মতামত

মাসুদ রানাকে নিয়ে আমাদের আবেগ এবং বিতর্ক

হঠাৎ করে দেশে আলোচনায় ওঠে এসেছে মাসুদ রানা। বাংলাদেশের জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার সিরিজ ‘মাসুদ রানা’কে ঘিরে বিগ বাজেটের সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা, ‘কে হবেন মাসুদ রানা’ এই শিরোনামে টিভি রিয়েলিটি শো, সর্বোপরি মাসুদ রানার আসল লেখক কে- সেটা নিয়েই বিতর্কই মাসুদ রানাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

Advertisement

‘মাসুদ রানা’র জন্ম আমার জন্মেরও আগে। ১৯৬৬ সালের মে মাসে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে গড়ে প্রায় ৪০ দিন অন্তর এই সিরিজের একটি পর্ব প্রকাশিত হয়ে আসছে। সিরিজটির প্রকাশক এবং সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম প্রকাশিত হচ্ছে এই বইয়ের প্রচ্ছদে। এতোদিন পাঠক জানতো তিনিই এর লেখক কিন্তু অর্ধ শতাব্দী পার হওয়ার পর শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক- কে এর আসল লেখক? প্রায় ৫০০ বইয়ের অনেকগুলোই নাকি কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা নয়!

মাসুদ রানার বয়স এখন ৫৩। বলা যায় আমাদের প্রায় সমসাময়িক। আমরা এবং আমাদের ইমিডিয়েট বড় ভাই ও ছোট ভাই যাদের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কেউ মনে হয় বাদ নেই একবার হলেও মাসুদ রানা পড়েন নি। রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ তেমনি আরেকটি সিরিজ যেটি বাঙালি পাঠকসমাজে পরিচিতি লাভ করেছে। দু’টিকে নিয়েই সিনেমা হয়েছে। তবে এবার মনে হচ্ছে ঘটা করে মাসুদ রানাকে বড় পর্দায় আনতে যাচ্ছে জাজ মাল্টিমিডিয়া।

ঋণখেলাপের জন্য বহুল আলোচিত এক ব্যক্তি জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধান। সেটিও এই খবরকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। খবরে দেখলাম ৮৩ কোটি টাকা দিয়ে বড় পর্দায় এই মাসুদ রানাকে আনার আয়োজন চলছে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করবেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলিউডের ডিরেক্টর আসিফ আকবর। ছবির সহ-প্রযোজক হিসেবে আছে হলিউডের সিলভার লাইন। ছবিটির চরিত্রের জন্য বেশ কিছু তারকাকে নাকি নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে অভিনয় করতে যাচ্ছেন রেসলিং দুনিয়ার ভয়ঙ্কর তারকা দ্য গ্রেট খালি। ছবিতে ভিলেন হিসেবে থাকবেন খালি। থাকছেন ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ ছবির খলনায়ক ড্যানিয়েল বার্নহার্ড। এছাড়াও আছেন ‘আয়রন ম্যান-২’ খ্যাত হলিউডের জাঁদরেল অভিনেতা মিকি রোর্ক, গ্যাব্রিয়েল্লা রাইট, মাইকেল প্যারেসহ বেশ ক’জন তারকা।

Advertisement

নির্মাতারা বলছেন, মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম পর্ব ‘ধ্বংস পাহাড়’ নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হচ্ছে। এর ইংরেজি নাম ‘এমআর-৯’ আর বাংলা নাম হবে ‘মাসুদ রানা’। শুটিং হবে মরিশাস, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে। ছবিটি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় আসবে। পরে অন্য ভাষায় ডাবিং বা সাবটাইটেল হবে। এটি বিশ্বব্যাপী মুক্তি দেওয়া হবে।

নায়ক কে হবে সেটা এখনো পরিষ্কার ঘোষণা আসেনি। টিভি রিয়েলিটি শো ‘কে হবেন মাসুদ রানা’ প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে আগামী ২ আগস্ট থেকে, চ্যানেল আইতে। তার মধ্য দিয়ে নাকি মাসুদ রানা চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হবে। এই ধরনের রিয়েলিটি শো এর মাধ্যমে সিনেমাটির উপযুক্ত নায়ক পাওয়া যাবে বলে আমি অবশ্য সন্দিহান। আমি সন্দিহান ছবিটির বাজেট অনুসারে ব্যবসা নিয়েও। এই প্রজন্মের অনেকেই মাসুদ রানা কে- সেটাই চিনে না। তাদের হিরোরা এখন দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধও নেই।

