খেলাধুলা

প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন জ্বালিয়ে জয়ের আকাঙ্ক্ষায় পুড়ুন সাকিবরা

আশা করি এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হাতে জ্বলে ওঠা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুনটা আর নিভবে না। এমনকি শনিবার কার্ডিফে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও মশালটা জ্বালিয়ে রাখবে মাশরাফির দল।

Advertisement

চলমান ইংলিশ গ্রীষ্মের দ্বিতীয় পর্বে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট পিচগুলো এমনিতেই শুকনো, খটখটে হয়ে ওঠে। তারওপর অনুমান করছিলাম আইসিসি এমন পিচ বানাবে যেখানে রানের বান ডাকবে। মাথা কুটে মরতে হবে বোলারদের। কারণ, ইংল্যান্ডকে একটু না একটু সুবিধা দেওয়া হবে, তাদের ব্যাটিং লাইন–আপটা যেহেতু দুর্ধর্ষ। এটি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বিষয়ও নয়। যুগ যুগ ধরে আয়োজক দেশকে সুবিধা দেওয়ার অলিখিত এই চর্চাটা হয়ে আসছে।

মানসিক প্রস্তুতি তাই একটা ছিলই যে, রানের মহোৎসব দেখব ২০১৯ বিশ্বকাপে। স্কোরবোর্ড সাড়ে তিন’শ–চার’শ রান উঠবে হামেশাই। সীমিত ওভারের আধুনিক ক্রিকেটে বোলাররা কবেই ক্রিকেট মায়ের সৎ ছেলে হয়ে গেছে! কিন্তু ব্যাটসম্যানদের বেধড়ক পিটুনিতে তাদের ঝুলে পড়া কাঁধ আর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখগুলো ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। মন থেকে ভালো লাগছিল না। আমরা তো চাই ব্যাট–বলের সমান সমান লড়াই চলুক। যে অনিশ্চয়তার অনুভবে ক্রিকেটের আসল মজা, সেটা থাকুক।

ধাক্কা খেতে হলো শুরুর ম্যাচটি থেকেই। নিজের মাঠ, পরিচিত পরিবেশ, দুর্দান্ত সব ব্যাটসম্যান— ইংল্যান্ড তিন শ’র ওপারে গেল বটে; কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা কোনো লড়াই–ই করতে পারল না! রান তাড়া করে হারল ১০৪ রানে। একেবারেই একপেশে খেলা। এর মধ্যে ক্রিকেটের রোমাঞ্চ কোথায়?

Advertisement

পরের দুটি ম্যাচ আরো বিস্ময়কর। যেন টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটের পেশিশক্তির প্রদর্শনী। পাকিস্তান ২১.৪ ওভারে ১০৫ রানে অলআউট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এক ফুৎকারে এই রান উড়িয়ে ম্যাচ জিতে নিল ১৩.৪ ওভারে। শ্রীলঙ্কাকে ১৩৬ রানে শেষ করে নিউজিল্যান্ড জিতল ১০ উইকেটে। অনেকের সংশয় ঘুচিয়ে একইদিনের আরেক ম্যাচে আফগানিস্তান পেরোল ২০০ (৩৮.২ ওভারে ২০৭)। অস্ট্রেলিয়ার কাছে যা হলো নস্যিতুল্য, ৯১ বল বাকি থাকতেই তারা জয়ী ৭ উইকেটে।

এমন সময় আরো বাজে ও বিরক্তিকর কিছু ম্যাচ দেখার হাত থেকে দর্শকদের বাঁচাতেই যেন এগিয়ে এল বাংলাদেশ। ভেন্যু কেনিংটন ওভাল। প্রথমে ব্যাট করে সৌম্য–সাকিব–মুশফিক–মাহমুদউল্লাহরা বাংলাদেশকে উপহার দিলেন নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্কোর, ৩৩০। তখন পর্যন্ত এই বিশ্বকাপেরই যা সর্বোচ্চ। লড়াকু দক্ষিণ আফ্রিকা হার মানল ২১ রানে।

বড় দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতে গেলে এখনো সেটিকে এখনো অঘটন বলে ক্রিকেটের প্রথম বিশ্ব। স্কোর লাইনটা প্রথম দেখায় ভুল বোঝাতে পারে। ব্যবধান সামান্য। কিন্তু মাশরাফির দল পুরোটা ম্যাচেই প্রোটিয়াদের লাল চোখে তাকাতে দেয়নি। লাগাম তাদের হাতেই ছিল।

বাংলাদেশের জয়, দৃশ্যতই তাদের লাভ; বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ জিতেই স্বপ্ন যাত্রার পালে নতুন হাওয়ার আমদানি । কিন্তু বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের এই মঞ্চের লাভও তাতে কম হলো না। বাংলাদেশ যেন আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দিল অন্যদের মধ্যে। ছড়িয়ে দিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন।

