জাতীয়

কমিশনের পর কমিশন হয় প্রশাসন থাকে সেই তিমিরেই

জনপ্রশাসন সংস্কারে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত কমপক্ষে এক ডজন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনের সুপারিশ প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন করা হয়েছে সামান‌্যই। বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সংস্কারে অনাগ্রহী ছিল রাজনৈতিক সরকারগুলো। তাই এত কমিশন করার পরও প্রশাসন ঘুরপাক খাচ্ছে সেই তিমিরেই।

Advertisement

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন‌্যান‌্য ক্ষেত্রের মতো জনপ্রশাসনেও সংস্কারের বিষয়টি আলোচিত হয়। গঠিত হয় সংস্কার কমিশন। চার মাসের মধ‌্যে সুপারিশ প্রতিবেদনও দাখিল করে কমিশন। তবে এবার অনেকেই আশাবাদী জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে। তারা বলছেন, সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। অন‌্য সরকারগুলো যা পারেনি এ সরকার তা পারবে।

আছে ভিন্নমতও। আগের অভিজ্ঞতায় কেউ কেউ এবারও আশার আলো দেখছেন না। তারা বলছেন, এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আনতে হলে তাকে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর নির্ভর করতে হবে। এটি কঠিন। এছাড়া দৃশ‌্যমান সংস্কারের জন‌্য যে সময়ের প্রয়োজন সেটাও এ সরকার পাবে বলে মনে করছেন না তারা।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত জনপ্রশাসন সংস্কারে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি (সিএআর), মার্শাল ল কমিটি, প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি (সিএআরআর), অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস রি-অর্গানাইজেশন কমিশন (এএসআরসি), পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন (পিঅ্যান্ডএসসি), সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশন (সিএআরসি), অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রি-অর্গানাইজেশন কমিটি (এআরসি), রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশনসহ (আরআরসি) বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়।

Advertisement

কিন্তু এত বছরেও জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। দলীয়করণ চরম অবস্থায় নিয়ে গেছে প্রশাসনকে। একই সঙ্গে প্রশাসনে কর্মকর্তা বা বিভিন্ন ক্যাডারদের মধ্যে দ্বন্দ্বও ক্রমেই বেড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৩ অক্টোবর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।

আরও পড়ুন

ভাতা পাওয়ার যোগ্য কি না জানিয়ে দেবে প্রযুক্তি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে জনপ্রশাসনে ফের অসন্তোষ এক নীতি নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের টানাটানি!

প্রশাসন যে এখনো মানুষের প্রত‌্যাশা থেকে অনেক দূরে, সেটা নতুন এ সংস্কার কমিশনের জরিপেও উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন জনপ্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন। ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন জনপ্রশাসন ব‌্যবস্থা জনবান্ধব নয়। ৬৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকারি কর্মচারীরা নাগরিকদের সঙ্গে শাসকের মতো আচরণ করেন।

Advertisement

মুয়ীদ কমিশন গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করে। কমিশন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সংখ্যা কমানো ও মন্ত্রণালয়গুলোকে সমপ্রকৃতির পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত, নতুন দুটি বিভাগ গঠন, দেশকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করা, দিল্লির আদলে ক্যাপিটাল সিটি সরকার গঠন, ডিএসসি ইউএনওদের পদবি পরিবর্তন, সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন, কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর এবং ওএসডি প্রথা বাতিল, মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে সচিব নিয়োগ, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে কোটা পুনর্ববিন্যাস, ন্যায়পাল নিয়োগসহ ১৪টি বিভিন্ন শিরোনামে দুই শতাধিক সুপারিশ পেশ করেছে।

আমরা প্রশাসনে গত ৫০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। ইতোমধ‌্যে যে সব কমিশন হয়েছে। তারা কী সুপারিশ দিয়েছে না দিয়েছে, সেগুলো আমরা দেখেছি। নিজেদের স্বার্থ বা বড়ত্ব প্রকাশ করা নয়, সমস‌্যাগুলো সমাধানের বিষয়টি মাথায় রেখে সুপারিশ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস‌্য ড. মো. হাফিজুর রহমান ভুঞা

কমিশনের প্রতিবেদনকে মোট ১৭টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। কমিশন সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের সুবিধার্থে স্বল্পমেয়াদি (৬ মাস), মধ্যমেয়াদি (এক বছর) ও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বাংলাদেশে জনপ্রশাসন সংস্কারের অতীত উদ্যোগগুলোও স্থান পেয়েছে নতুন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।

কমিশন জানায়, পাকিস্তান আমল থেকে প্রাপ্ত প্রশাসনিক কাঠামো ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রতুল। স্বাধীন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাহিদা পূরণে ওই কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সরকারের আমলে অনেকগুলো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও কমিটি গঠন করা হয়। একমাত্র স্বাধীনতা লাভের পরপরই গঠিত সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টরেশন কমিটি (সিএআর) ছাড়া সব কমিশন ও কমিটিই পর্যাপ্ত সময় নিয়ে সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু সে সব সুপারিশের অধিকাংশই নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি ১৯৭২ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস রি-অর্গানাইজেশন কমিশনের (এএসআরসি) সুপারিশমালা অপ্রকাশিত ডকুমেন্ট হিসেবে রেখে দেওয়া হয়।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস‌্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মো. হাফিজুর রহমান ভুঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রশাসনে গত ৫০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। ইতোমধ‌্যে যে সব কমিশন হয়েছে। তারা কী সুপারিশ দিয়েছে না দিয়েছে, সেগুলো আমরা দেখেছি। নিজেদের স্বার্থ বা বড়ত্ব প্রকাশ করা নয়, সমস‌্যাগুলো সমাধানের বিষয়টি মাথায় রেখে সুপারিশ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘রিপোর্টে ভালোমন্দ থাকতে পারে। দেশের মানুষ বিবেচনা করুক। মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেটা ভালো হবে সেটা গ্রহণ করুক।’

আগের কমিশনগুলোর সুপারিশ প্রতিবেদনগুলোর মতো এবারও পরিণতি হতে পারে কি না- এ বিষয়ে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের একটি বিষয়। রাজনীতিবিদরা যদি মনে করেন আমরা জনগণের স্বার্থে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি; আমাদের ব‌্যক্তি, দলীয় ও সম্প্রদায়গত স্বার্থ ত‌্যাগ করতে হবে। না হলে সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষা হবে না। আমরা যেই ক্ষমতায় আসি- এটা করবোই করবো, তখন হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর কেউ যদি মনে করে আমার চেয়ে আর কে ভালো বোঝে, আমরা কথাই বেদবাক‌্য। তবে অবস্থা ঘুরেফিরে একই থাকবে।’

আরও পড়ুন

নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রশাসনে কাটছে না ধীরগতি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতরা যেসব সুবিধা পাবেন ওয়াসা-রাজউক-সিটি করপোরেশনের সব সেবাই থাকবে ‘নগর সরকারের’ অধীন

‘আগের কমিশনগুলো ভালো ভালো প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা আমাদের প্রতিবেদন দিয়েছি চার মাসে। আরও আগের কমিশনগুলোর ক্ষেত্রে কারও দুই বছর কারও তিন বছর লেগেছে। আরেকটু সময় দিলে আমাদের ভালো হতো। কিন্তু জাতির কাছে তো সেই সময় নেই’ বলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব।

স্বাধীনতার পর প্রথম হয় সিএআর কমিটি

১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম‌্যান এম এম জামানকে প্রধান করে পাঁচ সদস‌্যের সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি (সিএআর) গঠন করা হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রশাসনের পুনর্বহাল এবং কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা।

এএসআরসির কোনো সুপারিশই আলোর মুখ দেখেনি

অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস রি-অর্গানাইজেশন কমিশনের (এএসআরসি) সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- সেবাগুলোর সমতা প্রতিষ্ঠা এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারকে একত্রিত করে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করা। এতে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে হস্তান্তর করার সুপারিশ করা হয়, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সেবা পৌঁছায়। এছাড়া, সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণে উন্নত ব্যবস্থা চালু এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত মেধাভিত্তিক পদোন্নতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এ কমিশনের কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।

পিঅ্যান্ডএসসি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবই বাস্তবায়ন হয়নি

