ভাজাভুজীর স্বাদ কয়েক গুণ বেশি হয়। কিন্তু একবার খেলে বারবার খেতে মন চায় কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষকরা জানান, ‘ভাজা-পোড়া খাবার-দাবারে সব সময় টেস্টিং সল্ট ও মুখরোচক মশলা ব্যবহৃত হয়। এছাড়া যেকোনো খাবার গ্রহণের সময় কিছু অনুভূতি কাজ করে। পথের ধারে বলে অনেকটা সুখ অনুভূত হয়। তাই পরবর্তীতে সেই স্বাদ বা অনুভূতির জন্যই আমরা সেটা আবার খেতে চাই।’ এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ঢাকায় গড়ে ৬০ লাখ মানুষ পথের ধারের খাবার খায়।

Advertisement

যা খাচ্ছেন: পথের ধারে ভাজা খাবার এখন রমরমা ব্যবসা বটে! পথের ধারে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয় অর্ধশত চেয়ার। যেখানে বসে মানুষ ক’দিনের পচা-বাসি খাবার মশলা দিয়ে আরামসে চিবিয়ে খায়। শহর এলাকায় রাস্তার দুই পাশে ভ্যান নিয়ে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরাও তেলে ভাজা নানা খাবারের ব্যবসা করে। এসবের পাশেই দেখা যায়, মাছ, মাংস ও মুরগির বেচাকেনা। পান-সিগারেটের দোকান, চায়ের দোকান, ফলের পসরা, আসবাবপত্র, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, এমনকি পেট্রোল ও ডিজেলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য পদার্থ বিক্রি হয়।

আবার কোথাও ড্রেনের পাশে কিংবা প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা পরিবেশে গরম তেলে ভাজা হয়। চুলার পাশে হরহামেশা দেখা মেলে অপরিষ্কার নালা এবং তেলাপোকার বিচরণ। ময়দায় দেখা যায় পোকা। পচা সবজি দিয়ে অস্বাস্থ্যকরভাবে তৈরি হয় খাবার। এসব খাবারের সঙ্গে কী পরিমাণ ধুলো-ময়লা, ভেজাল ও রাসায়নিক রং শরীরে ঢুকে পড়ছে তা কি কেউ কখনো ভেবে দেখেছেন? পথের ধারে ভাজা খাবারের এসব ব্যবসা শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারেও স্থান করে নিয়েছে। সরকারি নানা সংস্থা প্রায়ই অভিযান চালায়। কিছুদিন যেতেই আবার পুরোনো চেহারায় ফিরে আসে।

পুরোনো তেল কতটা ক্ষতিকর: ভালো তেল রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। আবার ভিটামিন ডি-র ঘাটতি মেটাতেও সক্ষম। যা ত্বক আর চুল ভালো রাখে। তেল অ্যান্টিএজিং এজেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে শরীরের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ততার হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু পথের ধারে তেলে ভাজা সমুচা, পুরি, ফুচকা, সিঙ্গাড়া যতই মুখরোচক হোক না কেন; কে না জানে, এসবে সব সময় পুরোনো তেল ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞের মতে, ‘কোনো খাবার একবার ভাজার পর দ্বিতীয় দফায় সেই তেলে কিছু ভাজা ঠিক স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এতে তেলের গুণগত মান ঠিক থাকে না।’ বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, রান্নার পর অবশিষ্ট তেলে বারবার রান্না করা খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ তেল অনেকবার গরম করলে তেলের স্বাভাবিক রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন হয় এবং বেনজোপাইরিন নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক যৌগ তৈরি হয়। যা এন্টিঅক্সিডেন্ট তৈরিতে সহায়ক এনজাইমগুলোকে নষ্ট করতে পারে।

এছাড়া এই বেনজোপাইরিন কারসিনোজেনিক হিসাবে ক্যান্সার তৈরিতে সহায়তা করে। মানুষের শরীরে এ পুরোনো তেলের খাবার নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব খাবার পেটের বিভিন্ন রকম সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন- বদহজম, পেট ব্যথা, পেটে নানা রকম অস্বস্তি বোধ হওয়া, পেটে অতিরিক্ত গ্যাস হওয়া, বিশেষ করে যাদের পেপটিক আলসার রয়েছে; তাদের জন্য ভয়ানক সমস্যা হয়। একপর্যায়ে আমাশয়, ডায়েরিয়া, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। আগেই বলা হয়েছে, নানা ক্ষতিকর ভেজাল দ্রব্যের কারণে শরীরে তৈরি হয় টক্সিন বা বিষ। রক্তে বিষ থাকলে কোষের জন্ম বিঘ্নিত হয়। স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ব্যাহত হয়। অব্যাহতভাবে এসব খেলে বিষের ক্রিয়া বেড়ে যায় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অকাল মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান।

Advertisement

যেভাবে এড়িয়ে চলবেন: পথের ধারে ভাজা খাবার নেশার মতো। একটি নির্দিষ্ট সময় এ ভাজা খাবার খেতে মন চায়। তাই সে সময়ে অন্য কাজ করুন। না হলে আগেই কিছু খেয়ে নিলে সে সময় আর খেতে ইচ্ছে হবে না। নিজেকে অন্য খাবারের দিকে নিয়ে যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যদি কোনো ফাস্টফুডের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তবে এখনই আনফলো করুন। কারণ এটি আপনার মধ্যে পথের ধারের খাবার গ্রহণের প্রবণতা অনেক বাড়িয়ে তুলবে। বাসায় তৈরি খাবার বেশি করে খান। পথের ধারের খাবারের কথা মনে পড়লেই পানি পান করুন। এজন্য সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো নিজের মনকে বিরত রাখুন। ইচ্ছাশক্তি এমন একটি জিনিস, যা চাইলে একটি পর্বত নাড়িয়ে দিতে পারে। নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পারলে অন্য কোনোভাবে এর অপকারিতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। যখন ইচ্ছে করবে পথের ধারে তৈরি ভাজা খেতে, সঙ্গে সঙ্গে সে টাকা দিয়ে ফল কিনে খান।

পথের ধারে তৈরি তেলে ভাজা খাবার কখনো নয়। এসব রঙিন, দুষিত খাবারের বিরুদ্ধে ক্রেতা সাধারণ সরব হলে, বিক্রেতা রং, কেমিক্যাল, পুরোনো তেল ব্যবহার বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। খাবারের বিভিন্ন রং, কেমিক্যাল, পুরোনো তেলের ব্যবহারের শারীরিক বিপদ সম্পর্কে নিজে সাবধান থাকা, অন্যকেও অবহিত করা দরকার। একমাত্র সবার মিলিত সাবধানতাই এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। পথের ধারের খাবার গ্রহণের আগে একবার ভাবুন, শরীরের জন্য এর বাজে দিকগুলো কী কী? আপন মনে নিজ ইচ্ছায় এ খাবার ত্যাগ করুন।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস