মতামত

এডিস জেগেছে আমরা জাগিনি

এদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে কোনো রোগব্যাধি বা যে কোনো বিপদ আসার আগে আমরা খুব একটা সচেতন হই না। বা হওয়ার প্রয়োজনও মনে করি না। সে কারণে ‘আল্লার ওয়াস্তে’ চলছে বলে কথাটা বেশ ব্যবহার করি আমরা। এই যেমন, বর্ষাকালে নাগরিক জীবনে নানা সমস্যার সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বর আসবে এটা গেলো দশবছর ধরেই আমরা জানি, কিন্তু প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা আদৌ নেয়া হয়েছি কি?

Advertisement

উত্তরটা এক কথায় ‘না’। অন্তত বর্ষা মৌসুম শুরুর পর থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টির পরেই রাজধানীতে মিলেছে ডেঙ্গুর বাহক এডিসের লার্ভার উপস্থিতি। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে রোগী এবং দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। নগরবাসীর অসাবধানতা আর অসচেতনতাতো রয়েছেই কিন্তু এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সংবাদ মাধ্যমে যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ জুন পর্যন্ত নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে ৭০৭ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু জুন মাসেই এ পর্যন্ত ৪৪০ জন ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১৪ রোগী ভর্তি হয়েছেন।

এর মধ্যে ১৯ ও ২০ জুন ৯১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি রোগীদের মধ্যে এপ্রিলে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। সুস্থ হয়ে ৫৮৭ জন বাড়ি ফিরেছেন। গত বছর এ রোগে ৯ হাজার ২২৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ২৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এ পর্যন্ত যেটা বোঝা গেলো এই রোগ আরো ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করতে পারে যদি এখনই থামানোর কোনো ব্যবস্থা না নেয়। দিন দিন যেভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

Advertisement

যদিও কয়েকটি সভা সেমিনারে বর্তমান মেয়ররা ডেঙ্গু দমনে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন কিন্তু বাস্তবতা বলে, ‘কাজের কাজ কিছুই হয়নি’। এর কারণ হতে পারে অবহেলা। ডেঙ্গুকে মোটেই ভয়াবহ ভাবছে না প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তারা। আবার তাদের ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্নতো রয়েছেই। রয়েছে জনবল সংকটও। তার মানে সেখানেও দুর্নীতি যে বাসা বেঁধেছে সেকথা বলায় যায়।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, এডিস মশা উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ, নারিন্দা, স্বামীবাগ, গেণ্ডারিয়াসহ আশপাশের এলাকা এবার ঢাকা মহানগরীর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর ঝুঁকিতে আছে যথাক্রমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড, ১৭নং ওয়ার্ড, ৪ ও ৩৯নং ওয়ার্ড, দক্ষিণ মুগদাপাড়া ও বাসাবো, মানিকনগর বিশ্বরোড, শেরেবাংলা রোড ও হাজারীবাগ, মগবাজার ও রমনা, সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, হাজারীবাগ, ফরাশগঞ্জ, শ্যামপুর, উত্তর যাত্রাবাড়ী ও ৪৮নং ওয়ার্ড। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে তেজগাঁও-এ। সেখানে লার্ভার ঘনত্ব সূচক (বিআই) সর্বোচ্চ ৪০ পাওয়া গেছে। এরপর আছে তুরাগ, পল্লবী, বনানী, গুলশান, বারিধারা।

বিশেষজ্ঞদের বয়ানে যদি বলি, ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহন করে এডিস মশা। এই জাতের মশা নালা নর্দমার নোংরা পানিতে জন্মায় না, বরং জন্মায় মানুষের বাড়ির ভেতরে ও আশপাশে জমে থাকা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে। ছাদে ও বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে; গাছের টব, ডাবের খোসা ইত্যাদি আধারে জমে থাকা পানিতে। বর্ষাকালে প্রায়ই থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে থাকে এবং এটাকেই ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম বলা হয়।

প্রাকৃতিকভাবে জুন থেকেই শুরু হয় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ঋতু। এসব হয়তো জানা কথা কিন্তু ডেঙ্গু নিধনে আমাদের দৃশ্যমান পদক্ষেপ সাধারণ নাগরিকদের খুব একটা আশ্বস্ত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক সময় নালায় গাপ্পি মাছ ছেড়েছিল কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি। কারও বাসায় মশার ডিম পেলে তাকে শাস্তি দেয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল কিন্তু সেই হম্বিতম্বিও শেষ। এরপর শোনা গেলো এডিস মশা মারতে পুরুষ এডিস মশা আমদানির গল্প। আসল কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

Advertisement

এবার মশার ওষুধ ছিটাতে কেনো দেরি হলো জানতে চাইলে মেয়র মহোদয় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ঈদের বন্ধের কারণে’। স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়ে আমাদের দেশের কর্তাদের এতো অনাগ্রহ কেনো বোঝা মুশকিল। আমাদের দেশের মানুষ এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন নানা কাজে। ফিরতি পথে তাদের সঙ্গে রোগ-জীবাণু আসা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। অন্যান্য দেশ এসব বিষয়ে বেশ সচেতন। কিন্তু উন্নয়নশীলতার কাতারে উঠতে যাওয়া আমাদের যেন মাথাব্যথাই নেই।

পাশের দেশ ভারতেও ডেঙ্গুর বিস্তার রয়েছে। অভিবাসী, চাকরি, ব্যবসায়ী, পর্যটক, ছাত্রছাত্রী ও রোগী ভারতে যাচ্ছেন, আসছেন। এদের মাধ্যমে নতুন নতুন রূপের ডেঙ্গু আসা অসম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ কলকাতা পুরসভা ড্রোন ব্যবহার করে সম্ভাব্য এডিস প্রজননক্ষেত্রের ছবি তুলে নাগরিকদের কাছে সেসব ধ্বংসের নোটিশ পাঠাচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। কিন্তু এডিস জেগে গেছে আমরা জাগছি না।

সিটি কর্পোরেশন অভিযোগ করে থাকে, অনেক এলাকায় তারা প্রবেশও করতে পারে না। তেমন কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলো সেসব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সমাধানের উপায় বের হতে পারে। যতোদ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে ততোই মঙ্গল। এডিশ মশা কোনো সভা-সেমিনারের তোয়াক্কা করে না। নেই ধনী-গরীব ভেদাভেদ।

কাজেই বক্তব্যে মশা না মেরে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে হবে নাগরিকদের। নাগরিকদের সতর্কতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিক দায়িত্বশীলতা থাকলে হয়তো ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলা করা কঠিন হবে না বলে আমাদের প্রত্যাশা। এরপরও যদি হয়েই যান আক্রান্ত তবে বাড়িতে ‘প্যারাসিটামল দু’বেলা’র চিকিৎসা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ বাড়িতে চিকিৎসা বা অ্যান্টোবায়োটিক এই রোগের ক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/পিআর