মাসুদ রানা নিয়ে আলোচনায় একটা জিনিস অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি যে বহুল জনপ্রিয় এই সিরিজটি ব্যক্তিগতভাবে আমার কখনোই খুব পছন্দের ছিল না। সর্বোচ্চ ১০টির বেশি পড়েছি কি না আমার সন্দেহ আছে এবং আমি মাসুদ রানা পড়েছি সিরিজ আকারে নয়, যেটা যেটা মনে ধরেছে সেটি। দুর্ভাগ্য যে একটার কাহিনীও মাথায় নেই। আমার উপন্যাস পড়ার শুরুটা খুব কম বয়স থেকেই। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার আগেই উপন্যাস পড়া শুরু করেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে আমার পড়া প্রথম উপন্যাস ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’। টেকচাঁদ ঠাকুরের লেখা এই বইটি আমাদের বাসার বুক শেলফে পেয়েছিলাম।

এটি আমার বিশেষ করে মনে আছে আরেকটা কারণে। কলেজে প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস ছিল বাংলা। শিক্ষক শ্রেণি কক্ষে নাম ডাকা শেষে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন- বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস কী? একমাত্র ছাত্র হিসেবে হাত তুলে জবাব দিয়ে স্যার এবং ক্লাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি। স্কুল বয়সে দ্বিতীয় উপন্যাস পাঠ ছিল যাযাবরের ‘দূরবীন’। তেমন কিছু বুঝিনি পড়ার পরে। এর পরেরটা আরো ভয়াবহ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাথ বধ কাব্য’। উপন্যাসের প্রতি আমার অনীহা শুরুর আগেই স্কুলে কোনো এক প্রতিযোগিতায় পেয়েছিলাম ‘কী পাইনি’ নামের একটি উপন্যাস। লেখক ছিলেন আকবর হোসেন। সেটি পড়ার পর আমার প্রচুর আগ্রহ জমে বই পড়ার। তারপর উনার লেখা ‘অবাঞ্ছিত’ নামের একটি উপন্যাস আমি কিনে পড়েছিলাম।

Advertisement

উপন্যাস পড়ার ধুমের মাঝে হাতে আসে ‘মাসুদ রানা’। আমার সমবয়সী ভাগ্নে নাসির ছিল এই মাসুদ রানার এক অন্ধ ভক্ত। সেবা প্রকাশনীর এই সিরিজ ছাড়াও এমন কোনো বই নেই সে স্কুল জীবনে না কিনে ছেড়েছে। তার পুরো রুমের খাটের নিচ, টেবিল, আলমারি ভর্তি ছিল মাসুদ রানা আর সেবা প্রকাশনীর বইয়ে। সেখান থেকে নিয়ে আমি কয়েকটি পড়েছিলাম, দু’ একটা নিজেও কিনেছিলাম।

কিন্তু আমার কাছে শুরু থেকে এটিকে অবাস্তব কাহিনী মনে হতো। কখনোই মেনে নিতে পারতাম না এমন একটি চরিত্র কারণ নায়ক ঘোড়ায় চড়ে লাফ দিয়ে নদী পার হয়ে যাচ্ছে- এ ধরনের উদ্ভট জিনিস বিশ্বাস করার বয়স তখন থাকলেও আমি কেন জানি বিশ্বাস করতাম না। একজন সুপার হিরো যার পক্ষে সব কিছুই সম্ভব, অসম্ভব বলে কিছুই নেই, যে কখনো পরাজিত হয় না, যার কোনো মৃত্যু নেই- এমন কাহিনী আমার মনে ধরেনি। মাসুদ রানা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা বিসিআই নামে একটি কাল্পনিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি। ঢাকার মতিঝিলে তার অফিস। সেখানে সে রিপোর্ট করে তার বস রাহাত খানকে- এগুলো সবই আমার কাছে বানানো গল্প মনে হওয়ার কারণে মাসুদ রানার প্রতি আসক্ত হতে পারেনি।

