মেট্রোরেলটি স্টেশনে পৌঁছাতে যাত্রীদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। অন্য যাত্রীদের মতো ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন সজল কুমার। কিন্তু পারেননি। দরজায় হাত আটকে যায় তার। বাইরে ঝুলতে থাকে তার পুরো শরীর। এভাবেই চলতে শুরু করে ট্রেন।
Advertisement
একপর্যায়ে ট্রেনটি ঢুকে পড়ে টানেলের ভেতর। গতি বাড়তে থাকে ট্রেনের আর টানেলের ওয়ালের সঙ্গে বারবার ধাক্কা লাগে তার। এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তার।
শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে এ ঘটনা ঘটে। মৃতের নাম সজলকুমার কাঞ্জিলাল (৬৬)। তিনি নন্দন চত্বরে লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী ট্রেনের ভেতরে থাকা এক যাত্রী বলেছেন, ‘যাত্রীরা বারবার বলছিল, হাতের মুঠোটা খুলে দিন। তাহলে হাত বেরিয়ে যাবে। তবে কিছুতেই মুঠ খুলছিলেন তিনি। সম্ভবত এসি ট্রেনটির জানলা-দরজা সব বন্ধ থাকায় এ শব্দ তার কানে পৌঁছায়নি।’
Advertisement
গৌতম দত্ত নামের এক যাত্রী ভারতীয় বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজারকে বলেন, ‘মেট্রোর দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে উঠে পড়েছেন বহু যাত্রী। তারপরেই শোনা যায় চিৎকার। কী ঘটল বুঝতে না পেরে ভিড়ের ভেতর থেকেই কোনোমতে মুখটা বার করে দেখলাম, কামরার দু’টি দরজার মাঝে আটকে রয়েছে একটি হাতের মুঠো। ট্রেন ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছাড়তে শুরু করেছে। আমরা কামরার সব যাত্রী চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু এসি মেট্রোর বাইরে সেই আওয়াজ পৌঁছাচ্ছিল না। জানালা দিয়ে দেখা গেল, দরজায় হাত আটকানো অবস্থাতেই এক ব্যক্তি প্ল্যাটফর্ম ধরে দৌড়াচ্ছেন।’
কয়েকজন যাত্রী ওই ব্যক্তির হাতের মুঠো খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বড়সড় বিপদ হতে চলেছে বুঝতে পেরে আমি কামরার কোথায় ট্রেনের চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেনটি রয়েছে, খুঁজতে শুরু করলাম। আমার মতো আরও কয়েকজন তখন একই চেষ্টা করছেন। কিন্তু চেন মিলল না। তখনই চোখে পড়ল, মেট্রোর কামরার দেওয়ালে থাকা লাল রঙের একটি বোতাম। আর এক সহযাত্রী সেই ইমার্জেন্সি অ্যালার্মের বোতাম টিপতে শুরু করলেন, কিন্তু কিছুই হলো না। কয়েকজন আবার জরুরি নম্বরে ফোন করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাতেও কিছু হলো না। চিৎকার করে ওই যাত্রীরা বলতে শুরু করলেন, ‘ফোন লাগছে না তো!’
ট্রেন তখন সুড়ঙ্গে ঢুকতে শুরু করেছে। জানালা দিয়েও আর দেখা যাচ্ছে না ওই ব্যক্তিকে। কিন্তু হাতের মুঠোটা রয়েছে দরজার ফাঁকে। কয়েকজন যাত্রী দরজা-জানালায় ধাক্কা মারতে শুরু করলেন। আমরা ছিলাম তৃতীয় কামরার তৃতীয় দরজার কাছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে কয়েকজন অল্পবয়সী যাত্রী ভিড় ঠেলে দৌড়াতে শুরু করলেন চালকের কামরার দিকে। ওদিকে ক্রমাগত হাতের মুঠোয় ধাক্কা মারতে থাকায় একসময় আঙুলগুলো খুলে যায়। মেট্রোর টোকেনটা পড়ে যায় কামরার ভেতরে। মুঠো খুলে যেতেই হাতটি বেরিয়ে যায় দু’টি দরজার ফাঁক থেকে।
সজলের মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘এমন ঘটনা মেট্রোরেলে প্রথম ঘটল। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। দোষীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।’
Advertisement
যাত্রীদের অভিযোগ, ওই ব্যক্তিকে টেনে টানেলে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ও তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ট্রেনের চালক এবং গার্ডরা। এমনকি ওই সময়ে প্ল্যাটফর্মে থাকা আরপিএফ কর্মীরাও ঘটনাটা দেখতে পাননি বলে তাদের একাংশের অভিযোগ। তবে অন্য যাত্রীরা বলছেন, ট্রেন সজলকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার সময় রেলপুলিশ কর্মীরা ছুটে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তখন সন্ধ্যা পৌনে ৭টা। পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম লোকে লোকারণ্য। কবি সুভাষগামী ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছালে যাত্রীদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে ট্রেনের দরজা যখন বন্ধ হওয়া শুরু হয়, তখন ইঞ্জিনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরার তিন নম্বর দরজায় ঢোকার চেষ্টা করেন সজল কুমার। তিনি ভেতরে হাত ঢোকাতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
সাধারণত এসব ক্ষেত্রে দরজা ফের খুলে যায়। কিন্তু এ দিন খোলেনি। হাত আটকে যায় সজলের। ট্রেনও চলতে শুরু করে। দ্রুত গতি বাড়িয়ে ঢুকে পড়ে টানেলের ভেতরে। সজল তখন হাত আটকানো অবস্থায় দরজায় ঝুলছেন। ধাক্কা খাচ্ছেন টানেলের দেয়ালে।
এই অবস্থায় প্ল্যাটফর্মের শেষসীমা থেকে টানেলের ভেতরে প্রায় ৬০ ফুট চলে যান সজল। কামরার যাত্রীরা ততক্ষণে ইমার্জেন্সি অ্যালার্মের বোতাম টিপতে শুরু করেন। দরজা-জানালায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। তখনো ট্রেন থামেনি। এরই মাঝে কোনোভাবে হাত আলগা হয়ে টানেলের এক পাশে ছিটকে পড়েন সজল
তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের দাবি, ইমার্জেন্সি অ্যালার্টের সঙ্কেত পেয়েই দ্রুত ব্রেক কষে ট্রেন থামান চালক। তারপর সেটিকে ফিরিয়ে আনা হয় পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে। টানেলেই পড়ে থাকেন সজল।
এসআর/পিআর