মতামত

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে উত্তেজনা ও ইংল্যান্ডের বাণিজ্য

ক্রিকেট খেলার আঁতুড়ঘর বলা হয় ব্রিটেনকে। সে হিসেবে ক্রিকেট নিয়ে যেটুকু উন্মাদনা থাকার কথা এই দেশে, সে উন্মাদনা এখানে নেই। যেটা আছে এখানকার ফুটবলে। গেল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড সেমি ফাইনাল পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের উন্মাদনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি এখানে প্রিমিয়ার লীগের একটা ফুটবল খেলা থাকলেও লন্ডন শহর বলেন আর ম্যনচেষ্টার বলেন, ব্রিটেনের শহরগুলো যেন ভাসতে থাকে। পানশালাগুলো লোকারণ্য হয়। মাতাল মানুষের চিৎকারে সয়লাব হয় যায় সারা ব্রিটেন। সে হিসেবে পৃথিবীর কারুকার্যময় খেলা ক্রিকেট নিয়ে নেই খুব একটা আলোচনা। নেই উন্মাদনা। রাস্তায় অফিসে এ নিয়ে নেই খুব একটা জোর আলোচনা।

Advertisement

কিন্তু তবুও ইংল্যান্ডেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ এখানে এসেছে বিশ্বকাপের ব্যাটিং আর বোলিং এর গতি দেখতে। আপামর ব্রিটিশ জনগণের কাছে এ খেলার জনপ্রিয়তা না থাকলেও ক্রিকেট প্রেমী কিংবা ক্রীড়ায় মত্ত মানুষগুলোর কমতি নেই এ দেশটাতে। তাছাড়া গত দু'দশক পর এই প্রথম অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এই ব্রিটেনে, তাই স্বাগতিক দেশ হিসেবে ব্রিটেন যেন হয়ে গেছে উৎসবের দেশ। বিশেষত এশিয়ানরা এই উৎসবের প্রধান অংশ। শহরে শহরে উৎসবে মেতে উঠছে বাংলাদেশ আর পাকিস্থানের অভিবাসী মানুষগুলো।

খেলা নিয়ে ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণ যদিও খুব একটা উৎসাহী নয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায কোনই ঘাটতি নেই। প্রত্যেকটা শহরই, যেখানে খেলা চলছে, সবখানেই আছে প্রয়োজনীয় আয়োজন। ক্রিকেটকে আরও ব্যাপক জনগণের পাশাপাশি নিয়ে যেতে এ আয়োজন কাজ দেবে বলে ব্রিটিশদের বিশ্বাস।

এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই এবার ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জয়ে বদ্ধপরিকর। সেজন্যে তারা ব্যাপক উদ্যোগও নিচ্ছে, খেলাটিকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও আঁটছে। ব্রিটিশ ক্রীড়া পর্যবেক্ষকরা মনে করছে, এবছরে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আয়োজন এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে ইংল্যান্ডে ৫দিনের টেস্ট ম্যাচ (দি এশেস) ব্যাপক সংখ্যক ক্রিকেট দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারবে। এছাড়াও আগামী গ্রীষ্মকালীন সময়ে তারা আরও মানুষদের সংযুক্ত করতে ‘দি হানড্রেড’ ১০০ বলের একটা খেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে। এসব আয়োজনে দর্শক ইংলিশ না ভারতীয় যুবক না বৃদ্ধ তা বিবেচনায় নেয়া হবে না। ব্যাপক নাগরিকদের অংশগ্রহণ করানোই এর লক্ষ্য।

Advertisement

এবার তাদের টার্গেট ছিল ষোল বছরের নিচে অন্তত এক লাখ কিশোর-কিশোরীদের খেলা দেখতে আকৃষ্ট করা। তারা এবার দেড় লাখ টিকেট বিক্রি করেছে শুধু মহিলাদের মাঝে। ২০১৭ সালে মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপের সাফল্য হিসেবেই ক্রিকেটে মহিলাদের এ সংযুক্তিকে তারা বিবেচনা করছে। ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯, ইংল্যান্ড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্টিভ এলওয়ার্থি বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একটা দল অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড সফর করেছিলেন। ২০১৫ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু আগে তারা কিভাবে ব্যাপক নাগরিকদের সংযুক্ত করেছিলেন এ খেলায় তার একটা সমীক্ষা নিতে তাদের এ সফর ছিল। এবং সে হিসেবে তারা এবারের বিশ্বকাপে দর্শক সংযুক্ত করতে আরও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন।

শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যময় ক্রিকেট দর্শক আছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় বিশ্বকাপ দেখার মোট আসন সংখ্যা কম। বিশ্বকাপে ৮ লাখ মানুষের আসন আছে যদিও এর থেকে ১লাখ ৫০হাজার টিকেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। তারা মনে করছেন, মাত্র ৬ লাখ ৫০ হাজার টিকেট একটা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য অপ্রতুল। তাদের সবকিছু আছে, সব আয়োজনই বিশ্বমানের, কিন্তু আমাদের নিজস্ব দর্শক সংখ্যা অর্থাৎ সহজ কথায় ক্রিকেট সমর্থিত মানুষের সংখ্যা অবশ্যই কম।

খেলা সারা পৃথিবীতেই একটা বিশাল বাণিজ্য। ফুটবলের বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ক্রিকেট কিংবা অন্য যে কোন ক্রীড়া অনুষ্ঠানের স্বাগতিক দেশটা শুধুই পৃথিবীব্যাপী আলোচিত হয় না। অর্থনৈতিক লাভালাভের ব্যাপারটাও এখানে আছে। মাত্র দুএকটা প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা যায়। ল্যাংকাশায়ারের ওল্ড ট্রাফোর্ড ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হবে ৬ টি খেলা। এর মাঝে দুটো সেমিফাইনালও এখানেই হবে। কিন্তু ১৬ জুনের ম্যাচটি নিয়ে ম্যানচেস্টার রীতিমত আছে তটস্থ।

রাজনৈতিক কারণেও ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে একটা অস্থিরতা কাজ করে, যার রেশ আছে ক্রিকেটেও। উত্তেজনা থাকে টান টান। ঐ দুটো দেশের খেলা হচ্ছে ঐদিন। ল্যাংকাশায়ার ক্রিকেট গ্রাউন্ড পুনঃনির্মাণ করে এখানে ২৩ হাজার দর্শকের আসন সংকুলানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ এই খেলার টিকেটের জন্য বিস্ময়করভাবে প্রায় ৫ লাখ মানুষ আবেদন করেছিলো। টিকেটগুলো বিক্রিতে আসার মাত্র অল্প কদিনের মধ্যেই সব টিকেট বিক্রি হয়ে যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ভারত আর পাকিস্তানের একটা খেলা পৃথিবীর অর্ধ বিলিয়ন মানুষ টিভি’র মাধ্যমে উপভোগ করেছিলো। ক্রিকেট ইতিহাসে এ খেলাটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর্শকপ্রিয় খেলা হিসেবে এখনও ধরা হয়।

Advertisement

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর খেলা যেখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই টিকেটের হাহাকার পড়েছে। বিশেষত বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানের খেলা মানে টিকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি। এই কাড়াকাড়িতে এমনকি টিকেট কালোবাজারি পর্যন্ত হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ কেউ টিকেট কিনে রেখেছিলো, এখন কালো বাজারে অর্থাৎ পরবর্তীতে চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছে। টিকেটের জন্য সর্বোচ্চ মূল্য ২৫০০ পাউন্ড অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় আড়াই লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে টিকেট সংগ্রহের খবর দিয়েছে জনপ্রিয় পত্রিকা ম্যানচেস্টার ইভিনিং নিউজ। ইতিমধ্যে আইসিসি ভিন্ন কোন মাধ্যমে টিকেট বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে।