১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালুর ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনের চিরায়িত চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এম এ রশিদের নেতৃত্বে প্রধানত প্রশাসন ও বেতন কাঠামো যৌক্তিক ভিত্তির ওপর স্থাপন করার জন্য পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন (পিঅ্যান্ডএসসি) গঠন করা হয়। কমিশন সিভিল সার্ভিসকে চারটি স্তরে যথা- শীর্ষ ব্যবস্থাপনা ও বিশেষজ্ঞ গ্রুপ, নির্বাহী ও মিডেল ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ, পরিদর্শন ও কারিগরি গ্রুপ এবং ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ গ্রুপে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়। এছাড়াও ২৮টি ক্যাডার সার্ভিস গঠন, মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ, সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন এবং বেতন কাঠামো সরলীকরণের জন্য ৫২টি স্কেল প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। যদিও ২৮টি ক্যাডার এবং ২১টি বেতন স্কেল বাস্তবায়িত হয়েছে, তবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ, যেমন মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি এবং পৃথক সিভিল সার্ভিস মন্ত্রণালয় গঠন আজও বাস্তবায়িত হয়নি। রশিদ কমিশনের ওই প্রচেষ্টা একটি দূরদর্শী উদ্যোগ ছিল, যা বাংলাদেশের প্রশাসনকে আরও কার্যকর এবং জনমুখী করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারতো।

বাস্তবায়নের পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আগামীতে যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের সদিচ্ছার ওপর। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা একেবারেই নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটা একেবারেই গণতান্ত্রিক না। দলের প্রধান যিনি থাকেন, তিনি যা বলেন তাই হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সংস্কার সম্ভব না।- অধ্যাপক সাদিক হাসান

দুর্নীতি দমন-মেধাভিত্তিক পদোন্নতিতে সিএআরসি প্রস্তাব উপেক্ষিত

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে গঠিত হয় সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশন (সিএআরসি)। এ কমিশনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসনের কাজগুলোর প্রক্রিয়াগত জটিলতা দূর করে দক্ষতা বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কমিশন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম পুনর্বিন্যাস এবং কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তাদের মূল্যায়নের প্রস্তাব দেয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে আলাদা আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশও করা হয়। কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস ও কর্মক্ষমতা মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দুর্নীতি দমন এবং মেধাভিত্তিক পদোন্নতি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।

এআরসির সুপারির বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি

১৯৯৩ সালে প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে গঠিত হয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রি-অর্গানাইজেশন কমিটি (এআরসি)। সাবেক সচিব এম নুরুন্নবী চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই কমিটি ১৯৯৬ সালে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটি মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৩৫ থেকে ২২-এ নামিয়ে আনা, ৪৭টি সংস্থা বিলুপ্ত করা ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়। তারা ধারণা করেছিলেন যে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ১৭৪ কোটি টাকা সাশ্রয় এবং ৪৬ হাজার ২৭৬ জন সিভিল কর্মচারী অতিরিক্ত হবে। তবে, সরকারের পরিবর্তনের কারণে এ প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি।

পিএআরসির কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়

১৯৯৭ সালে গঠিত পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশন (পিএআরসি) ২০০০ সালে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। এ কমিশনের প্রধান ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এটিএম শামসুল হক। প্রতিবেদনে লোকপ্রশাসনের স্বচ্ছতা, দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়াও নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট (এনপিএম) তত্ত্বের আলোকে প্রশাসনিক ও প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন এবং সেবার মান উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়। কমিশন তিন ধরনের সুপারিশ দেয়- অন্তর্বর্তী, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। এ সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল পাবলিক অফিসের লক্ষ্য ও কার্যাবলি নির্ধারণ, সিভিল সার্ভিসে পেশাদারত্ব নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ এবং ফলাফলভিত্তিক কর্মক্ষমতা (অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স এগ্রিমেন্ট-এপিএ), সরকারি সংস্থার আয়-ব্যয়ের বিবরণ নিরীক্ষা, অধস্তন ও মাঠ পর্যায়ের দপ্তরে ক্ষমতা হস্তান্তর, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য সরকারি নথি ও প্রতিবেদনে উন্মুক্ত ও মুক্ত প্রবেশাধিকার, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা এবং পুরোনো আইন, নিয়ম, বিধি ও ফর্মের সরলীকরণ। কমিশনের সুপারিশগুলো সরকার গৃহীত হয় এবং কিছু অন্তর্বর্তী সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে নতুন নামকরণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরআরসির প্রতিবেদনও ছিল অবহেলিত

