ফিচার

রোগের পূর্বাভাস ও নির্ণয়ে এলো নতুন প্রযুক্তি

সবার জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে। নাজুক এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আইহেলথস্ক্রিন ইনকরপোরেশন ইউএসের মাইহেলথ উদ্ভাবিত কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন ও অনলাইনভিত্তিক বহুমুখী উদ্ভাবন বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যসেবা কোটি মানুষের নাগালে চলে আসা এখন সময়ের ব্যাপার। এরই মধ্যে কিছু সুবিধা বাংলাদেশের মানুষ পেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মাইহেলথের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নির্ণয়ে উদ্ভাবিত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সফটওয়্যার বিপুল সংখ্যক মানুষকে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইহেলথস্ক্রিন ইনক ডট ইউএস বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বঞ্চিত অসংখ্য মানুষের জন্য গড়ে তুলেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম মাইহেলথ। মাইহেলথ টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। আর উন্নত বিশ্বে প্রচলিত ডিজিটালাইজড স্বাস্থ্যতথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাও আনা হয়েছে বাংলাদেশে।

Advertisement

সবার দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা: সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও সতেরো কোটির বেশি মানুষের এ দেশে স্বাস্থ্যখাত পড়েছে চ্যালেঞ্জে। হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত রোগীর চাপ। অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, আরও অনেকে আক্রান্ত। স্বভাবতই হাসপাতাল-ক্লিনিকে বেসামাল পরিবেশ। নজিরবিহীন এ পরিস্থিতি সামলানোর উপায় কী? কিভাবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই পেতে পারেন চিকিৎসাসেবা? মাইহেলথ কাজটি একেবারেই সহজ করে দিয়েছে বহুমুখী সুবিধার টেলিমেডিসিন ব্যবস্থার মাধ্যমে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আইহেলথ স্ক্রিন ইনকরপোরেশনের একটি সফল স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি। মার্কিন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অর্থ সহায়তা ও গাইডলাইন অনুযায়ী পরিচালিত হয় আইহেলথ স্ক্রিন। স্বাভাবিকভাবেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের গবেষণা ও উন্নত প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটেছে মাইহেলথে।

কী কী সেবা দেয় মাইহেলথ: চিকিৎসাসেবার নানা ক্ষেত্রে কাজ করে মাইহেলথ। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো: টেলিমেডিসিন, ইলেক্ট্রনিকহেলথ রেকর্ড (ইএইচআর), ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ভিত্তিক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, এইজ রিলেটেড ম্যাসকিউলার ডিজেনারেশন ডিজিজ (এএমডি) এবং গ্লুকোমা (অন্ধত্বের প্রধান কারণ), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক অন্যান্য রোগ (স্ট্রোক, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস) নির্ণয় এবং আগের থেকেই অনুমান করার ব্যবস্থা এবং রোগীর তথ্য সংরক্ষণ এবং সহজে ফাইল শেয়ারিং ও রেফারেন্স।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা: টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের কাছেও চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিচ্ছে মাইহেলথ। সুবিধামত সময়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও রোগী কথা বলতে পারেন ফোন, অনলাইন ও অ্যাপের মাধ্যমে। এখানে চিকিৎসক যেমন রোগীর কাছ থেকে মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পারেন; তেমনি রোগীও দ্রুত পান জরুরি পরামর্শ। রোগী নিজেও সুবিধাজনক সময়ে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন।

Advertisement

রোগীর স্বাস্থ্যতথ্য সংরক্ষণ: উন্নত বিশ্বে এ ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে ডিজিটালাইজড স্বাস্থ্যতথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কোনো চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রোগীকে তার আগের সব স্বাস্থ্যতথ্য মৌখিকভাবে জানাতে হয়। এক্ষেত্রে রোগী অনেক তথ্য ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন। কিংবা কাগজে লেখা প্রেসক্রিপশন হারিয়ে ফেলতে পারেন। প্রেসক্রিপশনে বিস্তারিত সব তথ্য লেখার সুযোগও নেই। মাইহেলথে তথ্য সংরক্ষণ একেবারেই সুরক্ষিত একটি ব্যবস্থা। ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ডে (ইএইচআর) স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রোগীর পারিবারিক রোগ বিবরণী যেমন থাকবে; তেমনি রোগীর নিজের রোগ সম্পর্কিত সব তথ্যও সংরক্ষণ করা হবে। ফলে চিকিৎসক খুব দ্রুত ও নিখুঁতভাবে রোগীকে চিকিৎসা পরামর্শ দিতে পারবেন।

ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন: মাইহেলথের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন দেবেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে। স্টাইলাস পেনের সাহায্যে নিজেরা হাতে লিখে অথবা কম্পিউটার কী-বোর্ডে টাইপ করে রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা তৈরি করতে পারেন। রোগী ও ডাক্তার মুখোমুখি হয়ে যেভাবে প্রেসক্রিপশন লিখে দেন, সেভাবে দূরে থেকেও ডিজিটাল প্রেসক্রিপশন মিলবে মাইহেলথ সেবায়। যা সহজেই ডিভাইসে ডাউনলোড ও প্রিন্ট করা যায়।