Advertisement

ভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠল পাকিস্তান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ভস্মীভূত দলটিই তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে করল ৩৪৮ রান। সেটিও স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এই বিশ্বকাপেই যাদের কাছ থেকে ৫০ ওভারের ক্রিকেট প্রথম ৫০০ রানের ইনিংস দেখতে পারে বলে বলাবলি হচ্ছিল। ইংল্যান্ড অবশ্য অনেক দূর গেল, দাগটা ছুঁতে পারল না ১৪ রানের জন্য। এর পরের ম্যাচগুলো দেখুন। কী জমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতা! এটাই তো আমরা চেয়েছিলাম।

আগের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে বিধ্বস্ত হওয়া শ্রীলঙ্কা মাত্র ১৮৭ রানের সংশোধিত পুঁজি নিয়েও জয়ী আফগানিস্তানের বিপক্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকার বেঁধে দেওয়া ২২৮ রানের লক্ষ্য ছুঁতে ভারতেরও ঘাম একটু ছুটেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাম ধাক্কা খাওয়ার হাত থেকে কোনোক্রমে বেঁচেছে অস্ট্রেলিয়া। আর এর মাঝখানে আবারও বাংলাদেশের বীরত্ব প্রদর্শন।

নিউজিল্যান্ড পেসারদের ভয়ঙ্কর পেস আর সুইং সামলে স্কোর বোর্ডে জমা করা গিয়েছিল মাত্র ২৪৪ রান। কিউইদের যে ব্যাটিং শক্তি, তাতে এটি একেবারেই স্বল্প পুঁজি। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ারই কথা ছিল না। কিন্তু এতেই ঘাম ছুটে গেছে তাদের। ২ উইকেটে জিতেছে ৪৮তম ওভারে গিয়ে। সময়মতো সাকিবদের আর দুটি মাত্র বল লক্ষ্যভেদ করতে পারলেই বাংলাদেশের জয়ের ঘরে দ্বিতীয় টিক–চিহ্ন পড়ত।

বিশ্বকাপটা দূরপাল্লার দৌড়। লিগ পর্বেই এখনো সাত চক্কর পেরোনো বাকি। সেই পথে পরের বাধার নাম ইংল্যান্ড। ধরে নিতে পারি, আহত সিংহের মতো গর্জে উঠবে ত্রিসিংহ বাহিনী। তবে হার–জিত যাই হোক, এ দেশ জানে লড়াইটা ছাড়বে না মাশরাফির দল। একটি মশাল হাতে ওঠালে সেটি উঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলাটাই দায়িত্ব। মশালটাকে এত তাড়াতাড়ি সাকিবরা নিভিয়ে ফেলতে পারেন না।

ভুরি ভুরি বাজে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ম্যাচ দেখার বিরক্তি থেকে দর্শকদের স্বস্তি দিতে আইসিসি এবারের বিশ্বকাপকে করেছে ১০ দলের প্রতিযোগিতা। সর্বোচ্চ পর্যায় অর্থাৎ টেস্ট খেলে ১২ দেশ, কিন্তু বাকি দুটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ প্রবেশাধিকার পায়নি।

মুখে বিশ্বায়নের কথা বললেও কার্যত ক্রিকেটের বিশ্ব সংস্থাটির নীতি বিশ্ব সংকোচন। সেই নীতি আবার ক্রিকেটের তিন প্রধান শক্তি ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কারখানাজাত। এরা ক্রিকেটের তিন মোড়ল আর এদের কাছে আইসিসির চরিত্র রামকৃষ্ণ মিশন বা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের চেয়ে ভিন্নতর হতে পারেনি।

এবার শুরুতেই এমন নিষ্করুণ ম্যাচের ছড়াছড়ি দেখে তাই ভয় হচ্ছিল আইসিসি না আগামী বিশ্বকাপকে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ত্রিদেশীয় বা বড়জোর নিউজিল্যান্ডকে যুক্ত করে চার জাতির টুর্নামেন্ট করে ফেলে। মাশরাফি–সাকিবরা অন্তত সেই ভয়টা দূর করে দিয়েছেন।

এই ভয়ের প্রেক্ষাপটটা আসলে বৈশ্বিক, কিন্তু জাতীয় মানস বলে ভিন্ন কথা। সেখানে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বস্তির চেয়েও বড় হয়ে ওঠে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা। না বললেও বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে সেই আকাঙক্ষার নাম জয়। ওভালে নিজেদের সর্বশেষ ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগুন জ্বেলেও পরাজিত বাংলাদেশ দল কার্ডিফে থাকুক না সেই আকাঙ্ক্ষার সমান্তরালে।

আইএইচএস/