২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলী খানের নেতৃত্বে গঠিত রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন (আরআরসি) ছিল প্রশাসনিক কাঠামোকে গতিশীল ও কার্যকর করার এক সাহসী উদ্যোগ। ১৭ সদস্যের এ কমিশন বিদ্যমান আইন, উপবিধি ও সরকারি আদেশ পর্যালোচনা করে অপ্রয়োজনীয় বিধি বাতিল এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সরলীকরণের সুপারিশ করে। মোট ৪৯টি সুপারিশের মধ্যে প্রধান ছিল বাধ্যতামূলক রেগুলেটরি ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (আরআইএ) কাঠামো চালু করা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও সহজ করা। তত্ত্বাবধায়ক শাসনের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র কিছু সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে সহায়ক হলেও ২০০৯ সালে নতুন সরকার আসার পর কমিশন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

সরকারি সংস্থাগুলোর অসহযোগিতা এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে এ কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। আরআরসির কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেলেও এটি প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ওই সুপারিশগুলো কার্যকর করা হলে দেশের প্রশাসন আরও স্বচ্ছ, কার্যকর এবং জনমুখী হয়ে উঠতে পারতো বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতিটি উদ্যোগ দেশের সমসাময়িক প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ঘাটতি অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের মতো কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বাস্তবায়িত হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখনো অবাস্তবায়িত রয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কার শুধু নীতিগত নয়, এটি একটি ধারাবাহিক ও সমন্বিত প্রক্রিয়া। জনগণের জন্য আরও স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল ও কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এ সংস্কারগুলো দেশের উন্নয়নের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।

কেন বাস্তবায়ন হয় না কমিশনের সুপারিশ

জনপ্রশাসনস বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক উদ‌্যোগ ছাড়া সংস্কার করার সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকারগুলো এতটা দলীয় স্বার্থে বিভোর ছিল যে, কেউই সংস্কারকে গ্রহণ করতে পারেনি। একই নিজের ক্ষমতার কথা ভেবে আমলাদের মধ্যে থেকেও ছিল বড় ধরনের বাধা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান জাগো নিউজকে কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ তুলে ধরে বলেন, ‘কমিশনগুলোর প্রতিবেদন বাস্তবায়ন না মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো পর্যায়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।’

তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমলারা বাধা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ আমলাদের একটি অংশ মনে করে, সংস্কার হলে তাদের ক্ষমতা কমে যাবে। পরিবর্তনের বিষয়ে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে গণতান্ত্রিক চর্চা করা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে সব পরিবর্তন আনা সম্ভব।’

আশা-হতাশার দোলাচল

নতুন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে কতটা আশাবাদী- এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সাদিক হাসান বলেন, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কিছু স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে। তবে যেগুলো সত‌্যি সত‌্যি ইমপ‌্যাক্ট ফেলবে সেগুলোর করার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। এটা করতে পারে রাজনৈতিক সরকারকে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি পরিবর্তনগুলোর বিষয়ে একমত হয়, সেটা সম্ভব। তবে আমরা এর আগে ১৯৯০ সালে দেখেছি, দলগুলোর মধ‌্যে একটা ঐকমত‌্য হয়েছিল। পরে কিন্তু এটা মানা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘বাস্তবায়নের পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আগামীতে যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের সদিচ্ছার ওপর। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা একেবারেই নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটা একেবারেই গণতান্ত্রিক না। দলের প্রধান যিনি থাকেন, তিনি যা বলেন তাই হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সংস্কার সম্ভব না। তাই সার্বিক অবস্থায় খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।’

এছাড়া কমিশনের কিছু কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য মনে হয়নি মন্তব‌্য করে সাদিক হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সুপারিশই বাস্তবধর্মী নয় বলে মনে করছি। চারটি প্রদেশ গঠনের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এটা কোনোভাবেই আমাদের এখানে কাজ করবে না। প্রদেশ পর্যায়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আমাদের কোনো রাজনীতিবিদদের নেই বললেই চলে।’

মুয়ীদ কমিশনের প্রতিবেদনে অনেক ভালো ভালো সুপারিশ রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলেও জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের এক শিক্ষক।

আরএমএম/এএসএ/এমএস