তথ্য আদান-প্রদান: সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তথ্য আদান-প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাইহেলথে ফাইল শেয়ারিং ও রেফারেন্স ব্যবস্থায় কাজটি একেবারেই সহজ করা হয়েছে। রোগী সব ধরনের তথ্য পাবেন। চিকিৎসক চাইলে তার রোগীর তথ্য সম্বলিত ফাইলসহ মাইহেলথে নিবন্ধিত অন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করতে পারবেন।

অন্ধত্ব থেকে বাঁচবে মানুষ: মাইহেলথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিভিত্তিক সফটওয়্যার, যার সাহায্যে নিখুঁতভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (ডিআর), এইজ রিলেটেড ম্যাসকিউলার ডিজেনারেশন ডিজিজ (এএমডি) এবং গ্লুকোমা নির্ণয় করা যাবে। দেশ-বিদেশে কয়েক কোটি মানুষ অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পেতে পারে এ প্রক্রিয়ায়। আক্রান্ত হওয়ার আগে বা শুরুতেই প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ডিআর আক্রান্ত রোগীদের ৯০ ভাগকে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করা যায়। অ্যাসোসিয়েশন অব রিসার্চ অ্যান্ড ভিশনের (এআরভিও) মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও অনুমোদিত এ সফটওয়্যার। নিরীক্ষণ নির্ভুলতার হার ৯৮ শতাংশ। খ্যাতিমান চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন হলো, মাইহেলথের সফটওয়্যার দিয়ে চোখের ফানডোস্কোপিক ছবি থেকেই বলে দেওয়া যাবে এটি ডিআর কি-না? এটি এতোটাই নির্ভুলভাবে করা যাবে যে, কোনো দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এটি বিরাট সুখবর। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাথে এ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে যার অর্থায়নও করা হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির নিবন্ধিত ৫০ লাখ রোগীর ডিআর পরীক্ষা করবে আইহেলথস্ক্রিন। শুধু তাই নয়, এর সাথে থাকছে আরও রোগ নির্ণয়ের সুবিধা, যেমন- এএমডি, যা প্রাথমিক পর্যায় নির্ণয় করা সম্ভব। আর ধরা পড়বে গ্লুকোমা সমস্যা।

Advertisement

সবশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। যাদের একটি বড় অংশ অন্ধত্বের হুমকির মুখে রয়েছেন। আইডিএফের প্রতিবেদনে ২৯ লাখ ৭০ হাজার মানুষের রেটিনোপ্যাথি সমস্যা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করা হয়। বিপুল সংখ্যক এ রোগীর স্ক্রিনিং করার জন্য দরকার নির্ভুল, স্বয়ংক্রিয়, কার্যকরী পদ্ধতি। যা মাইহেলথের এ সফটওয়্যারে রয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু চক্ষু বিশেষজ্ঞের অনুপাত ৪:১ মিলিয়ন, চাহিদার তুলনায় খুবই কম। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ সফটওয়্যার চিকিৎসকদের জন্যও বড় সুখবর। কারণ এর মাধ্যমে তারা রোগীর তথ্য, রেটিনা ইমেজের ডেটা ছাড়াও চোখের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আগাম জানতে পারবেন। অনেক কম সময়ে অনেক বেশি রোগীকে সঠিকভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। রেটিনাল ক্যামেরা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত ভ্রাম্যমাণ বাসের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও যে কেউ সেবা নিতে পারবেন।

অন্যান্য রোগ পূর্বানুমান: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার ব্যব্যহার করে অন্যান্য রোগেরও পূর্বানুমান সম্ভব। স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কতটুকু, তা আগেই জেনে নিতে পারবেন রোগী। চিকিৎসক সে অনুযায়ী পরামর্শ দিয়ে রোগীর জীবন শঙ্কামুক্ত করতে পারবেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এমন ব্যবহারকে বেশ ইউনিক বলে মানছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে ডাক্তার-রোগী অনুপাত অসামঞ্জস্যপূর্ণ; সেখানে এ সফটওয়্যার যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।

আইহেলথস্ক্রিন ইনকরপোরেশন ইউএসের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান বিজ্ঞানী ও সিইও হলেন বাংলাদেশের ড. মো. আলাউদ্দীন ভূঁইয়া। তিনি নিউইয়র্কের আইকান স্কুল অব মেডিসিন মাউন্ট সিনাইয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ। হার্ভাড স্কলার এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করা এ বাংলাদেশি বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। নিজ দেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে এরই মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আইহেলথস্ক্রিন বাংলাদেশ।

ড. ভূঁইয়া বলেন, ‘দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে মাইহেলথ। আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী যে, মাইহেলথের অ্যাপ্লিকেশন বাস্তবায়নে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং সেবা প্রত্যাশী উভয়েই সুবিধা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাবেন। আর করোনার এ সময়ে স্বাস্থসেবা সবার জন্য নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মাইহেলথ সবার জন্য অপার সুবিধা বয়ে আনবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’

এসইউ/এএ/পিআর