এদিকে ম্যানচেস্টারের ভারত পাকিস্তানের খেলার এই উন্মাদনাকে কাজে লাগাচ্ছে ম্যানচেস্টার সিটি কাউন্সিল। ম্যানচেস্টার কাউন্সিল লাখো ক্রীড়ামোদীদের আশাহত করছে না। কাউন্সিল এক বিশেষ ‘ফান ভিলেজ’ খোলার ঘোষণা দিয়েছে ১৬ জুন। সিটি সেন্টারের ক্যাথেড্রেল গার্ডেনে এই ফান ভিলেজে থাকবে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ঐতিহ্যবাহী খাবার, গাইবেন সেখানে খ্যাতিমান শিল্পীরা, থাকবে ভিন্ন ধরনের বিনোদনের আয়োজন। আর ঐ ফান ভিলেজে থাকবে বিশাল স্ক্রিন, যেখানে মানুষ উপভোগ করবে ঐদিনের ভারত আর পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ। সারা শহরে ঐদিন বিশেষ পুলিশ টহল থাকবে। সমর্থকদের উত্তেজনা না ছড়াতে এখন থেকেই সতর্ক বার্তা দিয়ে রেখেছে স্থানীয় পুলিশ। টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে ম্যানচেস্টার অন্তত এক মিলিয়ন পাউন্ডের অতিরক্তি বাণিজ্য হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ব্রিটেনের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর হল বার্মিংহাম। ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশী, পাকিস্তানী আর ভারতীয় মানুষের আবাস এই শহর ঘিরে। এই শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হবে পাঁচটি খেলা। ইংল্যান্ডে ভারতের খেলা আছে এই শহরে। ইংল্যান্ডে সমর্থকদের ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু ভারতীয় সমর্থকদের জন্য স্টেডিয়ামকে অপেক্ষা করতে হবে না কর্তৃপক্ষের। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের খেলা হবে বার্মিংহামেই। যে খেলার টিকেট অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। এই খেলাটি নিয়ে উত্তেজনা আছে। কারণ ভারতীয় সমর্থক যেমন এ খেলায় উপস্থিত হবে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশী হাজার হাজার সমর্থক জানান দেবে তাদের সপ্রাণ উপস্থিতি ঐদিন।

বার্মিংহামের স্থানীয় অর্থনীতিতে একটা বড় ধরনের সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে মাত্র এই পাঁচটি দিন। একাউন্টেন্সি ফার্ম ‘ই ওয়াই’ জানিয়েছে, শুধু এই পাঁচটা দিনকে ঘিরে বার্মিংহাম কম করে হলেও ৩২ মিলিয়ন পাউন্ডের অর্থনৈতিক বাণিজ্য করবে। এই পাঁচদিনে এই শহরে পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে হোটেলগুলোতে ঐ কটা দিনের জন্য রুম সংকট দেখা দিয়েছে । খাবার, পানীয়, ট্রান্সপোর্ট, ভ্রমণ বিদেশী পর্যটক এবং শহরটির সেবা খাত মিলিয়ে এই ৩২ মিলিয়ন পাউন্ড রাষ্ট্রটির অর্থনীতির একটা অংশ হবে। আর তারই প্রমাণ মেলে যখন হিসেবের খাতায় দেখা যায়, ওভাল স্টেডিয়ামের ৫ জুনের বাংলাদেশের খেলার দিন ২৪ হাজার টিকেটের ১৬ হাজারই বাংলাদেশীরা কিনে নেন।

এই ই হলো ব্রিটেন, ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা না থাকলেও এই ক্রিকেটে দেশটির বিনিয়োগের কোন কমতি নেই। আর তাই বিশেষত এশিয়ার জনপ্রিয় এই খেলাটির স্বাগতিক দেশ হয়ে তারা তাদের সেবা ঠিকই দিয়ে যাচ্ছে এবং বাণিজ্য করছে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড মাত্র মাস দেড়েকের মধ্যেই। ব্রিটেনের মানুষের কাছে ক্রীড়া হিসেবে কম উচ্চারিত ক্রিকেট যদিও, কিন্তু বাণিজ্যে ঠিকই পিছিয়ে নেই ব্রিটেন।

লেখক : ইংল্যান্ডপ্রবাসী সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম