মতামত

জনগণের মানবিকতা রাষ্ট্রের ওপর পড়বেই

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে মানবিক নয় একথা নতুন করে বলার কিছুই নেই। বিশেষ করে প্রায় পঞ্চাশে পৌঁছে যাওয়া রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যতোটা এগুনোর কথা ছিল ততোটা পারেনি। কেন পারেনি তা নিয়ে বিস্তর কথা বলা যাবে, তবে শুধু একটি প্রধান কারণ যে ১৯৭৫ সালের কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড ও তার হাত ধরে এদেশে সেনা শাসন কায়েম হওয়া সেটাকে অস্বীকার করলে আমরা কোনো সত্য ও সিদ্ধান্তেই পৌঁছুতে পারবো না। অতএব, যে কোনো আলোচনায় আমরা যদি এই বিষয়টিকে মাথায় রাখি তাহলে আলোচনার ক্ষেত্রে সুবিধে হয়।

Advertisement

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বেরিয়েছে, তারও আগে ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তান বেরিয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তান একই দিনে স্বাধীন হলেও দু‘টি দেশের পার্থক্য কেবল বিস্তরই নয় বরং কোনো ভাবেই দু‘টি দেশ তুলনীয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গেই কি পাকিস্তানের কোনো ভাবে তুলনা চলে? চলে না। সত্তর পেরুনো পাকিস্তান এখন একটি স্বীকৃত অকার্যকর রাষ্ট্র এবং একই সঙ্গে দেশটির ভেতরকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্যও যে বাংলাদেশের তুলনায় অনেকটাই ‘মানবেতর’ সেকথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান থেকে বেরুনো বাঙালির এই অর্জন কী করে সম্ভব হলো? বিশেষ করে এই বিশাল জনগোষ্ঠী এবং বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়া সত্ত্বেও? এরকম প্রশ্নও আমাদের তোলা উচিত, নাহলে নিজেদের সম্পর্কে বোধটা আসলে তৈরি হওয়ার কথা নয়।

অপরদিকে ভারত কি রাষ্ট্র হিসেবে মানবিক? অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়েও আমরা একথা বলতেই পারি যে, ভারত রাষ্ট্রের ভেতর একটি শক্তিশালী দেশপ্রেমিক ও মানবিক গুণসম্পন্ন সুশীল সমাজ সবসময় ক্রিয়াশীল ছিল, যার ফলে দেশটিতে ধর্মবাদের চরম উল্লম্ফনের পরও কোথায় যেনো সামান্য আশা জেগে আছে মানুষের মনে যে, একদিন রাষ্ট্রটি এই ধর্মীয় উগ্রবাদের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াবে। গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে রাষ্ট্রটি বহুত্ববাদকে জায়গা করে দেবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ ভারতীয় বহুত্ববাদ ও পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অতীত-পুষ্ট একটি রাষ্ট্র, যে কিনা সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি দিয়ে কোনো রাষ্ট্রকে মাপা সম্ভব নয়, সেরকমটি হলে আরব রাষ্ট্রগুলোকে আমরা মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে পেতাম। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলি এখনও এমন এক দুরবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে যে, তারা পশ্চিমা তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের তৈরি করা অস্ত্রের বাজার কিংবা তেল-সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধংদেহী হয়ে একে অপরকে আঘাত করে চলেছে নিয়মিত।

Advertisement

আর বাংলাদেশের খুব কাছেই রয়েছে চীন, চৈনিক সভ্যতার আধুনিকতা নিয়ে এখন তারা মূলতঃ মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করার যে লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে তাতে খুব বেশিদিন লাগবে না যেদিন আমরা দেখতে পাবো যে, চীন নিজেদেরকে সম্পূর্ণ একটি ‘এলিয়েন রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, মানুষে তাদের খুব বেশি প্রয়োজন আসলে এখনও নেই, যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের দেশ চীন।