তবে একটি জিনিস আমি প্রশংসা না করে পারি না। মাসুদ রানা উপন্যাসের সহজ বাক্য গঠন, ভাষা শৈলী অত্যন্ত চমৎকার যেটি যেকোন পাঠককে শুধু কাছে টানবে না তার নিজের লেখনী উন্নত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। রেখেছেও। আমার পরিচিত অনেকেই লেখালেখিতে হাত পাকিয়েছে মাসুদ রানা পড়েই। আমি নিজে সেবা প্রকাশনীর বিশ্ববিখ্যাত সব উপন্যাসের সহজ পাঠ সংস্করণের পাঠক ছিলাম।

যাই হোক, সেই বিখ্যাত মাসুদ রানার লেখক কে উপন্যাসটির ৫৩ বছর বয়সে এসে তার অনুসন্ধান চলছে। চলছে আলোচনা। বিতর্ক চলছে লেখক সমাজে, পাঠকদের মধ্যেও। সেটি ওঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। আনোয়ার হোসেন কী আসলেই মাসুদ রানার লেখক নাকি অন্যদের দিয়ে লিখিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করেছেন- সেটিই মনে হয় সবচেয়ে বিব্রতকর একটি বিষয় এই দেশে প্রচুর পাঠক সৃষ্টিকারী সেবার কর্ণধার এবং মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্য।

সম্প্রতি ঔপন্যাসিক শেখ আব্দুল হাকিম তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে আরেক লেখক ইফতেখার আমিন ‘মাসুদ রানা’র লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে যে অভিযোগ করেছেন তার সঙ্গে একমত হয়ে তিনিও অনেকগুলো অভিযোগ করেছেন কাজীর বিরুদ্ধে। দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন। আমি ইফতেখার আমিনের পোস্ট দেখিনি। তাই অভিযোগগুলো হুবহু জানি না। তবে দীর্ঘ সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে আব্দুল হাকিম তুলে ধরেছেন কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য হওয়ার কথা। জানিয়েছেন কীভাবে তাকে ‘ঠকিয়েছেন’ সেটি।

আব্দুল হাকিম লিখেছেন, “আমি ২৬০টার বেশি মাসুদ রানা লিখেছি, কুয়াশা সিরিজের বই লিখেছি ৪০ কি ৪২টা, আরও লিখেছি নিজেকে জানো সিরিজের গোটা দুই-তিন বই, রহস্যোপন্যাস গোটা আটেক, জুল ভার্নও পাঁচ-সাতটা অনুবাদ করেছি। সবই হয় কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে, নয়তো তাঁর নিজের পছন্দের কোনো ছদ্মনামে (যেমন, বিদ্যুৎ মিত্র), তবে এসব বইয়ের একটারও কপিরাইট আমি কাজী সাহেবের কাছে বিক্রি করিনি।

আমাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কপিরাইট অফিস অনেক বার কাজী সাহেবকে সশরীরে উপস্থিত হতে বলা সত্ত্বেও একবারও তিনি আসেননি, তার বদলে চিঠির মাধ্যমে আমার দাবি অস্বীকার করতে গিয়ে বলেছেন আমি একটাও মাসুদ রানা লিখিনি, বই লেখার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। এটা শুনে সত্যি আমার হাসি পেয়েছিল। হাসি পাওয়ার কারণ, আমি যে মাসুদ রানা লিখছি, এটা এত বেশি মানুষ জানতেন যে সেটা ছিলো ওপেন সিক্রেট।”

হাকিম সাহেব দাবি করছেন, এই লেখার রয়্যালিটি বাবদ তিনি আনোয়ার হোসেনের কাছে দুই কোটি ১২ লাখ টাকা (কমপক্ষে) পান। কাজী সাহেব দিতে চান মোটে আট-দশ লাখ টাকা! স্বভাবতই তিনি তা নিতে চাননি। এখন তিনি আবারও তার পাওনা টাকা পাবার চেষ্টা করছেন। কাজীকে কিছুটা অভিশাপও দিয়েছেন লেখায়। বাস্তবতা হচ্ছে বইগুলো সবই আনোয়ার হোসেনের নামে, কপিরাইট স্বত্ত্বাধিকারী হিসেবে তার নামই মুদ্রিত। এই প্রেক্ষিতে কীভাবে আব্দুল হাকিম টাকা পাবেন, তার দাবি কতটা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে- আমি সন্দিহান। মাঝখানে দু’জনের লড়াইয়ে পাঠকরা জানলো বাংলাদেশের জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার স্রষ্টাদের কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com

এইচআর/জেআইএম