অপরদিকে রাশিয়ার এই পৃথিবীতে টিকে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য বোধকরি কেবল আমেরিকা তথা পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যই। সমাজতন্ত্রের পতনের পরও দেশটি নিজের অক্ষপথকে শক্তিশালী রাখার জন্য ক্রমাগত পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লাবাজি করে চলেছে, সেখানেও মানুষের কোনো কথা নেই, মানুষ শুধু বেঁচে থাকে, রাষ্ট্র তাদেরকে যেভাবে রাখে সেভাবেই টিকে থাকতে হচ্ছে তাদেরকে। আর দূর পশ্চিমের গণতান্ত্রিক ধারাটি এতোটাই বাণিজ্যিক হয়ে গিয়েছে যে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারাও নিজ হাতে নিজেদের তৈরি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অস্বীকার করছে, বিতর্কিত করছে কিংবা কখনও কখনও হত্যা করছে। গণতন্ত্রে যে শ্রেষ্ঠত্ব বলতে কিছু নেই সেটা তারা পৃথিবীকে বোঝাবে কি নিজেরাই কি বুঝেছে কখনও? শুরু থেকেই ‘আমরা’ এবং ‘তারা’ এই পার্থক্য দিয়ে পৃথিবীকে বিভক্ত করে এখন তার চড়া মূল্য দিচ্ছে পশ্চিম।

এই যখন বিশ্বায়নের কাল, আমরা যখন এই বিশ্বগ্রামেরই নাগরিক তখন বাংলাদেশকে আমরা কোন জাদুবলে আলাদা একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবো, সে প্রশ্ন এখন সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ নিয়ে যতো বেশি আলোচনা হবে ততোই আমরা দ্রুততার সঙ্গে একটি পথ বের করতে সক্ষম হবো। আপাততঃ আমাদের সামনে আর কোনো পথ নেই।

এই মুহূর্তের বাংলাদেশের দিকে তাকাই আমরা। ডেঙ্গুর মতো একটি ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত দেশের রাজধানী। মূলতঃ রাজধানী থেকে রোগটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন রোগীরা। আমরা হয়তো খবর রাখি না যে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া কিংবা লাওসের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি একত্রিত ভাবে এই ভয়ঙ্কর মশাবাহিত ভাইরাস মোকাবিলা করছে এই মুহূর্তে। অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। প্রতিবছর মৃতের সংখ্যা এর আগের বছরের সংখ্যাকে ছাড়াচ্ছে, এমতাবস্থায় থাইল্যান্ড ডেঙ্গুকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশেও ২০০০ সালের দিকে ডেঙ্গু সনাক্ত হলেও তারপর থেকে একাধিকবার ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। এর মধ্যে চিকনগুনিয়া নামে আরেকটি মশাবাহিত রোগের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমছে। আমাদের শরীরে কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনকে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আগেই।

আমরা এক্ষেত্রে দেখেছি চরম অবহেলা। শুধু অবহেলাই নয়, ডেঙ্গু বিস্তার লাভের পর এ নিয়ে মেয়র ও সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীর অমানবিক ঠাট্টাও আমাদের দেখতে হয়েছে। অথচ এই ডেঙ্গুর প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব এক্ষেত্রে খুবই সামান্য, কারণ এই মশার বিস্তার ঘটে মানুষের নিজস্ব বাসস্থানে। এমতাবস্থায় মেয়রের পক্ষ থেকে দায়িত্বকে অবহেলা না করে জনগণকে সময় থাকতে সচেতন করার ব্যবস্থা গ্রহণই ছিল গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। কিন্তু তা যে আমরা দেখিনি তার মূল কারণ হলো, আমরা এখনও মানবিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারিনি।

কিন্তু মানবিক রাষ্ট্র কি রাষ্ট্র নিজে নিজেই হয়ে উঠতে পারে? আরও দু’টো উদাহরণ দেয়া যাক। পদ্মা সেতুতে কাটা মাথা লাগছে, এরকম গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশে একের পর এক পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটতে লাগলো। এর আগে ধর্ষণ যেনো হঠাৎই মহামারীর মতো নেমে এলো এদেশের বুকে। আমরা একথা সকলেই জানি যে, ধর্ষণের শিকার নারীটির জন্য এদেশ যেনো এক বিভীষিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দেয়াল হয়ে- ন্যায় বিচার ও মানবিকতার মাঝখানে। এই ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারার ক্ষেত্রে কী হলো? আমরা দেখলাম যে, বাড্ডায় নিহত নারীর শিশু সন্তানকে নিয়ে একদল মানুষ পিটিয়ে মারার বিরুদ্ধে মানববন্ধনে নেমে পড়লেন। সদ্য মাতৃহারা শিশুকে সামনে দাঁড় করিয়ে আমরা প্রতিবাদ করলাম পিটিয়ে মানুষ মারার বিরুদ্ধে। অমানবিক হওয়ারও একটা সীমা থাকে।

এখানেই শেষ নয়। এদেশে বিখ্যাত হওয়ার কিংবা বিখ্যাত হতে চাওয়ার মানুষের সংখ্যা বিস্তর। আমরা প্রায়শঃই একজন আইনবিদকে দেখতে পাই যিনি দায়িত্ব নিয়েই অনেক ভালো কাজ করেন। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই ভালো কাজের বিষয়টি বুমেরাং হয়ে যাদের জন্য ভালো কাজটি তিনি করতে চান তাদের ওপরই ফিরে আসে। এরকম দু’টো ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে গত কয়েক সপ্তাহের কিন্তু এখানে একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকছি। এই আইনবিদ ভদ্রলোক বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ভদ্রমহিলার শিশু সন্তানদের সহায়তা দেওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়ে তার ভিডিও লাইভ করলেন। তিনি দুই শিশু সন্তানকে দু’পাশে বসিয়ে তাদের মা’কে হত্যার যে বীভৎস বর্ণনা শোনালেন এবং ছেলে শিশুটি সেখানে বসতে না পেরে উঠে যেতে চাইলে তাকে টেনে ধরে বসিয়ে পুনরায় শুরু করলেন সেই ভয়ঙ্কর বর্ণনা। একে কী বলবেন? মানবিকতা? রাষ্ট্রের দোষ? আমরাতো শুরুতেই স্বীকার করে নিয়েছি যে, এই রাষ্ট্র এখনও মানবিক হয়ে উঠতে পারেনি, তবে চেষ্টা চলছে, চেষ্টাটি লক্ষ্যমান।

আর এই লক্ষ্যমানতায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে দেশের মানুষ। সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন এই মানবিক বোধটি সম্পূর্ণভাবে জাগ্রত হবে তখন আর রাষ্ট্রের সাধ্য কি অমানবিক হওয়ার? পাকিস্তান পারেনি কারণ দেশটির সাধারণ্যে এই জাগরণ ঘটেনি। ভারত খানিকটা পেরেছিল এই সাধারণ মানুষের জন্য কিন্তু সেখানে উল্টোরথ ছুটিয়েছে ধর্মবাদী অপশক্তি, কিন্তু সেখানেও একটি মানবিক দেয়াল ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কিন্তু ভারত কিংবা পাকিস্তান নয়, আমাদের কথা বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের মানবিকতা নিয়ে।

রাষ্ট্রকে সোজা রাখতে, রাষ্ট্রকে সৎপথে রাখতে সাধারণ্যের দায় ও দায়িত্ব যে বিশাল সেকথা নতুন করে বলার কিছুই নেই। গুজবে বিশ্বাস করবেন না, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না কিংবা দুর্নীতি করবেন না- রাষ্ট্র এসব বলে কিংবা কঠোর আইন প্রয়োগে এসব ঠেকানোর দায়িত্ব নিতে পারে কিন্তু এর দায়টা যে নাগরিকের সে সত্যকে অস্বীকার করলে আমাদের সামনে অন্ধকার অপেক্ষা করছে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/এমকেএইচ